আদিভূত-বৃত্তান্ত – দ্বিতীয় অধ্যায় – বরাহ পুরাণ

আদিভূত-বৃত্তান্ত – দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ  সূত কহিলেন; হে ব্ৰহ্মন! জগৎ-চিন্ত [মণি হরি ধরণীর ভক্তিপূর্ণ স্তবে সন্তুষ্ট হইয়া স্বীয় মায়াপ্রভাবে বরাহরূপ ধারণ-পূর্বক অবস্থিত রহিলেন এবং ধরাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “হে সুশ্রোণি!

এক্ষণে আমি সর্বশাস্ত্রেব সার সংগ্ৰহ করিয়া পুরাণের বিনয় তোমার নিকট কীৰ্ত্তন করিাতেছি; তুমি তাহ অবহিত মনে শ্রবণ কর।”

বরাহ কহিলেন, “পুরাণ পঞ্চালক্ষণান্বিত : —সর্গ, প্রতি সৰ্গ, বংশ, মন্বন্তর ও বংশানুকীৰ্ত্তন—এই পাঁচটিই পুরাণের লক্ষণ। হে বরাননে! আমি তোমাকে আদি সর্গের বৃত্তান্ত বর্ণনা করিতেছি—শ্রবণ করে। ইহাতে দেব ও রাজগণের পবিত্ৰ চরিত।

যথাক্ৰমে বর্ণিত হইবে। শোভনে! আমি জীবগণের আত্মাস্বরূপ পরমাত্মা; সৃষ্টিকালে আমি নানা বুদ্ধিতে উপলক্ষিত হইয়া থাকি। আমার স্বকীয় মায়। লয়প্ৰাপ্ত হইলে সৃষ্টির পূর্বে এই বিশ্ব একমাত্র মৎস্বরূপ হইয়াছিল, অর্থাৎ তৎকালে অন্য দ্রষ্টা বা দৃশ্য কিছুই দেখা যায় নাই।

আদিভূত-বৃত্তান্ত – দ্বিতীয় অধ্যায় - বরাহ পুরাণ

আদিভূত-বৃত্তান্ত – দ্বিতীয় অধ্যায় – বরাহ পুরাণ

সে সময়ে একমাত্র আমিই প্ৰকাশ পাইয়াছিলাম; সুতরাং স্বয়ং দ্রষ্টা হইলে ও অন্য কোন দৃশ্যই দেখিতে পাই নাই। অতএব মায়াদি শক্তি লয় প্রাপ্ত হওয়াতে দৃশ্য ও দ্রষ্টৃত্বের অভাবে “আপনি যেন নাই” এইরূপ ধারণা হইতে পারে; কিন্তু চিৎশক্তি দেদীপ্যমাআন ছিল; এই জন্য আপনার অস্তিত্ব বিস্মৃতি হইতে পারি নাই।

আমি দ্রষ্টৃস্বরূপ এবং আমার সেই শক্তি কাৰ্য্যকাররূপা। দেবী! ঐ শক্তিরই নাম মায়া; আমি ইহার দ্বারাই এই প্রত্যক্ষ পরিদৃশ্যমান, জগৎ সৃষ্টি করিয়াছি। সেই মায়া হইতে মহতের সৃষ্টি হইয়াছে। অনন্তর সেই মহৎ অর্থাৎ মহত্তত্ত্ব বিকার প্রাপ্ত হইলে তাহা হইতে অহঙ্কার তত্ত্ব উদ্ভূত হইল।

সেই অহংবুদ্ধি তিন প্রকার, বৈকারিক অর্থাৎ সাত্বিক, তৈজস অর্থাৎ রাজস, ও তামস। সাত্বিক অহঙ্কার সৃষ্টির নিমিত্ত বিকার প্রাপ্ত হইলে তাহা হইলে মনঃ উৎপন্ন হইল।

