আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় জগদ্বন্ধু আবির্ভাব – বৃন্দাবন বৃত্তান্ত
জগদ্বন্ধু আবির্ভাব – বৃন্দাবন বৃত্তান্ত
জগদ্বন্ধু আবির্ভাব – বৃন্দাবন বৃত্তান্ত
প্রায় সওয়াশ বছর আগের কথা। বৃন্দাবনে এক তরুণ সাধক এসেছেন। একদিন তিনি তাঁর এক প্রিয় শিষ্যকে ডেকে বললেন, “দেখুন, আগামীকাল মধ্যাহ্নে একজন মহাপুরুষ দেহরক্ষা করবেন। এজন্য প্রাতঃকাল থেকে তাঁকে ঘিরে সংকীর্তনের ব্যবস্থা করুন।” মহাপুরুষটির পরিচয় জানতে চাইলে তিনি এক বিশাল তেঁতুল গাছ দেখিয়ে বললেন, “ইনিই সেই মহাপুরুষ।
” তরুণ সাধকের বাক্যের প্রতি শিষ্যদের বিশ্বাস ছিল প্রবল। তাঁরা ঐ বৃক্ষকে ঘিরে অষ্টপ্রহর নামকীর্তনের ব্যবস্থা করলেন। পরদিন মধ্যাহ্নে সত্যি দেখা গেল, ঝড়-বৃষ্টি কোথাও কিছু নেই, ভক্তদের কীর্তন পরিক্রমার মধ্যে গাছটি হঠাৎ মড়মড় শব্দে ভেঙ্গে পড়ল। ‘বৃক্ষ মহাপুরুষ’ সম্বন্ধে তরুণ সাধকের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হওয়ায় তিনি বৃন্দাবনে সুপরিচিত হয়ে উঠলেন।
এই তরুণ সাধকই হলেন পরবর্তীকালের প্রভু জগদ্বন্ধু। মুর্শিদাবাদ জেলার ডাহাপাড়া গ্রামে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ১৭ মে প্রভু জগদ্বন্ধু আবির্ভূত হন। পিতা দীননাথ চক্রবর্তী, মাতা বামাদেবী। দীননাথ চক্রবর্তী (ন্যায়রত্ন) শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। অধ্যাপনার বৃত্তি অবলম্বন করে তিনি মুর্শিদাবাদের এ অঞ্চলে এসে বাস করেন। তাঁর আদি নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার কোমরপুর গ্রামে।
স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কুল বিগ্রহ রাধা-গোবিন্দের সেবাপূজা করতেন। ‘জগৎ’ তাদের তৃতীয় সন্তান । মুর্শিদাবাদে স্বর্ণময়ীর প্রাসাদে এসেছেন এক সন্ন্যাসী। ভবিষ্যতের শুভা শুভ জানার জন্য বহুলোক সেখানে উপস্থিত। এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত তাঁর ছেলের ঠিকুজিখানা সন্ন্যাসীকে দেখাতে ছিলেন। সন্ন্যাসী বললেন, “আমি ভাল করেই সব দেখলাম।
এই ঠিকুজি যাঁর তাঁকে একবার আমাকে দেখাতে পারেন?” পণ্ডিত দীননাথ চক্রবর্তী বাড়ি ফিরে শিশু জগদ্বন্ধুকে কোলে করে সন্ন্যাসীর নিকট এলেন। সন্ন্যাসী পরম শ্রদ্ধাভরে শিশুটিকে মাথায় তুলে নিয়ে বললেন, “এই বালকের চরণ মাথায় ছোঁয়াতে পেরে কৃতার্থ হলাম। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ও লক্ষ্মণজীর জন্মের সময় যে পাঁচটি গ্রহের যোগ হয়েছিল, এ শিশুর জন্মলগ্নেও দেখলাম সেই লক্ষণ। এ যে রাজা হবে।
” উত্তরে জগদ্বন্ধুর পিতা বললেন, “সাধুজী মাপ করবেন। আমি একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ ; আমার ছেলে কি করে রাজা হবে?” মৃদু হেসে সন্ন্যাসী বললেন, “ভোগের রাজা নয়, যোগের রাজা।” সন্ন্যাসীর ভবিষ্যদ্বাণী শুনে দীননাথ মনে মনে আনন্দিত হয়ে পুত্রকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।
