আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় প্রভু জগদ্বন্ধু
প্রভু জগদ্বন্ধু
প্রভু জগদ্বন্ধু
বৃন্দাবন থেকে প্রভু জগদ্বন্ধু ফিরে এলেন ফরিদপুরে। ১৮৯০ সালে ব্রাহ্মণকান্দায় প্রভু আসন পাতলেন। সে সময় ফরিদপুর শহরতলীতে বেশ কিছু বাগদী বাস করত। নীলকর সাহেবরা এদেরকে এনেছিল সাঁওতাল পরগণা থেকে। রাস্তাঘাট নির্মাণ ও শূকর মেরে তাদের জীবিকা নির্বাহ হয়। হিন্দু সমাজে উপেক্ষিত এবং অস্পৃশ্য এই বাগদীরা। এদের খ্রিস্টান করবার জন্য চেষ্টা চলছে।
কিন্তু হিন্দু সমাজে এ সংবাদ কোন আলোড়নই সৃষ্টি করতে পারেনি। করুণাময় প্রভু জগদ্বন্ধুর প্রাণ কেঁদে উঠল। ব্যাকুল হয়ে তিনি বাগদীদের সর্দার রজনী মোড়লকে ডেকে পাঠালেন। বাগদীদের পাড়ায় প্রভু জগদ্বন্ধু পরিচিত ছিলেন ‘প্রভু’ নামে। সেই প্রভু ডেকেছেন শুনে রজনী ব্রাহ্মণকান্দায় ছুটে এলেন। প্রভু জগদ্বন্ধু তাকে দেখেই “রজনী এসেছো, রজনী এসেছো” বলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
দিব্যদেহের আলিঙ্গনে রজনী ধন্য হল। প্রভু জিজ্ঞাসা করলেন, “রজনী, তোমরা নাকি খ্রিস্টান হতে চাও? কেন বল তো?” রজনী বললেন, “প্রভু, আমরা বুনোজাতি; সবাই আমাদের নীচু মনে করে পায়ে ঠেলে রাখেন। খ্রিস্টান হলে আমাদের সে অবস্থা থাকবে না।” মানব প্রেমিক জগদ্বন্ধু বললেন, “কে বলে তোমরা নীচ? তোমরা মানুষ। মানুষের মধ্যে আবার উচ্চ-নীচ কি?
আর এ জাতি সে জাতিই বা কি? শ্রীহরির দাস তোমরা। তোমাদের পাড়ার সবাই মহান্ত বংশ। আর তোমার নাম হরিদাস মহান্ত। ভুবন মঙ্গল হরিনাম কর, সকলে ধন্য হও। অচিরে তোমাদের সকল দুঃখ ঘুচবে।” প্রভু জগদ্বন্ধুর কথায় রজনীর মন গলে গেল। তিনি যেন নতুন মানুষরূপে জন্মলাভ করলেন। পায়ের তলায় তাঁর নতুন পৃথিবী, মাথার উপর তাঁর নতুন আকাশ।
খ্রিস্টান হওয়ার ইচ্ছা তাঁর দূর হয়ে গেল। রজনীর সাথে সাথে বাগদীপাড়ার সবাই হলেন প্রভুর পরম ভক্ত। জগদ্বন্ধুর নিকট থেকে খোল-করতাল পেয়ে তাঁরা নামকীর্তনে মন-প্রাণ ঢেলে দিলেন। কীর্তনীয়া হিসেবেও তাঁদের নাম চারদিকে প্রচার হয়ে পড়ল। কলকাতার রামবাগানের ডোম সমাজের উপরও মানব-প্রেমিক প্রভু-জগদ্বন্ধুর দৃষ্টি পড়ে। প্রভু ডোমদের হীনমন্যতা দূর করলেন।
মানুষের অধিকার নিয়ে মানুষরূপে মাথা উঁচু করে সমাজে চলার উদ্দীপনা এনে দিলেন তাদের মধ্যে। প্রভু-জগদ্বন্ধু হরিনামের মাধ্যমে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের লোকদের একত্র সম্মেলন ও মৈত্রীপূর্ণ সহাবস্থানের মহান আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। প্রভু-জগদ্বন্ধু ফরিদপুরে স্থায়িভাবে বাস করতে চান। ফরিদপুর শহরের উপকণ্ঠে এক জঙ্গলময় স্থানে শ্রী অঙ্গন প্রতিষ্ঠিত হল।
এখানেই শুরু হয় প্রভুর গম্ভীরা লীলা। ১৩০৯ সালের আষাঢ় থেকে শুরু করে ১৩২৫ সালের ১৬ই ফাল্গুন পর্যন্ত ১৬ বছর ৮ মাস প্রভুর গম্ভীরালীলা চলে। এ সময় প্রভু জানালাবিহীন ছোট একটি ঘরে দরজা বন্ধ করে ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। কারও সঙ্গে তিনি কথা বলতেন না । ১৩২৮ সালের ১লা আশ্বিন প্রভু অগণিত ভক্তকে চোখের জলে ভাসিয়ে অমৃতময় নিত্যলীলায় প্রবেশ
করেন ।
প্রভু-জগদ্বন্ধু বহু কীর্তনসহ শ্রীশ্রীহরিকথা’, ‘চন্দ্রপাত’ ও ত্রিকালগ্রন্থ রচনা করে গেছেন।
প্রভু জগদ্বন্ধুর কয়েকটি উপদেশ-
১। শ্রীকৃষ্ণ সব জানলেও নিজমুখে সব বলতে হয়, প্রার্থনা নিবেদন করতে হয়।
২। নিরন্তর কৃষ্ণ নাম শিখবে, জপবে, চিন্তা করবে। কৃষ্ণই গতি, কৃষ্ণই পতি— এটাই সারকথা পরম ধর্ম ।
৩। – ভ্রষ্টবুদ্ধি হয়ে পিতা-মাতার মনে কষ্ট দিতে নেই। যে সংসারে শান্তি পায় না সে সংসার – ত্যাগ করলেও শান্তি পায় না ।
8৷ পরচর্চা কর্ণে বা অন্তরে স্থান দিও না। পরচর্চা বিষবৎ ত্যাগ কর। ঘরের দেয়ালে লিখে রেখ, পরচর্চা নিষেধ।
৫ ৷ তারকব্রহ্ম হরিনামই মহাউদ্ধারণ মন্ত্র। এই মন্ত্র গুপ্ত নয়, সর্বদা প্রকাশ্য। তোমরা দেশে হরিনাম প্রচার কর। হরিনামে সৃষ্টি রক্ষা পাবে।
আরও দেখুন :