আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র।
Table of Contents
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ১
বাংলা ১২৯৫ সালের ৩০শে ভাদ্র পাবনা জেলার হিমাইতপুর গ্রামে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। এটা তাঁর মাতুলালয় । পিতৃ-নিবাস পাবনা জেলার শুয়াখাড়া গ্রাম । অনুকূলচন্দ্রের পিতার নাম শিবচন্দ্র চক্রবর্তী অনুকূলচন্দ্রের জন্মের এক বছর পরই পতিপুত্রহীনা অসহায় শাশুড়ির অনুরোধে তিনি শুয়াখাড়া থেকে হিমাইতপুর চলে আসেন।
অনুকূলচন্দ্রের জননী মনোমোহিনী দেবী ছিলেন একজন পতিপ্রাণা সতীসাধ্বী রমণী। শৈশবেই তিনি অলৌকিকভাবে সিদ্ধি করেছিলেন। তিনি সুদূর আগ্রার সন্তু সদ্গুরু শ্রীশ্রীহুজুর মহারাজের কৃপা লাভ করেছিলেন। এই মহারাজেরই শিষ্য সরকার সাহেবের নির্দেশে জননী মনোমোহিনী দেবী অনুকূলচন্দ্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষা দান করেন।
উত্তাল পদ্মার মত অপরিমেয় প্রাণ শক্তির অধিকারী অনুকূলচন্দ্র শৈশব থেকেই অনন্যসাধারণ। তাঁর দুরন্তপনার অবধি ছিল না। দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হলেও তাঁর হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিবেশীরা শাসন করতে ভুলে যেতেন। কিন্তু তাঁর ওপর মায়ের শাসন ছিল নির্মম ।
“মাতৃভক্তি অটুটু যত, সেই ছেলে হয় কৃতী তত।
পিতায় শ্রদ্ধা মায়ে টান, সেই ছেলে হয় সাম্য প্রাণ।”
পরিণত বয়সে উচ্চারিত ঠাকুর অনুকূল এই বাণী অনুকূলচন্দ্রের জীবনে সার্থক রূপ পেয়েছিল। মা- বাবার মুখে হাসি ফোটাতে সকল কষ্টই তিনি অকাতরে সইতে পারতেন। পিতা-মাতার প্রতি ছিল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। তেমনি ভক্তি করতেন তাঁর শিক্ষকবৃন্দকে। ভালবাসতেন তাঁর সহপাঠী সঙ্গী- সাথীদের। ক্লাসের ছেলেরা তাঁকে কেউ বলতেন ‘প্রভু’, আবার কেউ আর একধাপ এগিয়ে বলতেন “অনুকূল আমাদের রাজা ভাই।”

পাবনা ইন্স্টিটিউটে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর অনুকূলচন্দ্র নৈহাটী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য মনোনীত হন। কিন্তু সে পরীক্ষা দেওয়া আর তাঁর ভাগ্যে ঘটেনি। একজন সহপাঠী পরীক্ষার ফিসের টাকা যোগাড় করতে পারেনি দেখে ব্যথিত অনুকূলচন্দ্র নিজের টাকাটা তাকে দিয়ে দেন। মায়ের ইচ্ছা পূরণের জন্য এর পর তিনি কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যালে-এ ভর্তি হন। বাড়িতে পিতা অসুস্থ, সংসারে দারিদ্র্যের কালো ছায়া।
প্রতি মাসে বাড়ি থেকে যে সামান্য টাকা আসত তাতে তাঁর কলকাতার লেখাপড়া ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যয় নির্বাহ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ত। কয়লার গুদামের কুলিদের সাথে এক কষ্টকর পরিবেশে একই ঘরে তাঁকে থাকতে হত। আহার্য কখনও জুটত, কখনও রাস্তার পাশের কল থেকে পেটভরে জল খেয়ে কাটাতে হত । নিতান্ত আর্থিক কষ্টের মধ্যেও অনুকূলচন্দ্রের ছিল মধুর অমায়িক ব্যবহার।
তাঁর হৃদয়-লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে প্রতিবেশী ডাক্তার হেমন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় ওষুধ সহ একটি ডাক্তারি বাক্স তাঁকে উপহার দেন। অনুকূলচন্দ্র ঐ ওষুধ দিয়েই শুরু করলেন কুলিমজুরদের সেবা। সেবার আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে যে যৎসামান্য প্রাপ্তিযোগ ঘটতে থাকে, তাতেই ক্রমে তাঁর অর্থকষ্টের অবসান হয়। ডাক্তার হয়ে অনুকূলচন্দ্র কলকাতা থেকে স্বগ্রামে ফিরে আসেন।
হিমাইতপুরেই চিকিৎসক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এ জীবনে তাঁর অভূতপূর্ব সাফল্য আসে, কি চিকিৎসায়, কি অর্থাগমে। কিন্তু তাঁর কথা—
