আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় শ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী জীবনচরিত
Table of Contents
শ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী জীবনচরিত
শ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী জীবনচরিত
হিমালয়ের পূর্বাঞ্চল ধরে লোকনাথ ও বেনীমাধব নিম্নভূমির দিকে নেমে আসতে থাকেন। তখন দুই বন্ধুর বিচ্ছিন্ন হওয়ার পালা। বেনীমাধব কামাখ্যা অভিমুখে যাত্রা করেন, আর লোকনাথ অগ্রসর হন বাংলাদেশের মহাপীঠ চন্দ্রনাথের পথে। তিনি এদেশের পাহাড়, পর্বত ও বনাঞ্চলে কিছুকাল বাস করে মেঘনার কাছে বারদীতে পদার্পণ করেন। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বারদীতে আগমণ এক বিচিত্র ঘটনা।
নানাস্থানে বিচরণ করার পর সেদিন লোকনাথ বর্তমান কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি গ্রামে আসেন। এক বৃক্ষতলে বসে নীরবে ধ্যান করছেন। এমন সময় ডেঙ্গু কর্মকার নামে এক ব্যক্তি তাঁর চরণ ধরে কাঁদতে থাকে ফৌজদারি – মামলার আসামি হয়ে সে বড়ই বিপদে পড়েছে। সন্ন্যাসী কৃপাভরে তাকে অভয় দিয়ে বললেন, “যা, কোন ভয় নেই। তুই মুক্তি পাবি।
” সন্ন্যাসীর আশীর্বাদে আশ্চর্যভাবে মুক্তিলাভ করে সে আবার এসে মিনতি করল “প্রভু, চলুন আমার গাঁয়ে । সেখানে আপনাকে প্রতিষ্ঠা করব।” সন্ন্যাসী রাজি হলেন। বারদীতে ডেঙ্গু কর্মকারের গৃহে তিনি কিছুকাল থেকে চলে যান। এরপর স্থানীয় জমিদার নাগবাবুদের উদ্যোগে বারদীতেই ব্রহ্মচারীর জন্য আশ্রম নির্মিত হল । অল্প সময়ের মধ্যে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর যোগবিভূতির কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
মুমূর্ষু ভক্তবৃন্দ ও রোগশোকক্লিষ্ট নর-নারীরা তাঁর কাছে এসে ভিড় জমাতে লাগল। ব্রহ্মচারীর কৃপা পেয়ে দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত হয়েছেন অনেক ব্যক্তি। পূর্ণচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের ব্যাধি নিরাময়ের ঘটনাটি এরূপ কৃপারই একটা দৃষ্টান্ত। উৎকট কুষ্ঠরোগে ভুগতে ভুগতে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। অবশেষে বারদীতে গিয়ে ব্রহ্মচারী বাবার চরণাশ্রয় লাভের পর তিনি সম্পূর্ণরূপে রোগমুক্ত হন।
সিদ্ধাযোগী পুরুষ শ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারীর দৃষ্টিশক্তির প্রখরতা সম্বন্ধে একটা কাহিনী প্রচলিত আছে। নারায়ণগঞ্জ মহকুমা হাকিমের কোর্টে এক জটিল ফৌজদারি মামলা। বারদীর রাধাকান্ত নাগের বিরুদ্ধে ভারতের পশ্চিম দেশীয় এক ব্যক্তির নালিশ। অভিযোগ হল : রাধাকান্ত ঐ ব্যক্তির প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিল।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ বারদী গ্রামনিবাসী কালীকান্ত নাগ মহাশয়ের পুত্র রাধাকান্ত নাগ একদিন অতিরিক্ত মদ্যপানে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ব্রহ্মচারীর আশ্রমে গিয়ে ব্রহ্মচারী বাবাকে অপমান করার চেষ্টা করে। তখন ব্রহ্মচারীর একজন পশ্চিম দেশীয় ভক্ত রাধাকান্তকে বলপূর্বক বাবার ঘর থেকে বের করে দেয়। এতে রাধাকান্ত ভীষণ ক্ষিপ্ত হয় এবং বাড়িতে গিয়ে কয়েকজন সর্দার নিয়ে এসে ঐ ব্যক্তিকে মারতে মারতে তাদের বাড়ি নিয়ে যায়।
ছাড়া পেয়ে সে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে রাধাকান্তের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে। রাধাকান্ত নাগের লোকেরা যে ব্রহ্মচারীর শিষ্যকে মারতে মারতে নিয়ে গেছে এ দৃশ্যের প্রত্যক্ষ সাক্ষী ব্রহ্মচারী নিজেই। তাই কোর্টে তাঁর ডাক পড়েছে। ব্রহ্মচারী সাক্ষ্য দিতে এসেছেন শুনে কৌতূহলী জনতার ভিড়। সেদিন আদালতে তিল ধারণের স্থান ছিল না।
ব্রহ্মচারী বাবাকে প্রশ্ন করা হল তাঁর বয়স কত? তিনি উত্তরে বললেন, “তা প্রায় দেড়শ বছর হবে।” অপরপক্ষের মোক্তার বললেন, “দেখুন সাধুবাবা এটা কিন্তু সরকারি আদালত, এখানে এ ধরনের অসম্ভব কথাবার্তা বলা চলে না। ব্রহ্মচারী শান্তভাবে বললেন, “তবে তোমাদের যা ইচ্ছে হয় লিখে নাও।” বিপক্ষের মোক্তার জেরার মাধ্যমে প্রতিপন্ন করতে চান যে, এরূপ অতিবৃদ্ধ সাক্ষীর পক্ষে স্বচক্ষে ঘটনাটি দেখা মোটেই সম্ভবপর নয়।
তাই তিনি সাধুবাবাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি তো বললেন আপনার বয়স প্রায় দেড়শ’ বছর। স্বীকার করে নিলাম আপনার কথা। তাহলে এত বয়সে আপনার দৃষ্টি নিশ্চয়ই বেশি দূর যেতে পারে না। অথচ আপনি ঘরে বসে কি করে ঘটনা স্বচক্ষে দেখলেন ।” ব্রহ্মচারী বাবা হাসলেন। দূরের একটি গাছের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, “আচ্ছা দেখ তো ঐ গাছে কোন প্রাণী আরোহণ করছে কি না?”