জ্ঞানেন্দ্ৰিয় ও কৰ্ম্মেন্দ্ৰিয় এতদুভয়ই রাজস অহঙ্কার হইতে উৎপন্ন; তামসিক অহঙ্কার বিকার প্রাপ্ত হইলে তাহা হইতে শব্দের উৎপত্তি হইল; এই শব্দ হইতেই আকাশ হইয়াছে; তাহাই আমার লিঙ্গশরীর।

অনন্তর কাল ও মায়ার অংশ যোগে আমি আকাশের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম; তাহাতে সেই আকাশ হইতে স্পর্শ জ্ঞান উদ্যত ও রূপান্তরিত হইয়া বায়ু সৃষ্টি করিল, অর্থাৎ আকাশ হইতে স্পৰ্শতন্মাত্ৰ দ্বারা পাবনের উৎপত্তি হইল।

তাঁহার পর মহাবলশালী বায়ু আকাশের সহিত বিকার প্রাপ্ত হওয়াতে তাহা হইতে রূপ-তন্মাত্র দ্বারা তেজের সৃষ্টি হইল;  ভদ্রে সেই তেজই সকল ভুবনের প্রকাশক।

“দেবি! অনন্তর সেই তেজঃ বায়ুর সহিত যুক্ত হইয়া বিকারপ্রাপ্ত হইলে তাহা হইতে সলিল সৃষ্ট হইল এবং সেই জল হইতে গন্ধতন্মাত্র দ্বারা তোমাকে সৃষ্টি করিলাম। হে ভুতধাত্ৰি! এই সমস্ত ভূত আমার ইচ্ছাক্রমে পরস্পর মিলিত হওয়াতে সমস্টি ও ব্যষ্টিস্বরূপ ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হইল।

সেই অণ্ড বহুসহস্র বর্ষ জলের উপর ভাসমান ছিল; আমি সেই অণ্ডকে সচেতিত করিলাম; পরে সেই অণ্ড বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইলে আমি তাহা হইতে নিৰ্গমনপূর্বক তাহাকে পৃথক করিয়া অবস্থিতি করিবার নিমিত্ত ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিতে করিতে পবিত্র গর্ভোদক নামে উদক সৃষ্টি করিালাম।

আদিভূত-বৃত্তান্ত – দ্বিতীয় অধ্যায় - বরাহ পুরাণ

সেই জলে আমি সহস্ৰ বৎসর বাস করিয়াছিলাম। দেবি! নারী ঐ উদিকের নামান্তর; উহা আমার আয়ন অর্থাৎ স্থিতি-স্থান হওয়াতে আমার নাম নারায়ণ হইয়াছে।

“দেবি! কল্পে কল্পে আমি এই জলের উপর অনন্ত শেষ-শয্যায় শয়ন করিয়া থাকি। তৎকালে আমার দৃষ্টি সৃষ্টির নিমিত্ত সূক্ষ্য অর্থে অভিনিবিষ্ট হয়; আমার অন্তরস্থিত সেই সূক্ষম অর্থ কালানুসারে রজোগুণ দ্বারা ক্ষোভিত। হইয়া পদ্মাকারে মদীয় নাভিদেশ হইতে উদ্ভূত হইল।

বেদময় ব্ৰহ্মা এই পদ্ম হইতে উৎপন্ন হইলেন। অনন্তর আমি তাঁহাকে প্ৰজা সৃষ্টি করিতে বলিয়া তৎক্ষণাৎ অন্তহিত হইলাম। কিন্তু তিনি কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া ক্ৰমাগত চিন্তা করিতে লাগিলেন; তাহাতে তাঁহার মহা রোষ সস্তুত হইল, এবং সেই প্রচণ্ড রোষ হইতে এক নীললোহিত বালক উৎপন্ন হইলেন।

উৎপন্ন হইয়াই তিনি ক্ৰমাগত রোদান করিতে লাগিলেন। ব্ৰহ্মা তাহাকে নিবারণ করিলেন। অনন্তর সেই বালক রোদিন সম্বরণ করিয়া কহিলেন, “পিতঃ! আমাকে নাম দিন।”

