নারদের উপদেশে চন্দ্রশেখরের আত্ম-সাক্ষাৎকার – কালিকা পুরাণ

পঞ্চাশ অধ্যায় – নারদের উপদেশে চন্দ্রশেখরের আত্মসাক্ষাৎকার

ঔর্ব কহিলেন,–কিছুকালের পর আবার সেই সৰ্বাঙ্গসুন্দরী সর্বালঙ্কার ভূষিতা তারাবতী, রম্ভাদি দিব্য বারাঙ্গনাপরিবৃত ইন্দ্রাণীর ন্যায় রূপলাবণ্য সম্পন্ন শতাধিক পরিচারিকার সহিত ঋতুস্নান করিবার নিমিত্ত দৃষদ্বতী নদীতে গমন করিলেন। ১-২

এই নদীর জলরাশি–অতিশয় শীতল, নির্মল এবং সম্যক্ নীলবর্ণ; বিদ্যুতাকৃতি গৌরাঙ্গী দেবী তারাবতী যে সময় সেই নদীর জলে নামিলেন। ৩

হিরন্ময়ী প্রতিমা, প্রতিবিম্বের দ্বারা কাঁচময় স্থানকে যেরূপ উদ্ভাসিত করে, সেইরূপ তিনিও স্বীয় অঙ্গপ্রভায় দিক সকল উজ্জ্বল করিয়াছিলেন। ৪

এই সময় কাপোত মুনি, জলনিমগ্না চারুরূপা তারাবতীকে দেখিলেন। ৫

তৎকালে চিত্রাঙ্গদাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,(চিত্রাঙ্গদে!) যিনি এই সৃষদ্বতী নদীতে স্নান করিতেছেন, ইনি কে? ৬

ইহার সৌন্দৰ্যরাশি অবলোকন করিলে সাক্ষাৎ লক্ষ্মী বলিয়া বোধ হয়; ইনি কি পৰ্ব্বতরাজপুত্রী অপর্ণা? যেহেতু ইনি স্বর্গীয় জ্যোতিতে সর্বদা পরিপূর্ণ, তুমি কেন ইহার প্রশংসা করিতেছ না। ৭

নারদের উপদেশে চন্দ্রশেখরের আত্ম-সাক্ষাৎকার - কালিকা পুরাণ

নারদের উপদেশে চন্দ্রশেখরের আত্ম-সাক্ষাৎকার – কালিকা পুরাণ

তখন পতিব্রতা চিত্রাঙ্গদা ঋষির এই সকল কথা শুনিয়া, পাছে ঋষি শাপ প্রদান করেন, এই ভয়ে প্রশংসাপূর্বক তাহার পরিচয় দিতে লাগিলেন। ৮

হে মুনিসত্তম! ইনি ককুৎস্থের কন্যা, ইঁহার নাম তারাবতী, এই দেবী চন্দ্রশেখর নামক ভূপতির প্রিয়ভাৰ্য্যা। ৯

পূর্বে আপনি এই সুন্দরী রমণীর প্রতি বিশেষ অনুরাগী হইয়াছিলেন, কিন্তু ইনি আমাকেই নিজের নানালঙ্কারে ভূষিত করিয়া আপনার শ্রীচরণে অর্পণপূর্বক গৃহে গমন করেন। ১০

ইনি আমার সেই জ্যেষ্ঠা ভগিনী, পুনৰ্বার এই নদীতে স্নান করিতে আসিয়াছেন। হে দ্বিজোত্তম! আপনার ইহহাকে কিছু বলা উচিত নয়। ১১

আপনি এইখানেই থাকুন, যদি যাইতে অনুমতি করেন ত, প্রিয়জ্যেষ্ঠ। ভগিনীর সহিত আলাপ করিয়া পরে আপনার নিকট আগমন করি। ১২

তখন সেই কাপোত মুনি চিত্রাঙ্গদার নিকট সেই সকল বাক্য শ্রবণ করিয়া তারাবতীর পূর্বকৃত প্রতারণা জানিতে পারিলেন, পরে তদ্বিষয়ে অসহিষ্ণু হইয়া তারাবতীর প্রতি যৎপরনাস্তি কুপিত হইলেন এবং কহিতে লাগিলেন। ১৩

এই পাপীয়সীই আমাকে সেই সময় বঞ্চনা করিয়াছিল, আচ্ছা অদ্যই আমি ইহার প্রতিশোধ লইব। ১৪

মুনি এই কথা বলিয়া যেখানে তারাবতী ছিলেন, চিত্রাঙ্গদার সহিত সেইখানে গমন করিলেন। ১৫

তখন কাপোত মুনি, তথায় গমন করিয়া ক্রোধবিজৃম্ভিত হাস্য করিয়া তারাবতীকে কহিতে লাগিলেন। ১৬।

পূৰ্বে তোমাকে আমি উপভোগের নিমিত্ত প্রার্থনা করিয়াছিলাম, কিন্তু তুমি ছলনা করিয়া আমাকে বঞ্চনা করিয়াছ; অতএব হে দুঃসাহসিকে! তুমি শীঘ্রই ইহার ফলভোগ করিবে। ১৭