সেদিকে তাকিয়ে সবাই স্বীকার করলেন যে, তারা এমন কিছুই সেখানে দেখতে পাচ্ছেন না। ব্রহ্মচারী কৌতুকভরা হাসি হেসে বললেন, “তোমাদের বয়স কম, দৃষ্টিশক্তি বেশি। অথচ কিছুই নজরে পড়ছে না। আমি কিন্তু বেশ দেখতে পাচ্ছি, এক সারি লাল পিঁপড়ে গাছটির গা বেয়ে উঠে যাচ্ছে।” আদালতের কৌতূহলী জনতা গাছটির নিকটে গিয়ে এ দৃশ্য দেখে এল।
সবাই তো বিস্ময়ে অবাক; এত বয়সেও ব্রহ্মচারী বাবার এমন প্রখর দৃষ্টি। সকলেই উপলব্ধি করলেন, ইনি একজন যোগসিদ্ধ মহাপুরুষ। হাকিম ব্রহ্মচারী বাবার সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করেই মামলার রায় দিলেন। লোকনাথ ব্রহ্মচারী যোগসামর্থ্যের এক বিশেষ প্রকাশ সূক্ষদেহে যথা ইচ্ছা ভ্রমণ। একবার তাঁর প্রিয়ভক্ত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী দ্বারভাঙ্গায় মরণাপন্ন হয়ে পড়েন।
ডাক্তারগণ তাঁর জীবনের আশা ছেড়ে দেন। লোকনাথ ব্রহ্মচারী তখন বারদীর আশ্রমে। বিজয়কৃষ্ণের এরূপ অসুখের কথা শুনে তিনি সূক্ষ্ম দেহে তাঁর নিকট উপস্থিত হন। শুশ্রূষাকারীরা ব্রহ্মচারীকে রোগীর বিছানার পাশে দেখে অবাক হয়ে যায়। লোকনাথ বাবার কৃপায় বিজয়কৃষ্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। শ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী জনসাধারণের মঙ্গলের জন্যই লোকালয়ে এসেছিলেন।
তিনি একদিন তাঁর এক প্রিয় শিষ্যকে বলেছিলেন, “আমি পাহাড়-পর্বতে ঘুরে ঘুরে বড় একটা ধন অর্জন করে এনেছি, কত বরফ এ শরীরের উপর দিয়ে জল হয়ে গিয়েছে। তোরা সে ধন বসে বসে খাবি।” এই লোকনাথ ব্রহ্মচারী নানাভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকদের কল্যাণ সাধন করে গেছেন। বারদীতে প্রায় ২৭ (সাতাশ) বছর কাটাবার পর বাবা লোকনাথ ১৬০ বছর বয়সে ১২৯৭ সালে ১৯ শে জ্যৈষ্ঠ দেহত্যাগ করেন।
শ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারীর কয়েকটি উপদেশ
১। কর্মত্যাগ অপেক্ষা কর্ম করাই ভাল ।
২। জগতে যখন মানুষের শরীর নিয়ে এসেছিস তখন দশের সেবা করে, তাঁকে প্রসন্ন করে জীবন সার্থক করে নে—এতে তোরও মঙ্গল, জগতেরও মঙ্গল।
৩। বাক্যবাণ, বন্ধুবিচ্ছেদ বাণ ও বিত্ত-বিচ্ছেদ বাণ-এ তিনটি বাণ সহ্য করতে পারলে মৃত্যুকে জয় করা যায়।
8। “রণে বনে জলে জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়বি আমায় স্মরণ করবি, আমিই তোকে রক্ষা করব। ”
সারাংশ
শ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী হিমালয় থেকে বাংলাদেশের চন্দ্রনাথ পাহাড়, পরে দাউদকান্দি হয়ে ঘটনাক্রমে বারদীতে আসেন। সেখানে তিনি বারদীর ব্রহ্মচারী বলে পরিচিত হন। রুগ্ন, বিপদাপন্ন ব্যক্তিগণ ব্রহ্মচারীর কৃপা পেয়ে সুস্থ হন, বিপদ থেকে মুক্ত হন। শ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারীর কৃপা পেয়ে বহুলোক ধন্য হয়েছেন। ১৬০ বছরে বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন। তিনি সকলের জন্য অভয়বাণী রেখে গেছেন।
“রণে বনে জলে জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়বি
আমায় স্মরণ করবি, আমিই তোকে রক্ষা করব।”
আরও দেখুন :