তদনুসারে ব্ৰহ্মা তাঁহার রুদ্র নাম রাখিলেন ও তাঁহাকে সৃষ্টি করিতে কহিলেন; কিন্তু তিনি অশক্ত হইয়া তপশ্চরণ করিবার নিমিত্ত জলে নিমগ্ন হইলেন।

তখন ব্ৰহ্মা স্বীয় দক্ষিণ অঙ্গুষ্ঠ হইতে অন্য এক প্ৰজাপতি এবং বামাঙ্গুষ্ঠ হইতে তাঁহার পত্নী সৃষ্টি করিলেন। সেই প্ৰজাপতি সেই ভাৰ্য্যায় স্বয়ম্বুব মনুকে উৎপাদন করেন। এই মনু হইতেই লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়াছে।

পৃথিবী কহিলেন, “সুরেশ্বর! কল্পারম্ভে কমলযোনি ভগবান ব্ৰহ্মা যেরূপ নরায়ণাখ্যা প্রাপ্ত হইয়া আদি সর্গে সৃষ্টি করিয়াছিলেন, আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার নিকট তাহা সবিস্তরে বর্ণন করুন।”

ভগবান কহিলেন, “দেবি! নারায়ণাত্মক ব্ৰহ্মা যেরূপে সমস্ত ভূত সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তাহা আমি বিস্তার সহকারে তোমার নিকট কীৰ্ত্তন করিতেছি, তুমি শ্রবণ কর। অতীব কল্পাবসানে নিশা-যোগে একদা ব্ৰহ্মা নিদ্র।

যাইতেছিলেন, এমন সময়ে তাঁহার সত্বগুণ উদ্রিাক্ত হয়; তিনি নয়ন উন্মীলন করিয়া দেখিলেন, জগৎ-সংসার শূন্য;— কোথাও জীবমাত্রের অস্তিত্ব নাই।

হে দেবি! সৃষ্টির অগ্ৰে আদিস্রষ্টা ব্ৰহ্মা তমঃ অর্থাৎ স্বরূপের অপ্ৰকাশ; মোহ অর্থাৎ দেহাদিতে অহিংবুদ্ধি; মহামোহ অর্থাৎ ভোগেচ্ছ; তামি স্র অর্থাৎ ক্ৰোধ ও অন্ধ তামিস্ৰ অৰ্থাৎ ভোগ্যবস্তু-নাশে আমারই অস্তিত্ব বিলুপ্ত হইল, এইরূপ বুদ্ধি—এই সকল অজ্ঞানবৃত্তি সৃষ্টি করিলেন।

আদিভূত-বৃত্তান্ত – দ্বিতীয় অধ্যায় - বরাহ পুরাণ

অনন্তর বৃক্ষলতাদি স্থাবর ও তাঁহার পর পশ্বাদি তিৰ্য্যাগযোনি সৃষ্ট হইল। কিন্তু প্ৰজাপতি ব্ৰহ্ম। তাহাদিগকে অধিক মনে করিয়া দেব, গন্ধৰ্ব, যক্ষ, রক্ষ, সিদ্ধ, চারণ প্রভৃতি উৰ্দ্ধচারিদিগকে সৃষ্টি করিলেন, পুনশ্চ তাহাদিগের দ্বারা অভীষ্টসিদ্ধি হইবে না দেখিয়া তিনি অন্যপ্রকার সৃষ্টির বিষয়ে চিন্তা করিতে লাগিলেন।

তাহাতে অর্বাকৃস্রোত মনুষ্যজাতির সৃষ্টি হয়। ইহাদের আহার সঞ্চার অধোভাগে হইয়া থাকে। ইহার রজোগুণ-প্রধান; সুতরাং ইহারা সর্বদা কৰ্ম্মতৎপর এবং বহুল দুঃখান্বিত। হে সুভাগে! এইত নয় প্রকার সৃষ্টির বিষয় তোমার নিকট বর্ণন করিলাম। তৎসমুদায়ের মধ্যে প্রথম মহৎ, দ্বিতীয় পঞ্চতন্মাত্ৰ; তৃতীয় বৈকারিক বা ঐতিদয়ক।