রে পাপিনি! আমারই সম্মুখে তুই সতী বলিয়া আত্মশ্লাঘা করিতেছিস এবং আমাকে সতীত্ব-ধর্মনাশক বলিয়া আমার প্রতি অনুরক্তা হও নাই। ১৮

অতএব আমি বলিতেছি, বীভৎসবেশধারী, বিরূপ, ধনহীন, নরকপালশোভী পলিৎকেশ কোন ব্যক্তি তোকে হঠাৎ গ্রহণ করিবে। ১৯

হে পাংশুলে! অদ্য হইতে এক বৎসরের ভিতর তোর গর্ভে সদ্যঃ দুইটি পুত্ৰ উৎপন্ন হইবে। তাহাদিগের সৌন্দৰ্য কিছুমাত্র লক্ষিত হইবে না; প্রত্যুত মুখগুলি বানরের ন্যায় হইবে। ২০।

দেবী তারাবতী, কাপোত মুনির এই সকল বাক্য শ্রবণে কোপ ও ভয় নিবন্ধন স্ফুরিতাধরোষ্ঠে তখন মুনিকে কহিতে লাগিলেন। ২১

হে দ্বিজসত্তম! যদি চণ্ডী-আরাধনা করিয়া মাতা আমাকে প্রাপ্ত হইয়া থাকেন, আর মহারাজ চন্দ্রশেখরের উপর যদি আমার অবিচলিত ভক্তি থাকে, আর যদি আমি বাস্তবিক ককুৎস্থের কন্যা হই, তবে নিশ্চয়ই দেবতা ব্যতিরেকে অন্য কেহই আমাকে ইচ্ছা করিবেন না। ২২-২৩

আমি সত্য সত্যই যদি মহাদেবকে অহরহঃ পূজা করিয়া থাকি, হে নর শার্দূল! সেই সত্য-প্রভাবেই আমার সেব্য শিব ব্যতিরেকে অন্য কোন দেব তাই আমাকে স্বপ্নেও অভিলাষ করিবেন না। ২৪

এই কথা বলিয়া পতিব্রতা দেবী তারাবতী ঋষিকে নমস্কারপূর্বক কুপিত হইয়া নিজগৃহে গমন করিলেন। ২৫

 

তখন কাপোত মুনি মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, এই তেজস্বিনী নারী আমার সম্মুখেই নির্ভয়ে নিজের অহঙ্কার প্রকাশ করিল। ২৬

অতএব বোধ হয় ইহার ভিতর কোন নিগূঢ় ও বিশুদ্ধ কারণ থাকিবে। ২৭

এই ভাবিয়া মুনি ধ্যানস্থ হইলেন। পরে দিব্যজ্ঞানবলে পূৰ্ববৃত্তান্ত সকল জানিতে পারিলেন। ২৮

পূর্বকালে ভৃঙ্গী মহাকালনামক দুইটি পুত্র দেবী কর্তৃক শাপগ্রস্ত হন, পরে আবার দুইজন হর-পাৰ্বতীকে প্রতিশাপ প্রদান করেন। ২৯

যে জন্য এই দুইজন যেরূপে মনুষ্যযোনি প্রাপ্ত হইয়াছেন এবং দেবকন্যা চিত্রাঙ্গদাও যেজন্য যেরূপে উৎপন্ন হইয়াছেন, কাপোত ঋষি দিব্যজ্ঞানদ্বারা এই সকল বৃত্তান্ত অবগত হইয়া আর কিছুই করিলেন না। ৩০

পরে চিত্রাঙ্গদাকে সাদর সম্ভাষণে ডাকিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। বাটীতে যাইয়া ব্রাহ্মণ কাপোত ঋষি চিত্রাঙ্গদাকে যথাবিধি সৎকার করিলেন। ৩১

এদিকে তারাবতী স্বস্থানে আসিয়াই ভূপতি চন্দ্রশেখরের নিকট কুপিত হইয়া মুনিশাপের আমূল বৃত্তান্ত সবিস্তারে বর্ণনা করিলেন। ৩২

সেই পৌষ্যজ রাজা, তারাবতীর এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া অন্তরে কিছু চিন্তিত হইলেন; কিন্তু চিন্তিত হইলেও তৎক্ষণাৎ প্রিয় পত্নীকে আশ্বাস প্রদান করিলেন। ৩৩

পতিসেবা, সৰ্ব্বদা ধৰ্ম্মানুষ্ঠান, অসৎসঙ্গপরিবর্জন–এই সকল শুভকর্মদ্বারা মুনিশাপ অপনীত হয়। ৩৪

দেবী ভাগ্যবতী তুমি প্রশস্ত প্রশস্ত ব্ৰতাদির অনুষ্ঠান করিয়া থাক, সুতরাং তুমি দেবতাদিগের কল্যাণভাগিনী; অতএব তোমার বিপদ কখনই হইবে না। ৩৫

করবীরপুরাধিপতি রাজা চন্দ্রশেখর, তারাবতীকে এই সকল কথা কহিয়া তখন তাহার বাসার্থ বিশ্বকৰ্ম্মা দ্বারা তাহার মনোমত একটি অট্টালিকা প্রস্তুত করাইলেন। ৩৬

