দেবীতন্ত্র কালিকা – কালিকা পুরাণ

অষ্টপঞ্চাশ অধ্যায় – দেবীতন্ত্র কালিকা :  ভগবান্ বলিলেন;–এক্ষণে আমি দেবীর তন্ত্র বলিতেছি, তোমরা দুইজনে শ্রবণ কর, যে তন্ত্রানুসারে আরাধিতা হইয়া দেবী অচিরকাল মধ্যেই বর প্রদান করেন। ১

এই তন্ত্র অপর তন্ত্রসকল হইতে বিশেষ এবং শ্রেষ্ঠ; পূর্বে আমি তোমাদের নিকট ইহা সামান্যাকারে কীৰ্ত্তন করিয়াছি, এক্ষণে বিশেষরূপে বলিতেছি। ২

দেবীর পূজা ও জপকাৰ্যে যে সকল বিশেষ তন্ত্র অবশিষ্ট আছে, আমি পুনরায় সেই সকলের কীৰ্ত্তন করিব। ৩

যে মনুষ্য একাগ্র-মানস হইয়া মহামায়াতে ভক্তি করে, অঙ্গ ও অঙ্গমন্ত্র দ্বারা সে এই শ্রেষ্ঠ কাৰ্য্য করিবে। ৪

ফল, পুষ্প, তাম্বুল, অন্ন ও পানাদি যে কিছু খাদ্য বস্তু-মহাদেবীকে উৎসর্গ করিয়া না দিয়া কখনই উহা ভোজন করিবে না। ৫

সাধক, পথেই থাকুক, আর পৰ্ব্বতের অগ্ৰেই থাকুক বা সভামধ্যেই অবস্থান করুক,–যেখানে সেখানেই থাকুক–ভোজ্যবস্তু দেবীকে দিয়াই আপনাকে সমর্থ বলিয়া বিবেচনা করিবে। ৬

মদিরাভাণ্ড, রক্তবর্ণ স্ত্রী, সিংহ, শব, রক্তপদ্ম, ব্যাঘ্র ও হস্তীসঙ্গম (বা রণ সঙ্গম), গুরু এবং রাজা ইহাদিগকে দেখিয়া মহামায়াকে নমস্কার করিবে। ৭

দেবীতন্ত্র কালিকা - কালিকা পুরাণ

চণ্ডিকার ধ্যান করিয়া বিভূতির নিমিত্ত সৰ্ব্বদাই পতিব্রতা ভাৰ্যার ঋতু রক্ষা করিবে। ৮

দেবীতন্ত্র কালিকা – কালিকা পুরাণ

যখন কেহ কোনরূপ শান্তিপৌষ্টিক অথবা পূৰ্ত কৰ্ম্ম করিবে, তখন উহা দেবীকে সমর্পণ করিয়া উৎসব করিবে। ৯

যখন তৌৰ্যত্রিক অর্থাৎ নৃত্য গীত শ্রবণ করিবে, তখন উহা দেবীকে নিবেদন করিয়াই নিজে উপভোগ করিবে। ১০

যে কোন অলঙ্কার, বস্ত্র অথবা চন্দন, আপনার শরীরে ধারণ করিবে, ঐ ধারণ করিবার সময় মনে মনে মন্ত্রের ন্যাস করিবে। ১১

ব্যায়ামেই হউক, বিধানেই হউক, সভাতেই হউক, জলেই হউক, আর স্থলেই হউক–যেখানেই গমন করুন না কেন, গমন করিবার সময় দেবীকে স্মরণ করিবে। ১২

পূজাকালে যে সকল কার্য্যের আবশ্যক হয়, মন্ত্ৰ পূৰ্বেই সে সকলের অনুষ্ঠান করিবে। পূজনের অঙ্গীভূত কৰ্ম্ম যদি মন্ত্রহীন হয় তবে উহা নিষ্ফল হয়। ১৩

হে ভৈরব! পূজার অঙ্গীভূত কোন কর্মে যদি মন্ত্র উক্ত না হইয়া থাকে, তাহা হইলে নৈবেদ্যালোকনমন্ত্র দ্বারা উহার অনুষ্ঠান করিবে। ১৪

ইষ্টমন্ত্র দ্বারা উহার মণ্ডলে দেবীর ন্যাস করিবে, পূজার অবসান হইলে ঐ মণ্ডল মুছিয়া উহা দ্বারা তিলক করিবে। ১৫-১৬

বলিদানে ধর্মকামার্থদায়ী সৰ্ববশ্য মন্ত্রদ্বারা বলিচ্ছেদ করিয়া খড়্গস্থ রুধির দ্বারা ঐ সৰ্ববশ্য মন্ত্র দ্বারা নিজের ললাটে তিলক করিবে। ১৭