এই তিনটি প্রাকৃত সৃষ্টি; অনন্তর বৈকৃত সৃষ্টির বিষয় কহিতেছি, শ্ৰবণ কর। ধরণি! বৈকৃত সৃষ্টি পাঁচ প্রকার; মাথা, ম খ্য, ঈহারা স্থাবর নামে প্ৰসিদ্ধ,; তাঁহার পর তিৰ্য্যাকস্রোত।

তাঁহার পর উৰ্দ্ধস্রোত, ইহা সপ্তম সৃষ্টি : অষ্টম, অনুগ্রহ দৃঢ় স্টি; ইহা সাত্বিক ও তামসিক; নবম কৌমার সর্গ। দেবি! এইত প্ৰজাপতির নয় প্রকার সৃষ্টির বিসয় বর্ণনা করিলাম। এক্ষণে আর কি শ্রবণ করিতে ইচ্ছা কর?”

ধারণী কহিলেন, “অব্যক্ত জন্ম। ব্ৰহ্মার এই নয় প্রকার সৃষ্টি কি প্রকারে বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, এক্ষণে আপনি তাহা কীৰ্ত্তন করিয়া অনুগৃহীত করুন।”

বরাহদেব কহিলেন, “দেবি! কমল যোনি ব্ৰহ্মা কর্তৃক প্রথমে রুদ্রাদি তপোধনগণ; তাঁহার পর সনাক, সনন্দ, সনাতন ও সৎকুমার; তদনন্তর মরীচি, অত্ৰি, অঙ্গিরা, পুলহ, ক্রুতূ, পুলস্ত, ভৃগু, বশিষ্ঠ, দক্ষ, নারদ সৃষ্টি হইলেন। ব্রহ্মা সনক প্রভূতিকে নিবৃত্ত্যিাখ্য মার্গে এবং নারদকে মুক্ত করিয়া মরীচি প্ৰভৃতিকে প্ৰবৃত্তি ধৰ্ম্মে নিয়োগ করিলেন।

যিনি প্রজাপতির দক্ষিণাঙ্গুষ্ঠ হইতে উৎপন্ন, তিনিই আদি। প্রজাপতি; এই নিখিল জগৎ তাঁহারই বংশ। দেব, দানব, গন্ধৰ্ব্ব, উরাগ ও বিহগী সকলই প্ৰজাপতি দক্ষের কন্য। অদিতি হইতে উদ্ভূত; তাহারা সকলেই পরম ধাৰ্ম্মিক।

পারমেষ্ঠি পিতামহ ক্রুদ্ধ হইলে তাঁহার কুটিল ভ্রূকুটি-বিকৃত ললাট হইতে রুদ্র নামে যে পুত্ৰ উদ্ভূত হয়েন, তাঁহার অৰ্দ্ধাঙ্গ নর এবং অপরাদ্ধ নারী দেহ ;- দেখিতে অতি ভয়ঙ্কর। তাঁহার প্রকৃতি অতীব প্ৰচণ্ড। “নিজ দেহ বিভাগ করিয়া লও” তাহাকে এই কথা বলিয়া ব্ৰহ্মা পুনর্বার অন্তৰ্দ্ধান করিলেন।

তদনুসারে রুদ্র পুরুষ ও স্ত্রী অঙ্গ দ্বিধা বিভক্ত করিলেন; তাহাতে পুরুষ ও স্ত্রী দুইটী পৃথক পৃথক দেহ হইল। অনন্তর তিনি পুরুষ ভাগকে আবার একাদশ ভাগে বিভাগ করিলেন। ইহারা একাদশ রুদ্র নামে প্ৰসিদ্ধ। দেবি! এইত আমি রুদ্রসর্গ বর্ণন করিলাম। এক্ষণে অল্প কথায় যুগমাহাত্ম্য কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করা।