শৈশবেই ‘জগৎ’ মাকে হারালেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর দীননাথ মুর্শিদাবাদ থেকে ফিরে এলেন নিজের গ্রামে ফরিদপুর জেলার গোবিন্দপুরে। মাতৃহারা জগতের লালন-পালনের ভার নিলেন তাঁর জেঠতুতো বোন দিগম্বরী। পাঁচ বছর বয়সে জগদ্বন্ধুকে হাতে খড়ি দেওয়ার পর পিতা দীননাথ ন্যায়রত্ন পরলোকগমন করলেন। এর কয়েক মাসের মধ্যে পদ্মার ভাঙনে গোবিন্দপুরের বাড়িটি তলিয়ে যায়।
তখন ফরিদপুর শহরের নিকটে ব্রাহ্মণকান্দায় চক্রবর্তী পরিবার এসে বসবাস করতে থাকেন। প্রথমে গ্রামের পাঠশালাতেই জগদ্বন্ধুর লেখাপড়া শুরু হয়। তারপর নদীয়া জেলার আলমপুর গ্রামের স্কুলে। সেখান থেকে ফরিদপুরের বাংলা স্কুলে এবং পরে জেলা স্কুলে জগদ্বন্ধু পড়াশুনা করেন। এরপর পাবনা ও রাচিতে পড়াশুনা করে জগদ্বন্ধু এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর পরীক্ষা দেওয়া হয় নি।
জগদ্বন্ধু নিজে হরিনামে পাগল, পাবনায় এসে তিনি তাঁর মনের মত এক সঙ্গী পেলেন আর এক পাগলকে। লোকে সেই পাগলকে ডাকত হারান ক্ষ্যাপা বলে। জগদ্বন্ধুকে দেখেই হারা ক্ষ্যাপা ‘জগারে জগা’ বলে নাচতে লাগলেন। জগদ্বন্ধু ক্ষ্যাপাকে বলতেন, ‘বুড়ো শিব’। আর ক্ষ্যাপা ও জগদ্বন্ধু সম্বন্ধে বলতেন, “জগা মানুষ নয়, সাক্ষাৎ গোরা; জগা রাজা, আর সবাই প্রজা।” দেখতে দেখতে জগদ্বন্ধুর মহিমা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল ।
জগদ্বন্ধুর হরিনামে মেতে উঠলেন। তিনি ফরিদপুরে ব্রাহ্মণকান্দার বাড়িতে এসে হরিনাম প্রচার করতে আরম্ভ করলেন। বাকচর, বদরপুর প্রভৃতি স্থান হল তাঁর হরিনাম প্রচারের ক্ষেত্র। তিনি কীর্তনের দল গঠন করলেন। তাঁর ভক্তের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে লাগল। ভক্তরা আর ‘জগৎ’ বলে না, বলে প্রভু জগদ্বন্ধু। এই নামের মধ্যেই যেন তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।
তিনি জগতের বন্ধু । সকলকেই তিনি বন্ধুর মত ভালবাসতেন। তাঁর দৃষ্টিতে মানুষের মধ্যে বড়-ছোট ভেদ ছিল না।
জগদ্বন্ধু তীর্থ ভ্রমণে বের হলেন। তীর্থে তীর্থে গ্রামে গ্রামে হরিনাম বিলিয়ে তিনি এসে উপস্থিত হলেন বৃন্দাবনে। গভীর সাধনায় রত হলেন তিনি। ব্রজের ধূলিতে গড়াগড়ি দিয়ে তাঁর প্রাণ রাধারাণীর কৃপার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
আবার কখনও তিনি গভীর আকুতিতে অশ্রুধারায় বক্ষ ভাসিয়ে রাধাকুণ্ডের তীরে তীরে পরিক্রমা করছেন। ভক্তের আর্তিতে ইষ্ট তুষ্ট হলেন। পরম আরাধ্যা মহাভাবময়ী রাধারাণীর দর্শন মিলল। সাধক জগদ্বন্ধু হতচেতন হয়ে পড়লেন। জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি ধীরে ধীরে লিখলেন-
“জয় রাধে ধর্ম, জয় রাধে জয়
জয় রাধে কর্ম, জয় রাধে জয়।”
রাধারাণীর কৃপা পাওয়ার পর জগদ্বন্ধুর জীবনে এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দেয়। তাঁর কণ্ঠে আর কখনও রাধা নাম উচ্চারিত হয় নি। রাধা নাম শুনলেও তাঁর দেহে প্রেম বিকার সৃষ্টি হতো। তাই তিনি রাধা নাম এড়িয়ে চলতেন।
আরও দেখুন :