এইরূপ তিলক ধারণ করিলে জগৎ তাহার বশীভূত হয়; কবর্গের চতুর্থ বর্ণ, বহ্নি, ষষ্ঠ স্বর অর্ধ চন্দ্র ও বিন্দুযুক্ত, উপান্ত এইরূপ ককারান্ত, উপান্তের পরবর্ণও ঐরূপ, উহা নির্মোহী (দ্বিমোহী) টকারের চতুর্থ বর্ণ স্বরদ্বয় যুক্ত তৃতীয় বর্ণ প্রান্তে যার, এইরূপ তৃতীয় স্বরে অন্তে পূরিত, হইয়া দ্বিরাবর্ত এবং ব হইতে চতুর্থ বর্ণ দ্বিতীয় স্বর, তাহার পর পুর সহিত ক্ষোভ শব্দ এইরূপ মন্ত্র মিত্র, শত্রু, রাক্ষস, যক্ষ, প্রজা এবং রাজারূপে স্মৃত হইয়াছে। ১৮-২১

যদি মনুষ্য পূজা না করিয়াও এই মন্ত্র পাঠ করিয়া সর্বদা তিলক করে, তাহা হইলে সকল বস্তু তাহার বশীভূত হয়। ২২

রাজা, রাজপুত্র, স্ত্রী, যক্ষ, রাক্ষস এবং চতুৰ্বিধ ভূতযোনি-ইহারা সকলে সর্বদা তাহার বশীভূত হয়। ২৩।

প্রবাসে, পথে, দুর্গম স্থানে, স্থানের অলাভে, জলে, কারাগারে, নিরুদ্ধাবস্থায় এবং প্রায়োপবেশনে অবস্থায় জ্ঞানী মনুষ্য মহামায়ার মানসী পূজা করিবে। ২৪-২৫

কোনরূপ মনের প্রীতি উৎপন্ন হইলে, সিংহব্যাঘ্র-সমাকুলস্থানে, কিংবা পরচক্ৰ মধ্যে গমন করিয়া মানস পূজা করিবে। ২৬

মনে মনে হৃদয়ের মধ্যে যোগপীঠের ধ্যান করিয়া সেই যোগপীঠেই পৃথিবী মধ্যে পূজার অনুষ্ঠান করিবে। ২৭

মৈত্র অর্থাৎ পুরীষত্যাগ, প্রসাধন, স্নান, দন্তধাবন এবং অন্যান্য শুদ্ধিকারক কৰ্ম্ম সকল মনে মনে সম্পাদন করিয়া পূজা করিবে। ২৮

পুষ্পাদিদ্বারা যেরূপ রীতিতে বাহ্যিক পূজার অনুষ্ঠান করা হয়, মানসিক পূজাতেও সেই সমুদয় রীতির অনুসরণ কর্তব্য। ২৯

সাধক, প্রতি অষ্টমীতেই দেবীর পূজা করিবে এবং নবমীর দিবস আপনার শোণিতদ্বারা দেবীর পূজা করিবে। ৩০

কোনরূপ লিঙ্গ, পুস্তক বা স্থণ্ডিলস্থিত মহামায়ার পূজা করিবে, তাহার পাদুকাদ্বয় বা প্রতিমা কল্পনা করিয়া তাহাতে তাঁহার পূজা করিবে। ৩১

খড়্গ বা ত্ৰিশিখ–চিত্রিত করিয়া তাহাতে দেবীর পূজা করিবে, অথবা জলে দেবীর পূজা করিবে। খড়্গ পঞ্চদশাঙ্গুলি পরিমিত এবং ত্ৰিশিখ বলিতে ত্রিশূল বুঝিতে হইবে। ৩২

মনুষ্য-ভক্তি ও শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া শিলায়, পৰ্ব্বতের অগ্রভাগে, পৰ্ব্বতের গুহায়, নিত্য দেবীর পূজা করিবে। ৩৩

বারাণসীতে দেবীর আরাধনা করিলে সম্পূর্ণ ফললাভ হয়, আর পুরুষোত্তমের নিকট পূজা করিলে তাহা অপেক্ষাও দ্বিগুণ ফল হয়। ৩৪

বিশেষতঃ দ্বারাবতীতে পূজা করিলে পূৰ্ব্বাপেক্ষাও দ্বিগুণ ফল হয়। নিখিলক্ষেত্রে ও তীর্থে পূজা করিলে দ্বারাবতীর সমান ফল হয়। ৩৫

বিদ্ধ্যাচলে দেবীর পূজা করিলে শতগুণ ফললাভ হয়, গঙ্গাতীরেও ঐরূপ আর্যাবর্তের মধ্যদেশে এবং ব্রহ্মাবর্তে পূজা করিলেও উক্তরূপ ফললাভ হয়। ৩৬