হে আনঘে! যুগ চারিটী–সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। সত্যযুগে যে সমস্ত দেব, অসুর ও রাজগণ প্রভূত দক্ষিণা দ্বারা যজ্ঞাদি ধর্ম্মকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, তাহাদের বিবরণ শ্রবণ কর। পূর্বকালে প্রথম কল্পে স্বয়ম্ভব মনু অবতীর্ণ হয়েন। তাঁহার দুই পুত্র;– প্রিয় ব্রত ও উদ্ভানপাদ। ইহরা উভয়েই তুল্য ধাৰ্ম্মিক ও দেবভক্ত।

জ্যেষ্ঠ প্ৰিয়ব্রত রাজা তপোবলসমন্বিত ও মহাযাজ্ঞিক ছিলেন। তিনি অগণ্য ভূরি-দক্ষিণ যজ্ঞদ্বারা যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণুর প্রীতিলাভ করিয়াছিলেন। তিনি ভরত প্ৰভৃতি স্বীয় পুত্ৰদিগকে সপ্তদ্বীপের সাম্রাজ্যে অভিষেক করিয়া বিশাল বরদায় গমনপূর্বক উৎকট তপস্যায় প্রবৃত্ত হয়েন।

“দেবি। রাজচক্ৰবৰ্ত্তী প্ৰিয়ত্ৰত এইরূপ কঠোর তাপশচরণ আরম্ভ করিলে দেবর্ষি নারদ ভঁাহার দর্শনাভিলাষে তথায় উপস্থিত হইলেন। রাজা প্ৰিয়ত্ৰত দেবর্ষিকে দিবাকরের ন্যায় দীপ্তমান তেজে আকাশপথ উদ্ভাসিত করিয়া আগমন করিতে দেখিয়া হৃষ্টান্তঃকরণে গাত্ৰোত্থান করিলেন এবং পাদ্যাদি দানে সৎকার করিয়া বসিতে আসন প্ৰদান করি।– লেন।

অনন্তর পরস্পারে পরস্পরের কুশল জিজ্ঞাসা করিলে রাজা প্ৰিয়ত্ৰত ব্ৰহ্মবাদী নারদকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভগবান! এই সত্যযুগে আপনি যদি কিছু আশ্চৰ্য্য দেখিয়া থাকেন, অনুগ্ৰহ করিয়া আমার নিকট তাহা বৰ্ণন করুন।”

নারদ কহিলেন, ‘প্ৰিয়ত্ৰত! আমি এক অতি আশ্চৰ্য্য ঘটনা দেখিয়াছি, তাহা শ্রবণ করা। গত পরশ্নদিবসে আমি শ্বেতাখ্যা দ্বীপে গমন করিয়াছিলাম; তথায় প্রফুল্ল কমলালঙ্কত এক বিশাল সরোবর দেখিতে পাইলাম। সেই সরোবর-তীরে এক বিশাললোচনা রমণী নয়নগোচর হইলেন।

তাহাকে দেখিয়া আমি বিস্মিত ও আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম এবং সেই মধুরভাষিণীকে মধুর কথায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “ভদ্ৰে! তুমি কে? কোথা হইতে এখানে আসিলে? এবং এখানে কি করিতেছ? তোমার অভিপ্ৰায় কি?” আমার এই কথা শ্রবণ করিয়া সেই অনবদ্যাঙ্গী কন্যা আমার প্রতি অনিমিষ-নিয়নে নিরীক্ষণ করিয়া নীরবে বাWয়। রহিলেন।

তাহাকে নির্বাক অবস্থায় অবস্থিতি করিতে দেখিয়া আমারু স্মৃতিশক্তি সহসা বিলুপ্ত হইল; আমি সকল দেব, সমস্ত যোগ, শিক্ষা, বেদ ও স্মৃতি প্রভৃতি সমুদায়ই ভুলিয়া গেলাম।