নারদের উপদেশে চন্দ্রশেখরের আত্ম-সাক্ষাৎকার - কালিকা পুরাণ

ইহার দৈর্ঘ্য চারিশত ব্যাম (বাঁও), বিস্তার ত্রিশ ব্যাম। ৩৭

তলদেশটি রাশি রাশি স্ফটিক দ্বারা নির্মিত; তাহার আবার নানাস্থান শ্বেত রক্ত পীত নীল প্রভৃতি নানাবর্ণের বহুতর রত্ন দ্বারা খচিত; সেই মনোহর প্রাসাদ–শুক্লবর্ণপ্রবাল-নিচয়ে আচ্ছাদিত। ৩৮।

স্তম্ভগুলি রত্নাদিদ্বারা সংগঠিত, বিশ্বকর্মার দ্বারা নির্মিত। রাজা তারাবতীর রক্ষার জন্য এরূপ প্রিয় অট্টালিকা প্রস্তুত করাইলেন। ৩৯

সোপানশ্রেণী রত্নপ্রবালাদি দ্বারা প্রস্তুত এবং পুঞ্জ পুঞ্জ বড়ভী প্রবালময়, সুতরাং সৌন্দৰ্য্যদ্বারা সেই অট্টালিকা–স্বর্গীয় পরম রমণীয় দেবসভার নিকট কোন ক্রমেই ন্যূন নহে। ৪০

রাজা চন্দ্রশেখর, বিশ্বস্ত পুরুষ দ্বারা সেই অট্টালিকা মধ্যে স্বাদু সুকোমল সমস্ত ভোজ্যবস্তু পাঠাইয়া দিতেন। ৪১

রাজা, প্রত্যহ সেই প্রাসাদোপরি আরোহণ করিয়া দেবী তারাবতীর সহিত ক্রীড়া করিতেন। ৪২

এক বৎসর কাল এই অট্টালিকায় তারাবতীকে রাখিলেন; যে পর্যন্ত তারাবতী তথায় বাস করিয়াছিলেন, তাবৎকাল অট্টালিকার দ্বারগুলি প্রহরি বৈষ্টিত হইয়া সাধারণের যাতায়াত বন্ধ করিয়াছিল। ৪৩

কোন সময়ে সুন্দরহাসিনী তারাবতী, করবীরাধিপতি-বিযুক্ত হইয়া একাকী এই বৃহৎ অট্টালিকায় উপবেশনপূর্বক তদগতচিত্তে ভর্তা চন্দ্রশেখরকে চিন্তা করিতেছেন। ৪৪

সেই সময় পতিব্রতা সাবিত্রীর ন্যায় পতিপদে মন রাখিয়া পার্বতীপার্শ্বস্থ মহনীয় মহাদেবকে চিন্তা করিলেন। ৪৫

তাহার পর আবার ইষ্টদেবীকে চিন্তা করিলেন। পুনৰ্বার বৃষভবাহন ত্র্যম্বক চন্দ্রশেখরকে ধ্যান করিলেন। এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে তাহার হৃদয়ে স্বামী চন্দ্রশেখর এবং ভগবান চন্দ্রশেখরের পার্থক্য উপলব্ধি হইল না। ৪৬

যখন এইরূপে দেবী তারাবতী দেবসভার মধ্যস্থিত নানালঙ্কার-ভূষিত ইন্দ্রাণীর ন্যায় প্রাসাদোপরি চিন্তিতান্তঃকরণে বসিয়াছিলেন। এমন সময়ে মহাদেব ভগবতীর সহিত আকাশমার্গের দ্বারা সেই প্রাসাদে আগমন করিলেন। ৪৭-৪৮

তিনি আসিয়া গুণ-বাহুল্যে ভগবতী-সদৃশ সমস্ত লক্ষণাক্রান্ত নারায়ণের লক্ষ্মীস্বরূপ রাজপত্নীকে দেখিলেন। ৪৯

শিব তারাবতীকে দেখিয়া দেবী গৌরীকে প্রফুল্লচিত্তে ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন। ৫০

প্রিয়ে। এই যে তারাবতীকে দেখিতেছ, এইটি তোমার মানুষীমূর্তি, যাহা ভৃঙ্গী ও মহাকালের জন্মের জন্য তুমি নিজেই গ্রহণ করিয়াছ। ৫১

আমার আর অন্য স্ত্রী নাই। তোমা ভিন্ন অন্য স্ত্রীসংসর্গে আমার উৎসাহ হয় না। হে ভামিনি! এইক্ষণে তুমি স্বয়ং এই মূর্তিতে প্রবেশ কর। ৫২

প্রবেশ করিলে তোমার মানুষী মূর্তির গর্ভে ভৃঙ্গী ও মহাকাল পুত্রদ্বয় উৎপাদন করিব। ৫৩

দেবী কহিতে লাগিলেন;–হে বৃষভকেতন। আমারই এই মানুষীমূর্তি, আপনার অনুমতিক্রমে এই মূর্তিতে প্রবেশ করি–আপনি পুত্রদ্বয় উৎপাদিত করুন। ৫৪

তাহা হইলে আমার ভৃঙ্গী ও মহাকাল কাপোতের অভিশাপ হইতে মুক্ত হইবেন। হে পার্বতীনাথ! আপনি আমার এই প্রিয়কাৰ্যটি করুন। ৫৫