বিন্ধ্যাচলে পূজা করিলে যেরূপ ফল, প্রয়াগ ও পুষ্করে পূজা করিলেও সেই রূপ ফল লাভ হয়। কিন্তু করতোয়া নদীর জলে পূজা করিলে উহা অপেক্ষাও চতুর্গুণ ফল হয়। ৩৭।

হে ভৈরব! নন্দীকুণ্ডে পূজা করিলে পূৰ্ব্বাপেক্ষাও চতুর্গুণ ফল লাভ হয়। চন্দ্রশেখরসমীপে তাহা হইতেও চতুর্গুণ ফল লাভ হয়। ৩৮

সেই স্থানে সিদ্ধেশ্বরীযোনিতে পূজা করিলে উহা অপেক্ষাও দ্বিগুণ ফল হয় এবং লৌহিত্য নদের জলে উহা অপেক্ষাও চতুর্গুণ ফল হয়। ৩১

কামরূপে জলেই হউক, আর স্থলেই হউক, যেখানে পূজা করিবে, উক্তরূপ ফল লাভ হইবে। বিষ্ণু যেরূপ সকলের শ্রেষ্ঠ, লক্ষ্মী যেমন সকলের উত্তম, কামরূপ দেব-মন্দিরে পূজাও সেইরূপ প্রশস্ত। ৪০

কামরূপ–দেবীর সাক্ষাৎ ক্ষেত্র, তাহার তুল্য স্থান আর নাই। অন্যত্র দেবী দুর্লভা, কিন্তু কামরূপে প্রতিগৃহেই বিরাজমান। নীলকূট পৰ্ব্বতের মস্তকে পূজা করিলে তাহা অপেক্ষা শতগুণ ফল হয়। ৪১-৪২

হেরুক নামক শিবলিঙ্গে পূজা করিলে তাহা অপেক্ষাও দ্বিগুণ ফল হয়। শৈলপুত্ৰাদি যোনিতে পূজা করিলে পূৰ্ব্বাপেক্ষা দ্বিগুণ ফল হয়। ৪৩।

কামাখ্যাযোনিতে পূজা করিলে তদপেক্ষাও শতগুণ ফল লাভ হয়। যে মনুষ্য, কা-মাখ্যায় একবার মহামায়ার পূজা করে, সে ইহলোকে সমুদয় অভিলষিত অর্থ এবং পরকালে শিব-সাদৃশ্য প্রাপ্ত হয়। তাহার সদৃশ আর কেহ নাই এবং তাহার কোন কৃত্যও নাই। ৪৪-৪৫

সে দীর্ঘায়ু হইয়া ইহলোকে বাঞ্ছিত অর্থ সকল লাভ করিতে থাকে। তাহার গতি অন্য কর্তৃক অবারিত এবং বায়ুসদৃশ হয়। ৪৬

সে স্বয়ং যুদ্ধে ও শাস্ত্রের তর্কে অজেয় হয়। বৈষ্ণব তন্ত্রমন্ত্র দ্বারা কামাখ্যার যোনিমণ্ডলে একবারমাত্র পূজা করিয়া শত গুণ ফল লাভ করে। জগন্ময়ী যোগনিদ্রা মহামায়া মূল-মূর্তিস্বরূপ। ৪৭-৪৮

বৈষ্ণবী তন্ত্র, তাহার মন্ত্র ইহা পূৰ্বেই প্রতিপাদিত হইয়াছে। শৈলপুত্রী আদি সমুদয় ইহারই মূর্তিভেদ। ৪৯

দেবীতন্ত্র কালিকা - কালিকা পুরাণ

ইহার শরীর হইতে বিনির্গত অংশ স্বরূপ। সূৰ্যবিম্ব হইতে যেরূপ কিরণ নির্গত হয়, সেইরূপ উগ্রচণ্ডাদি দেবীসকল মহামায়ার শরীর হইতে নির্গত হইয়াছে। তাহাদের অঙ্গমন্ত্র আমি তোমাকে বলিব। ৫০-৫১

এক মহামায়াই আপনার ইচ্ছায় নানারূপ ধারণ করিয়াছেন। কা-মাখ্যাই মহামায়া এবং মূল মূর্তি বলিয়া কীর্তিত হন। ৫২

ঐ মহামায়ার ভিন্ন ভিন্ন পীঠেও ভিন্ন ভিন্ন ক্রিয়া কীর্তিত হইয়াছে। এই রূপ বিষ্ণু নিত্য বলিয়া সনাতন নামে অভিহিত হন। ৫৩

জনদিগের অর্দন (পীড়ন) করেন বলিয়া তিনিই জনার্দন নামে অভিহিত হন। সেইরূপ এই মহামায়া লোকের অভিলাষ পূরণার্থ পৰ্বতে সঙ্গত দেব এবং মনুষ্যগণ কর্তৃক কা-মাখ্যা নামে অভিহিত হন। ৫৪