“চিকিৎসাতে চাস যদি তুই, আত্মপ্রাসাদ টাকা ।
টাকার পানে না তাকিয়ে, রোগীর পানে তাকা।”
রোগের চিকিৎসার মধ্য দিয়ে মানুষের বিচিত্র বেদনার সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় ঘটল। তিনি বুঝলেন,মানুষের দুঃখের স্থায়ী নিবারণ করতে হলে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক এই তিন রকম রোগেরই চিকিৎসার দরকার। তিনি মানসিক ব্যাধির চিকিৎসা শুরু করলেন।
সারাংশ
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বাংলা ১২৯৫ সালে পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তার জীবন অগ্রসর হয়। গ্রহণ করেন চিকিৎসা-পেশা ।
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ২
চন্দ্রের কিরণ যেমন জাতি-ধর্ম, ধনী-দরিদ্র ভেদ করে না বরং সমভাবে সকলের ওপর বর্ষিত হয়- ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের প্রেমও তেমনি হিন্দু, মুসলমান, ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড় প্রত্যেকের প্রতিই সমভাবে বর্ষিত হয়েছে। অনুকূলচন্দ্র ভাবলেন, পরিবেশের প্রভাব মানবজীবনে অপরিসীম। উন্নত পরিবেশ, আধ্যাত্মিক সমাবেশ যে-কোন ব্যক্তির জীবন-পট পাল্টে দিতে পারে।
তাই আত্মিক উন্নয়নের জন্য অনুকূলচন্দ্ৰ সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে এক কীর্তনের দল গড়ে তোলেন। প্রথম দিকে প্রতাপপুরের কিশোরীমোহনের বাড়িতে কীর্তনের আসর বসত। ধীরে ধীরে কীর্তনানন্দে গ্রাম পরিক্রমা শুরু হল। কীর্তনের এক পর্যায়ে মাঝে মাঝে অনুকূলচন্দ্র হঠাৎ ভাব-সমাধিতে মগ্ন হয়ে যেতেন। তিনি বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়তেন।
দেহে প্রাণের চিহ্ন পর্যন্ত লোপ পাবার মত হত-মুখ দিব্যজ্যোতিতে উদ্ভাসিত হত, আর মুখ থেকে ধীরে ধীরে উদাত্ত স্বরে বিভিন্ন ভাষায় বাণী উচ্চারিত হত। এরূপ একাত্তর দিনের বাণী সংকলনে সৃষ্টি হয়েছে ‘পুণ্যপুঁথি’ নামক অমূল্য গ্রন্থ। তখন থেকে সমাগত ব্যক্তিগণ তাঁকে ডাক্তার না বলে ‘ঠাকুর’ বলে সম্বোধন করতে থাকেন। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের এই দিব্য মহিমার কথা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
বাল্যসাথী অনন্তনাথ রায়, কিশোরীমোহন দাস এবং সতীশচন্দ্র গোস্বামী এই সময় ঠাকুরকে গুরু হিসেবে গ্রহণ করেন। এঁরা হলেন ঠাকুরের কীর্তন যুগের সাথী। ঠাকুরের উপলব্ধিতে এল কীর্তন মানুষের মনকে ওপরের স্তরে নিয়ে যায় বটে, কিন্তু সে অবস্থায় বেশি সময় ধরে রাখতে পারে না। মনের স্থায়ী উন্নয়ন ঘটাতে হলে চাই সৎনাম স্মরণ। আর সেজন্য দীক্ষা একান্ত আবশ্যক।
শুরু হল সনাম প্রচারের মহিমান্বিত অধ্যায়। ভক্ত ও অনুরাগীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। শ্রীশ্রীঠাকুরের নাম ও প্রেমের জোয়ারে পদ্মার দক্ষিণ তীরে কুষ্টিয়ার বুকেও ঢেউ জাগে। ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের বিশিষ্ট ভক্ত ডা. গোকুলচন্দ্র মণ্ডল, বীরেন্দ্র নাথ রায় ও অশ্বিনী কুমার বিশ্বাসের চেষ্টায় ১৩২৫ সালে কুষ্টিয়া শহরে প্রথম শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মতিথি পালনের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
সেই মহামহোৎসবে নানা স্থান থেকে বহু লোক এসে যোগদান করেন এবং শ্রীশ্রীঠাকুরকে গুরুপদে বরণ করেন । “সৎ -এ সংযুক্তির সহিত তদ্গতি সম্পন্ন যাঁরা- তাঁরাই” সৎসঙ্গী আর তাঁদের মিলন ক্ষেত্রই হল সৎসঙ্গ। প্রতিষ্ঠানরূপে সৎসঙ্গ ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারিভাবে রেজিস্ট্রীকৃত হয়। সৎসঙ্গের প্রথম সভানেত্রী হলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের জননী মনোমোহনী দেবী।