নারদের উপদেশে চন্দ্রশেখরের আত্ম-সাক্ষাৎকার - কালিকা পুরাণ

ঔর্ব কহিতে লাগিলেন,–তাহার পর স্বয়ং ভগবতী তারাবতীর দেহে প্রবেশ করিলেন, মহাদেবও উপভোগের নিমিত্ত তাহার নিকট উপস্থিত হইলেন। ৫৬

অনন্তর দেবীভাবাপন্ন পতিব্রতা দেবী তারাবতী, মহাদেবকে রমণেচ্ছু জানিয়া স্বয়ংই তাহার সমীপে গমন করিলেন। ৫৭

সেই সময় ভগবান ভবানীপতি কপালী অস্থিমাল্যধারী বীভৎস-বেশ, দুর্গন্ধ দেহ, জরাজীর্ণ অতিবিরূপ হইয়া তারাবতীতে উপগত হইলেন। ৬৮

হে নরশার্দূল! তাহাদিগের পরস্পরের রতি-ক্রীড়া সমাপ্ত হইলে সদ্যই তারাবতীর গর্ভে বানরমুখ দুইটি পুত্র উৎপন্ন হইল। পুত্র দুইটি জন্মিলে ভগবতী, তারাবতীর দেহ হইতে নিঃসৃত হইলেন। ৫৯

তখন মনুভাবাপন্ন তারাবতীর আত্মা মোহপূর্ণ হওয়ায় তিনি জানিতে পারিলেন না যে, আমি গৌরী আর ইনি মহেশ্বর। ৬০

অনন্তর তেজস্বিনী দেবী তারাবতী, পুত্রদ্বয়কে ভূমিষ্ঠ দেখিয়া এবং সম্মুখীন বীভৎসবেশধারী মহেশকে অবলোকন করিয়া আপনাকে ভ্রষ্টা বিবেচনাপূর্বক তখন পূৰ্বদত্ত মুনিশাপকে কালপ্রাপ্ত অন্তকের ন্যায় বিবেচনা করিলেন। ৬১-৬২

তখন শোকগ্রস্তা তারাবতী সতীব্রতকে নিন্দা করিতে লাগিলেন এবং ত্রিশূলধারী মহাদেবকে দেখিয়া কহিলেন,–পূর্বতন পণ্ডিতেরা সর্বদাই কহিয়া থাকেন যে, নারীদিগের সতীব্রত-মুনিব্রতাপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। ৬৩-৬৪

কিন্তু আমার আজ এরূপ হওয়ায় আমি মুনিদিপের সেই কথাটি সত্য বলিয়া বিবেচনা করিলাম না। এই সকল কথা কহিয়া তিনি শোক করিতে লাগিলেন এবং মোহ প্ৰাপ্তও হইলেন। ৬৫

তখন মহাদেব তাহাকে কহিলেন,হে বরাননে! তুমি শোক করিও না, সতীব্রতকে নিন্দা করিও না। ৬৬

হে চৈতন্যশালিনি। যে সময় তুমি কাপোত ঋষি-কর্তৃক শাপগ্রস্ত হইলে, হে বিশালাক্ষি। সেই সময়েই তাহারই সম্মুখে–এক্ষণে যেটি তোমার ঘটিল, সেইটিই কহিয়াছিলে। ৬৭

যথা—“হে মুনিশার্দূল! যদি আমি নিত্য মহাদেবের আরাধনা করিয়া থাকি, সেই সত্যবলেই আমার আরাধ্য চন্দ্রশেখর দেবতা ভিন্ন অন্য কেহ স্বপ্নেও আমাকে অভিলাষ করিবেন না।” ৬৮

অতএব অবলে। আমি সেই আরাধ্য মহাদেব চন্দ্রশেখর, আমা কর্তৃকই তুমি উপভুক্ত হইয়াছ, অতএব শোক করিও না। এই কথা বলিয়াই মহাদেব অতর্হিত হইলেন। ৬৯

তখন পতিব্রতা দেবী তারাবতী মায়ামোহিত হইয়া শোকনিবন্ধন মলিন বেশে মৃত্তিকায় বসিয়া রহিলেন। ৭০

পুত্রদ্বয় ভূমিতে পড়িয়া রহিল, তথাপি তিনি সে বিষয়ে ভ্রূক্ষেপও করিলেন না। কেবল আলুলায়িতকেশে প্রতিক্ষণ ভর্তার আগমন প্রার্থনা করিতে লাগিলেন; মহাদেবের বাক্যে কিছুমাত্র আদর প্রকাশ করিলেন না। ৭১

অনন্তর কিছুকাল বিলম্বে মহারাজ চন্দ্রশেখর তারাবতীকে দেখিবার নিমিত্ত প্রাসাদপৃষ্ঠে আগমন করিলেন। ৭২

তখন তথায় যাইয়া দেখেন, তারাবতী নিরানন্দে মলিনবদনে আলুলায়িত কেশে ভূমে পড়িয়া আছেন আর আর্তনাদ ও সত্যের নিন্দা করিতেছেন এবং চন্দ্রসূৰ্য-সদৃশ বানর-মুখ পুত্র দুইটিও পড়িয়া আছে এবং বৃষের পদচিহ্নও দেখিতে পাইলেন। ৭৩-৭৪