কি আশ্চৰ্য্য! মুহূৰ্ত্তের মধ্যে সেই কুমারী আমার সমস্ত জ্ঞান হরণ করিলেন! আমি বিস্মিত, স্তম্ভিত ও শোকাকুল হইলাম; এবং তাঁহার শরণাপন্ন হইয়া যেমন তাঁহার প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলাম, অমনি তদীয় শরীরে এক দিব্য পুরুষকে দেখিতে পাইলাম; সেই পুরুষের হৃদয়ে অপর একটি পুরুষ এবং ইহার বক্ষে আবার দ্বাদশাদিত্যের ন্যায় শ্ৰী সম্পন্ন একটা রক্ত নেত্ৰ পুরুষ দৃষ্ট হইলেন।

রাজেন্দ্ৰ! সেই কন্যাশরীরে সেই পুরুষত্ৰয় দেখিয়া আমি অতিশয় বিস্মিত হইলাম, এবং ক্ষণপারে তাঁহার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিবামাত্ৰ দেখিলাম সেই কুমারী এক রহিয়াছেন; কিন্তু সেই পুরুষত্ৰয়াকে আর দেখিতে পাইলাম না।

তখন আমি সেই কন্যাকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম “ভদ্ৰে! আমার স্মৃতিশক্তি হঠাৎ কেন বিলুপ্ত হইল; তাঁহার কারণ আমার নিকট প্ৰকাশ কর। ”

আদিভূত-বৃত্তান্ত – দ্বিতীয় অধ্যায় - বরাহ পুরাণ

কন্যা কহিলেন, “আমি সমস্ত বেদের জননী; – নাম সাবিত্রী। তুমি আমাকে জাননী বলিয়া তোমার বেদজ্ঞান হরণ করিয়া লইয়াছি।” তাঁহার এই কথা শুনিয়া যারপরনাই বিস্মিত হইলাম এবং সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করিলাম, “শোভনে! তোমার দেহে সেই যে পুরুষত্ৰয় দৃষ্ট হইলেন, তাহার। কে?”

কন্যা কহিলেন, “সেই যে রমণীয় বিগ্ৰহধারী সর্বাঙ্গপান পারুল আমার শরীরে অবস্থিতি করিতেছিলেন, তিনি সাক্ষা, ৎ নারায়ণস্বরূপ ঋগ্বেদ; তাঁহাকে উচ্চারণ করিবামাত্র লোকের পাপ তৎক্ষণাৎ দগ্ধ হইয়া যায়।

তাঁহার হৃদয়ে আত্মজরূপে যিনি বিরাজ করিতেছিলেন, তিনি সর্বশক্তিমান সাক্ষাৎ ব্ৰহ্মা; তিনিই যজুর্বেদ, এবং তাঁহার বক্ষে আবার মিমি আসীন ছিলেন, সেই জ্বলন্ত অনলসদৃশ কান্তিবিশিষ্ট পুরুষ স্বয়ং রুন্দ্রিরূপী সামবেদ। ইনি আদিতোর নায় সকল পাপ ধ্বংস করিয়া থাকেন।

এই সেই মহাবেদত্ৰয় ত্ৰিগুণাত্মক বিষ্ণু, ব্ৰহ্মা ও শিবারূপে বিরাজ করিতেছেন। এই অ্যাকারাদি বর্ণমালা এবং বাচনসমূহ। এক্ষণে তোমার স্মৃতিশক্তি পুনরুদ্রিক্ত হইল, তুমি ত্ৰিবেদ ও সর্বশাস্ত্র এবং তোমার সর্বজ্ঞাত্ব পুন গ্রহণ করিয়া এই বেদ-সরোবরে স্নান কর, তাহা হইলেই তোমার জন্মান্তরীয় কথা মনে পড়িবে।

এই কথা বলিয়। বেদমাতা সাবিত্রী অন্তদ্ধান করিলেন। অতঃপর আমি সেই বেদসরোবরে সুন্নান করিয়া তোমার সাহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি।”

আরও পড়ুনঃ

বেতাল-ভৈরব বংশকীৰ্ত্তন – কালিকা পুরাণ

বরাহ পুরাণ

Leave a Comment