যেমন কোন মহাপুরুষ হাতে ছত্র গ্রহণ করিলে লোক তাহাকে ছত্রী বলে, এবং তিনিই স্নানকালে স্নাপক নামে অভিহিত হন, কা-মাখ্যানামও সেইরূপ। ৫৫

কামপুরণার্থ মহামায়ার শরীরই কা-মাখ্যারূপে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইনি কামকালে খড়্গত্যাগ করিয়া কামার্থ নিবেদিত লোহিত কুঙ্কুমদ্বারা পীতবর্ণ মালা স্বয়ং গ্রহণ করেন। যখন কাম পূর্ণ হয়, তখন ইনি পুনর্বার খড়গ গ্রহণ করেন। ৫৬-৫৭

কামকালে সিত প্রেতে বিন্যস্ত লোহিত পঙ্কজে রমণ করেন এবং কাম পরিত্যাগ করিয়া প্রেতরূপ শিবের উপর বিরাজ করেন। ৫৮

এইরূপ ইনি সিংহস্থ হইয়া ইতস্ততঃ বিচরণপূর্বক কাম প্রদান করেন। কখন সিতপ্রেতে, আর কখন বা রক্ত-পঙ্কজে অবস্থান করেন। ইনি কামরূপিণী কখন কেশরীপৃষ্ঠে বিরাজ করেন। ৫৯

পূজাকালে ইনি কখন প্রেত, কখন পদ্ম, কখন সিংহের উপর স্থিত হন, তখন অন্যকে দেখে থাকেন। যখন তিনি মহামায়া স্বরূপে বর্তমান, তখন তিনি বরদা হন। ৬০-৬১

যখন ইহাকে রক্ত পদ্মে অবস্থিত ধ্যান করিবে, তখন ইহার অগ্রে হরিকে চিন্তা করিবে এবং যখন ইহাকে সিংহস্থিত করিবে, তখন অগ্রে ব্ৰহ্মা এবং শিবের চিন্তা করিবে। ৬২

এককালে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব এই তিনের ধ্যান করিলে ক্ৰমে পদ্ম সিংহে গমন করেন, এই তিন মুর্তি সন্নিহিত থাকিলে সেই কামদাদেবী আরও কাম দায়িনী হন। ৬৩

ইঁহাদের এক একটিতেও শিবাকে যথাবৎ চিন্তা করিবে। তিনি একাই সমস্ত জগতের প্রকৃতি এবং স্থাপন-কর্ত্রী। ৬৪

সেই জগন্ময়ী শিবা ব্ৰহ্মা বিষ্ণু এবং শিব কর্তৃক ধৃত হইয়াছেন। মহাদেবই সিত-প্রেত, ব্রহ্মাই লোহিত পঙ্কজ। ৬৫

বিষ্ণুই সিংহ, এই তিনজনই সেই মহাতেজোময়ী দেবীর বাহন। তাঁহাদের স্ব স্ব মূর্তিতে বাহন হওয়া যুক্তিসিদ্ধ নয়। ৬৬

তাহারা অন্যমূর্তি ধারণ করিয়া দেবীর বাহন প্রাপ্ত হইয়াছেন। মহামায়া শিবা যে যে মূর্তিতে প্রীতিলাভ করেন। ৬৭

ঐ তিনজন সেই সেইরূপে বাহন প্রাপ্ত হইয়াছেন। সিংহের উপর রক্তপদ্ম, তদুপরি শিব। ৬৮

তাহার উপর অবস্থিত মহামায়া–বর এবং অভয় প্রদান করেন। যে সাধক এইরূপ মূর্তির ধ্যান করিয়া পূজা করে। তৎকর্তৃক ব্ৰহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর পূজিত হন, সে বিষয়ে কোন সংশয় নাই। মহামায়া এবং কা-মাখ্যা এক। ৬৯-৭০

দেবীতন্ত্র কালিকা - কালিকা পুরাণ

তথাপি ধ্যানে স্বরূপে ভিন্ন, এই নিমিত্ত কামরূপেই কামাখ্যার পূজা করিবে। দুর্গার বিশেষ তন্ত্র তোমাদের নিকট কীৰ্তন করিলাম, এক্ষণে হে ভৈরব! অঙ্গ মন্ত্র সকল শ্রবণ কর। ৭১

অষ্টপঞ্চাশ অধ্যায় সমাপ্ত। ৫৮

আরও পড়ুনঃ

শিবের অন্তর হইতে মায়ার অপসারণ ও শিবের তপস্যা – কালিকা পুরাণ

পুরাণ (ভারতীয় শাস্ত্র)

Leave a Comment