তখন মহারাজ চন্দ্রশেখর, এই সকল দেখিয়া ও বিস্মিত হইয়া সসম্ভ্রমে ভাৰ্য্যাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তারাবতি! নির্জনগৃহে তোমার কি কি ঘটনা হইয়াছে। শৃগাল সিংহীকে আক্রমণ করিলে যেরূপ হয়, সেইরূপ তোমাকে কে আক্ৰমণ করিয়াছিল? ৭৫-৭৬।

আর বানরমুখ প্রদীপ্ত পুত্র দুইটি বা কাহার?-তুমি শীঘ্র আমাকে বল, অপর কোন ব্যক্তি তোমার কামনায় এইখানে আসিয়াছিল। ৭৭

ঔর্ব কহিলেন, তখন পতিব্রতা তারাবতী ভূপকর্তৃক এইরূপ পৃষ্ট হইলে তাহাকে সকল বৃত্তান্ত কহিলেন। ৭৮

এবং মহাদেব যেমন করিয়া আসিয়াছিলেন এবং পরেও যে সকল কথা বলেন, সেই সকল কথাও সজল নয়নে ও গদগদম্বরে ভর্তার নিকট নিবেদন করিলেন। ৭৯

মহারাজ চন্দ্রশেখর তাহার এই সকল বাক্য শ্রবণ করিয়া যেরূপ ঘটনা হইয়াছে, সেইটী জানিবার জন্য চিন্তিত হইয়া ভূতলে উপবিষ্ট হইলেন। ৮০

তিনি মনে মনে চিন্তা করিয়া এই ধারণা করিলেন, মহাদেবের ভাৰ্যান্তর নাই, তিনি পাৰ্বতী ভিন্ন অন্য স্ত্রীকে আকাঙ্ক্ষাও করেন না; এরূপ না হইলেও তিনি পরমেশ্বর হইতেন না। ৮১

অতএব এ ঘটনায় ঋষিশাপই বলবান, সেই শাপবলেই মায়াবী কোন রাক্ষস শঙ্করের মূর্তি ধারণ করিয়া এইখানে আসিয়াছিল। ৮২

এক্ষণে আমার প্রিয়পতিব্রতা ভাৰ্য্যা রাক্ষসসংস্পর্শে পাপিষ্ঠ হইয়াছে, আমি পূর্ববৎ সকল কর্মে কিরূপে ইহাকে গ্রহণ করি? ৮৩

আর তাহার সদ্যোজাত এই দুইটি শিশু নিশ্চয়ই রাক্ষস, তাহা না হইলে ইহাদিগের মুখ বানরের ন্যায় হইবে কেন? ৮৪

যখন রাজা চন্দ্রশেখর এইরূপ চিন্তা করিতেছেন, সেই সময় সরস্বতী, দেবতাগণ কর্তৃক নিযুক্ত হইয়া আকাশ হইতে রাজা চন্দ্রশেখরকে এই সকল কথা বলিলেন। ৮৫

“হে মহারাজ। তারাবতীর প্রতি আপনার সন্দেহ করা উচিত কাৰ্য নয়, সত্য সত্যই মহাদেব আপনার ভাৰ্যার নিকট আসিয়াছিলেন। ৮৬

এই দুইটি পুত্র মহাদেবেরই; মহারাজ! এক্ষণে আপনি ইহাদিগকে রক্ষা করুন, এ বিষয়ে যে সংশয় থাকে, পরে নারদ তাহা ভঞ্জন করিবেন।” ৮৭

বাগদেবী মধুর-বচনে রাজাকে সন্তুষ্ট করিয়া তৎক্ষণেই অন্তর্হিত হইলেন। তখন রাজা ভাৰ্যার প্রতি বিশ্বস্ত হইয়া তাহাকে আশ্বাসিত করিলেন। ৮৮

তিনি মহাদেবের পুত্র দুইটি যথাবিধি সংস্কার করিয়া নারদের শুভাগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। ৮৯

অনন্তর দেবর্ষি নারদ, রাজভবনে উপস্থিত হইলে পর রাজা চন্দ্রশেখর অত্যন্ত অভ্যর্থনাপুৰ্ব্বক তাহাকে আনিলেন এবং সস্ত্রীক যথাবিধি তাহার পূজা করিয়া ইন্দ্রভবনসদৃশ নিরুপম আপনার উচ্চ অট্টালিকায় তাহাকে বসাইলেন। ৯০-৯১

তিনি সস্ত্রীক নির্জনে তাহাকে সেই সকল পূৰ্ববৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিলেন। ৯২

হে দ্বিজোত্তম। আপনি ব্রহ্মার পুত্র, আপনি আমার বাটী আসিয়াছেন, সুতরাং আমি অনুগৃহীত হইলাম এবং সম্যক্ প্রীতিলাভ করিলাম। ৯৩

হে ব্ৰহ্মন্! হৃদয়ে আমার একটি সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে; আপনার তাহা খণ্ডন করিতে হইবে। যেহেতু আপনি ভিন্ন আমার এ সন্দেহ ভঞ্জন করিতে পারেন, এরূপ ব্যক্তি কোথাও নাই। ৯৪