সেখানে শুরু হল মানুষ তৈরির আবাদ, কর্মের মাধ্যমে যোগ্যতর মানুষ গড়াই এর লক্ষ্য। হিমাইতপুর গড়ে উঠল ধর্ম-কর্মের অপূর্ব সমন্বয়ে সৎসঙ্গ আশ্রম। শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, সুবিবাহ অস্তিত্বের এই চার স্তরের অভিব্যক্তি। আশ্রমে নানা ধরনের কর্মমুখী শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। প্রাচীন ঋষিদের তপোবনের নবতর সংস্করণ যেন।
ব্রহ্মচর্য-গার্হস্থ-বানপ্রস্থ-সন্ন্যাস সনাতন আর্য জীবনের এই চারটি স্তরই সৎসঙ্গ আশ্রম-ভূমিতে এক সামঞ্জস্যপূর্ণ যুগোপযোগী রূপ লাভ করে। ধর্মের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন বাঁচা-বাড়ার বিজ্ঞানই হচ্ছে ধর্ম। নিজেকে বাঁচাতে হবে, বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে অন্যের বাঁচা বাড়াও যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেদিকেও নজর দিতে হবে। কথাটি ছড়ার সুরে বললেন-
“অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে, ধর্ম ব’লে জানিস তাকে।
বাঁচা-বাড়ার মর্ম যা ঠিকই জেনো ধর্ম তা।”

প্রতিটি জীবের মধ্যেই আছে বেঁচে থাকা এবং বেড়ে ওঠার আকুতি। এই বাঁচা বাড়ার অনুকূলে যা কিছু সেটাই তার অনুসরণীয় ও গ্রহণীয়। তার প্রতিকূল যা তার সবই বর্জনীয়। শ্রীশ্রীঠাকুরের মতে ধর্ম এক, বহু নয়। তিনি বলেছেন—
“ধর্মে সবাই বাঁচে বাড়ে, সম্প্রদায়টা ধর্ম না-রে।”
“ঈশ্বর এক, ধর্ম এক, প্রেরিত পুরুষগণ এক বার্তাবাহী।”
দেশ-কাল পাত্রের গণ্ডিতে মানুষের মাঝে যে কৃষ্টিগত পার্থক্য, সেটা ধর্মের বাহ্যিক বা আনুষ্ঠানিক দিক। আর প্রকৃত মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধনে আত্মিক উন্নয়নের যে সাধনা, সেটা তার শাশ্বত দিক। মানুষের মধ্যে ঐক্য ঘটাতে হলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আনুষ্ঠানিক পার্থক্যের প্রতি সহিষ্ণু হতে হবে এবং প্রত্যেকের জন্য শাশ্বত মানবতার সাধনায় আত্মনিয়োগের সুযোগকে অবাধ করে তুলতে হবে।
‘সৎসঙ্গ’ কি চায়? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ঠাকুর বলেছেন, “সৎসঙ্গ চায় মানুষ। সে চায় একটা পরম রাষ্ট্রিক সমবায়, যাতে কারও সৎসংবর্ধনায় এতটুকুও ত্রুটি না থাকে। প্রত্যেকে এ দুনিয়ার বুকে পরস্পর সহযোগিতায় সার্থক হতে পারে, অবাধ হয়ে চলতে পারে।” সংসঙ্গের বিভিন্ন প্রচেষ্টার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষ তৈরি করা। যোগ্যতর মানুষ না এলে পৃথিবীর দৈন্য দৈন্যই থেকে যাবে।
শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রণীত সত্যানুসরণ, চলার সাথী, নানা প্রসঙ্গে, কথা প্রসঙ্গে, ইসলাম প্রসঙ্গে, বিবাহ বিধায়না, শিক্ষা বিধায়না, নিষ্ঠা বিধায়না, বিজ্ঞান বিভূতি, সমাজ সন্দীপনা, আর্য কৃষ্টি প্রভৃতি গ্রন্থে তাঁর মহৎ আদর্শ প্রতিফলিত। ১৩৭৬ সনের ১২ই মাঘ তারিখে ৮১ বছর বয়সে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র মহাপ্রয়াণ করেন।
সারাংশ
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আধ্যাত্মিক চিন্তা অনেককে আকর্ষণ করে। অনেকেই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষা হচ্ছে এই মনের স্থায়ী উন্নয়ন ঘটাতে হলে চাই সনাম স্মরণ এবং দক্ষতা। তাই সৎ-এ সংযুক্তির সঙ্গে তদগতি-সম্পন্ন যাঁ তাঁরাই সৎসঙ্গী।
আর তাদের মিলন- ক্ষেত্রই সৎসঙ্গ । সৎসঙ্গের মূল লক্ষ্য মানুষ তৈরি করা। যোগ্যতর মানুষ না এলে পৃথিবীর দৈন্য কাটবে না। এ সৎসঙ্গের প্রতিষ্ঠাতা ঠাকুর শ্রী অনুকূলচন্দ্রের সত্যানুসরণ, চলার সাথী প্রভৃতি গ্রন্থে তার শিখায় পরিচয় রয়েছে।
আরও দেখুন :