আমার এই পতিব্রতা পত্নী তারাবতী, কাপোত ঋষির অভিসম্পাতে, বীভৎসবেশ বিরূপ মৃগচর্মধারী কোন পুরুষকর্তৃক উপভুক্তা হন এবং তাহারই ঔরসে সদ্যোজাত পুত্র দুইটি জন্মগ্রহণ করিয়াছে। অতএব এবিষয়ে আমার হৃদয়ে সর্বদাই দুরপনের সংশয় উপস্থিত হইয়া আছে। ৯৫

তাহার কারণ, গিরিজা ভিন্ন মহাদেবের আর দ্বিতীয় পত্নী নাই, আর তিনি কেনই বা নীচ কুলোদ্ভব মানুষীর সংসর্গ করিবেন এবং কি নিমিত্তই বা তিনি মানুষীর গর্ভে আপনার আত্মজদ্বয় উৎপাদন করিবেন? এ সকল বিষয় যদি আপনার বলিতে কোন বাধা না থাকে, তবে আমাকে বলুন। ৯৭

ঔর্ব কহিলেন,–তখন মুনিবর নারদ, এইরূপে চন্দ্রশেখরকর্তৃক জিজ্ঞাসিত হইয়া এই সকল কথা তাহাকে কহিলেন। ৯৮

পূর্বকালে ভৃঙ্গী ও মহাকাল নামক দুইটি মহাদেবের অনুচর, পার্বতীকর্তৃক অভিশপ্ত হন এবং তাঁহারাও আবার পাৰ্বতীকে অভিশাপ প্রদান করেন, তাহাতেই মহাদেব এই চন্দ্রশেখর নামে পৌষ্যের পুত্র হইয়া জন্মগ্রহণ করেন এবং গৌরীও ককুৎস্থের গৃহে তারাবতী নামে কন্যা হইয়া জন্মগ্রহণ করিলেন। ৯৯-১০১

নারদ চন্দ্রশেখরকে এই সকল কথা বলিয়া আর একটি সুন্দর উপাখ্যান কহিতে লাগিলেন। মহাদেব, ভগবতীকে যখন কালী (কৃষ্ণাঙ্গী) বলিয়া আহ্বান করেন, তখন পৰ্বতরাজপুত্রী উমা শঙ্করের অনাদর-বাক্যে নিজে গৌরাঙ্গী হইবার জন্য তপশ্চরণে প্রবৃত্তা হইলে মহাদেব, তাহাকে হিমালয়ে প্রেরণ করিলেন। ১০২-১০৩

পার্বতী তপস্যার নিমিত্ত হিমালয়ে গমন করিলে, বিরহবিধুর মহাদেব তখন কৈলাস পর্বত ত্যাগ করিয়া সুমেরুশৈল-শিখরে গমন করিলেন। ১০৪

তথায় যোনিদ্রাভূত বৃষধ্বজ, মীনধ্বজের শরবিদ্ধ হইয়া ভগবতী ব্যতিরেকে কিছুমাত্র সুখী হন নাই। ১০৫

কোন সময়ে উমাকান্ত, সৰ্বগুণসম্পন্না রূপলাবণ্যে ভগবতীর তুল্য সাবিত্রীকে হিমালয় শৃঙ্গে ভ্রমণ করিতে দেখিয়া মায়া-মুগ্ধ প্রাকৃত মনুষ্যের ন্যায় স্মর-শরে জর্জরিত হইলেন। ১০৬

তখন পাৰ্ব্বতী-ভ্রমে সাবিত্রীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে করিতে বলিলেন; হে শুভে পাৰ্বতি! আমার নিকট এস, আমি তোমার বিরহে নিতান্ত কাতর হইয়াছি, আর কন্দর্প, পূর্ববৈর-নির্যাতনাভিপ্রায়ে আমাকে বড়ই ক্লেশ দিতেছে; হে প্রিয়ে! এক্ষণে তুমি আমার বিপদের প্রতীকার বিধান কর। ১০৮-১০৯

এত অনুনয় বিনয়ের পরও যখন দেখিলেন, সাবিত্রী–তাঁহাকে পশ্চাৎ করিয়াই চলিয়া যান, তখন তিনি তাহার স্কন্ধে এক হস্ত প্রদান করিলেন। ১১০

তদনন্তর সাবিত্রী ক্রোধপূর্বক তাহার দিকে ফিরিয়া কহিলেন, আমি পতিব্রতা সাবিত্রী। ১১১

হে পশুপতে! তুমি মূর্খ প্রাকৃত মনুষ্যের মত কেন আমার প্রতি অসদ্ব্যবহার করিতেছ? অগ্ৰে ভাৰ্য্যাকে তিরস্কারপূর্বক তাড়াইয়া এখন অনুনয় করিতেছ? ১১২

আর কেনই বা কামের বশবর্তী হইয়া পরস্ত্রী প্রার্থনা করিতেছ? এরূপ তোষামোদ না করিয়াই আমার ন্যায় স্ত্রীলোকের সহিত তোমার কথাবার্তা বলা উচিত। ১১৩

মূঢ়! আমি কি পাৰ্ব্বতী, যে বিশেষ না জানিয়াই আমার গাত্রে হস্তক্ষেপ করিলে! তুমি আমাকে জান–আমি পতিব্রতা সাবিত্রী। হে অদূর-দর্শিন!

তুমি যেহেতু আমাকে মানুষ বলিয়া জ্ঞান করিলে, অতএব তুমি মানুষ যোনিতে সুরতক্ৰীড়াসক্ত হইবে। ১১৪-১১৫

হে শম্ভো। যেহেতু তুমি পরস্ত্রী-সংসর্গ-বিমুখ হইয়াও অদ্য গৌরী বিরহে অন্য স্ত্রীকে অভিলাষ করিতেছ, সেই অভিলাষেরই এই ফল জানিবে। এক্ষণে তুমি স্বস্থানে গমন ও আমাকে পরিত্যাগ কর। তখন পতিব্রতা দেবী সাবিত্রী, শঙ্করকে এই সকল কথা বলিয়া নিজের আশ্রমে গমন করিলেন। ১১৬

মহাদেবও লজ্জাবিস্ময়যুক্ত হইয়া নিজ স্থানে প্রস্থান করিলেন। হে রাজন্! এই সকল কারণেই মহাদেব মানুষীতে উপগত হইয়াছেন। ১১৭

অতএব আপনি, পতিব্রতা তারাবতীর প্রতি সন্দেহ করিবেন না। আর মহাদেবের এই দুইটি পুত্রকে অপত্য-নির্বিশেষে পালন করুন। ১১৮

ঔর্ব কহিলেন,–অনন্তর রাজা, নারদমুনি হইতে আপনার শিবত্ব ও তারাবতীর ভগবতীত্ব শ্রবণ করিয়া জানিতে পারিলেন, মনুষ্য-যোনিতেই মহাদেব ও ভগবতী উৎপন্ন হইয়াছেন। ১১৯

এই সকল কথা শ্রবণের পর রাজা বিস্মিত হইয়া পুনৰ্বার নারদকে জিজ্ঞাসা করিলেন। ১২০

হে মুনিবর! আমি নিজের শিবত্ব ও দেবী তারাবতীর ভগবতীত্ব কিরূপে জানিতে ও সমক্ষে দেখিতে পাই, তাহা আমাকে সম্যকৃরূপে বলিয়া দিন। ১২১

নারদ কহিলেন; তুমি তারাবতীকে সঙ্গে করিয়া নেত্ৰদ্বয় নিমীলন করিয়া থাক এবং তারাবতীও ক্ষণকালের নিমিত্ত চক্ষু দুইটি মুদ্রিত করুন। ১২২

মুদ্রিত করিয়াই তৎক্ষণাৎ আবার উন্মীলিত করিবে, হে মহারাজ! এইরূপ করিলেই তোমার শৈব জ্ঞান ও রূপ হইবে। ১২৩

মহারাজ চন্দ্রশেখর নারদকর্তৃক এইরূপ উপদিষ্ট হইলে, তখন তিনি, বাম হস্তের দ্বারা তারাবতীকে ধরিয়া স্বয়ং চক্ষু দুইটী তারাবতীর সহিত মুদ্রিত করিয়াই উন্মীলিত করিলেন। ১২৪

নেত্র নিমীলনকালে তাঁহাদিগের শিবত্ব ও ভগবতীত্ব এতাদৃশ জ্ঞান হওয়ায়, ‘আমি শম্ভু’, ‘আমি ভগবতী’ এইরূপ উভয়ের জ্ঞান হইয়াছিল। ১২৫

অনন্তর নারদ, হাসিতে হাসিতে তখন সেই শম্ভুকে বলিলেন,–আপনি সাক্ষাৎ মহাদেব ও দেবী তারাবতী সাক্ষাৎ ভগবতী; হে মহাভাগ! এখন সমক্ষে আপনাতে আপনারা প্রত্যক্ষ করুন। ১২৬

তখন রাজা ‘তথাস্তু’ এইরূপ বলিয়া স্বীয় শরীর ব্যাঘ্রচর্মাচ্ছাদিত, দশহস্ত, হস্তগুলিতে আবার ত্রিশূল খট্বাঙ্গ শক্তি প্রভৃতি রহিয়াছে–বৃষাসীন, জটাজূটশোভী দেখিয়া তারাবতীকেও সুন্দরমুখী পদ্মহস্তা বিদ্যুৎ-সদৃশ গৌরাঙ্গী দেখিলেন। পরে জ্ঞানবলে সমস্ত বিষয় আপনাতে বিশ্বাস করিলেন। ১২৭-১২৯

পুনৰ্বার নারদ কহিলেন, হে রাজন! আমার বাক্য শ্রবণ করুন, পূর্বে বিষ্ণুমায়া আপনাদিগের দুইজনকে মনুষ্যযোনিতে মুগ্ধ করিয়াছিলেন। ১৩০

সেই হেতু মনুষ্য শরীরের দ্বারা আপনি আপনার শিবত্ব জানিতে পারেন নাই; সম্প্রতি শম্ভুই তোমাকে তোমার শম্বুরূপত্ব দেখাইলেন। ১৩১

এখন তুমি আবার নেত্ৰদ্বয় নিমীলন করিয়া মনুষ্যত্ব লাভ কর; যাবৎকাল তোমার দেহ থাকিবে, তাবৎকাল মনুষ্য-ভাবাপন্ন হইয়া বিচরণ কর; এবং দেবী তারাবতীও অবিলম্বে মানুষী মূর্তি ধারণ করুন। ১৩২

ঔর্ব কহিলেন,রাজা চন্দ্রশেখর আপনার দেবরূপত্ব জানিয়া ও স্বচক্ষে দেখিয়া যখন নিঃসন্দিগ্ধ হইলেন, তখন দেবী তারাবতীর সহিত নেত্র উন্মীলিত করিলেন। ১৩৩

উন্মীলন করিবামাত্র, বিষ্ণুমায়াবলে মোহিত হইয়া আপনাদিগের মনুষ্যত্ব বোধ করিলেন এবং তখন উভয়ে নেত্র উন্মীলন করিয়া আপনাদিগের মনুষ্যভাব দেখিয়া ‘আমরা মনুষ্য’ এইরূপ জানিতে পারিলেন। ১৩৪-১৩৫

তৎপরেই তাহারা বিষ্ণুমায়ায় মোহিত হইয়া আমি রাজা, ইনি মহিষী–এরূপও বোধ করিলেন। ১৩৬

তাহার পত্নীতে দেবাংশে পুত্রদ্বয় জন্মিয়াছে–এ মতি হইল। যেহেতু জাতকদ্বয়ের মস্তকে চিহ্ন রহিয়াছে। ১৩৭

তখন রাজা আনন্দিত হইয়া নারদ মুনিকে কহিলেন,–আপনার বাক্য আমি সফল করিব, নিধিসদৃশ মহাদেবের সুতদ্বয়কে সর্বদা পালন করিব; কিন্তু হে মুনিপুঙ্গব! আপনি এই দুইটী পুত্রের যথাবিধি সংস্কার করুন। ১৩৮-১৩৯

ঔর্ব কহিলেন, হে নৃপ! তাহার পর নারদ ঋষি, রাজার আজ্ঞানুসারে সেই দুইটি পুত্রের নামকরণ সংস্কার করিলেন। বল-প্রদীপ্ত জ্যেষ্ঠ পুত্রটির নাম ‘ভৈরব’ হইল এবং বেতালসদৃশ কৃষ্ণবর্ণ কনিষ্ঠ পুত্রটির নাম রাখিলেন ‘বেতাল’। ১৪০-১৪১

ব্ৰহ্মার পুত্র দেবর্ষি নারদ, দুইজনের নামকরণ যেরূপ করিলেন, সেইরূপ রাজা চন্দ্রশেখরের বচনানুসারে ক্রমশঃ অন্যান্য সংস্কার সকলও করিলেন। ১৪২

দেবর্ষি নারদ, এইরূপে চন্দ্রশেখরের সকল সংশয় ছেদন করিয়া এবং পুত্র দ্বয়ের কতকগুলি সংস্কারও যথাশাস্ত্র সম্পাদন করিয়া রাজা কর্তৃক অভিলষিত স্থলে প্রত্যাগমনের নিমিত্ত আদিষ্ট হইলেন। তৎপরেই নারদ, আকাশমার্গের দ্বারা স্বর্গে গমন করিলেন। ১৪৩

নারদ স্বর্গে গমন করিলে পর, রাজা চন্দ্রশেখর করবীরপুরে তারাবতীর সহিত আনন্দভোগ করিতে লাগিলেন। ১৪৪

আমি শঙ্করের অংশ, তারাবতী গৌরীর অংশ যখন রাজার এইরূপ জ্ঞান হইল, তখন তিনি শ্রদ্ধা সহকারে দীর্ঘকাল পৃথিবী পালন করিতে লাগিলেন। ১৪৫

এই সময়, হরের সেই মহাত্মা পুত্রদ্বয়ও উদিত শরচ্চন্দ্রের ন্যায় দিন দিন বাড়িতে লাগিল। ১৪৬

হে নরোত্তম! ইহা ভিন্ন তারাবতীর গর্ভসম্ভূত রাজা চন্দ্রশেখরের মহাবল পরাক্রান্ত পরম রূপবান্ তিনটী ঔরস পুত্র; তাহার মধ্যে জ্যেষ্ঠের নাম উপরিচর, মধ্যমের নাম দমন, কনিষ্ঠের নাম অলর্ক। ১৪৭

ইহাঁরা বেতাল ও ভৈরব হইতে বয়োজ্যষ্ঠ। চন্দ্রশেখরের এই তিনটি ঔরস পুত্র, আর এদিকে বেতাল ও ভৈরব, মহাদেবের সদ্যোজাত দুইটি সন্তান। সৰ্বসমেত এই পাঁচটি পুত্র সমানভাবে বাড়িতে লাগিল এবং রাজা ও রাজ্ঞী উভয়েই ইঁহাদিগকে তুল্য ভোজনাদি দ্বারা পালন করিতে লাগিলেন। ১৪৮১৪৯

বিধাতার পঞ্চভূত-সদৃশ অশেষ শক্তিসম্পন্ন এই পাঁচটী পুত্র, কালক্রমে সমুন্নত হইয়া স্বীয় ঔদার্য্য ও দৰ্পে সমস্ত পৃথিবী জয় করিয়াছিলেন। ১৫০

পঞ্চাশ অধ্যায় সমাপ্ত। ৫০

আরও পড়ুনঃ

ভৃঙ্গী ও মহাকালের শাপবিবরণ – কালিকা পুরাণ

কালিকা পুরাণ

Leave a Comment