মা আনন্দময়ী

আজকে আমরা জানবো মা আনন্দময়ী সম্পর্কে:

মা আনন্দময়ী ১

 

মা আনন্দময়ী ১

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত খেওড়া গ্রামে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল বৃহস্পতিবার মা আনন্দময়ী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বিপিন বিহারী ভট্টাচার্য। মাতার নাম মোক্ষদা সুন্দরী। বিপিন বিহারীর পিতৃপুরুষের গ্রাম ছিল বিদ্যাকূট। খেওড়া তাঁর মামার বাড়ি। আনন্দময়ী তাঁর বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান । আনন্দময়ী জন্মের আগে মা মোক্ষদা সুন্দরী অনেক স্বপ্ন দেখতেন।

তিনি দেখতেন স্বর্গের দেব-দেবী তাঁর কাছে আসছেন। তাই ভক্তদের বিশ্বাস আনন্দময়ী স্বর্গেরই কোন দেবী। এসেছেন পৃথিবীতে জগতের মা হয়ে। জন্মের পর যথাসময়ে শিশু কন্যার নামকরণ করা হয়। আচার্য তাঁর নাম রাখেন নির্মলা। বাবা কন্যাকে সর্বাধিক স্নেহ করতেন । কন্যাকে বসন-ভূষণে সজ্জিত রাখতে ভালবাসতেন। তাঁকে সুশিক্ষিতা করে তুলতে চেষ্টা করতেন।

যাতে বাল্যকাল হতেই তাঁর মনে শ্রদ্ধা, ভক্তি, দয়া, মমতা, ত্যাগ, নিষ্ঠা প্রভৃতি সৎ গুণ সহজেই বিকশিত হয়ে ওঠে, সেজন্য তিনি সর্বদা চেষ্টা করতেন। বাবার সৎ শিক্ষায় শিশুকাল হতেই উচ্চ আদর্শের প্রতি গভীর অনুরাগ জন্মেছিল। তাঁর বহু পরিচয় পাওয়া যায়। ছোটবেলায় নির্মলা দেবী একদিন তাঁর পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাবা, কি কি সৎ গুণ থাকলে মানুষ বড় হয়?

” উত্তরে বিপিনবিহারী বলছিলেন — “যারা সত্য কথা বলে, পরের দ্রব্যে লোভ করে না, গুরুজনকে মান্য করে, দীন-দুঃখীর সেবা করে এবং সর্বোপরি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও ভক্তি রেখে চলে তাদেরই লোকে মহৎ বলে। ভগবানও তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন।”
পিতৃদেবের গুণরাজি নির্মলা দেবীর চরিত্রে যথাসময়ে বিকশিত হয়ে পরবর্তী জীবনে তাঁকে মহীয়সী করে তুলেছিল।

আরও বড় হলেন তিনি। এ সময়ে তাঁর মনে জাগে অনেক প্রশ্ন। পিতাকে দেখে হরিনাম করতেন। হরিবোল, হরিবোল বলতেন। একদিন মেয়ে বাবাকে প্রশ্ন করল – “আচ্ছা বাবা, তুমি তো হরিকে ডাক। হরিকে ডাকলে কি হয়”? ছোট মেয়ের প্রশ্নে বাবা অবাক হলেন। কিন্তু সহজভাবে উত্তর দিলেন, “হরিকে ডাকলে মঙ্গল হয়। কল্যাণ হয়।

 

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

আর তিনি আসেন এই যেমন তোমাকে ডাকি— নির্মলা, তুমি দৌড়ে আস। হরিও ঠিক এভাবে আসেন। তখন তাঁর কাছে যা চাবে, তাই পাবে।” গ্রামের পাঠশালাতেই তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়। তখন নির্মলা চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী একদিন স্কুল পরিদর্শক এসে হঠাৎ নির্মলাকে পড়া ধরলেন, একটি কবিতা মুখস্থ বলতে বললেন। নির্মলা নির্ভুলভাবে, সুন্দর করে কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনালেন।

গুরু মহাশয় ও স্কুল পরিদর্শক সবাই মুগ্ধ হলেন। তবে স্কুলের পড়াশোনা নির্মলার আর বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। দেবী শক্তির মহাভাব ও মাধুরী ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে তাঁর মধ্যে। মেয়েটি যেন সব সময়ই এক পরমানন্দে অবস্থান করছে। হরিনাম কীর্তনের শব্দে বিভোর হয়ে ওঠে। এইভাবে সবার আদর, স্নেহ, মমতার মধ্যে দিয়ে বড় হতে লাগল নির্মলা।

এগার বছরের বালিকা নির্মলা সবই বিশ্বাস করে। তাঁর আবার প্রশ্ন- “হরিকে কেমন করে ডাকতে হয় বাবা?” বাবা হরিকে ডাকার নিয়ম শিখিয়ে দিলেন। পিতার নির্দেশে বালিকা নিৰ্মলা দেবী তারপর থেকেই একান্ত নিষ্ঠা ও আগ্রহের সঙ্গে তাঁর ধ্যানলব্ধ সেই ইষ্ট মূর্তির উপাসনায় ও সৎ নামের সাধনায় দিবারাত্র বিভোর থেকে পরমানন্দে কাল কাটাতে লাগলেন। ফলে অল্প কালের মধ্যেই তাঁর আধ্যাত্মিক রাজ্যের নানা অজানা অনুভূতি প্রকাশ পেতে থাকে।

একটা নতুন দিন আলোকিত হয়ে উঠল নির্মলার জীবনে। তের বছর পূর্ণ হয়ে চৌদ্দ বছরে পদার্পণ করেন নির্মলা। তখন ঢাকার বিক্রমপুরের আটপাড়া গ্রাম নিবাসী রমণীমোহন চক্রবর্তীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামী রমণীমোহন চক্রবর্তীকে নির্মলা ভোলানাথ নাম দেন। শুরু হয় নির্মলার গার্হস্থ্য জীবনে কুলবধূর ভূমিকা।

আর পাঁচটি সাধারণ মেয়ের মত নির্মলাও স্বামীর ঘরে এলেন । স্নেহ, সেবা, আদর, যত্ন কোন কিছুতেই ত্রুটি নেই। নির্মলার বধূ-জীবনের শিক্ষানবীসি চলতে থাকে ভাসুর রেবতীমোহনের অন্তঃপুরে। বড় জায়ের কাছে সংসারের খুঁটিনাটি কাজকর্ম আগ্রহ ভরে শিখে নেন নির্মলা।

 

মা আনন্দময়ী ১

 

সারাংশ

বিপিন বিহারীর দ্বিতীয়া সন্তান মা আনন্দময়ী। পিতৃ-বাক্যের ওপর সরল বিশ্বাসেই তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনা বৃদ্ধি পায়। চৌদ্দ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়।

 

মা আনন্দময়ী ২

 

মা আনন্দময়ী ২

১৩২৪ সালে নির্মলা এলেন স্বামীর কর্মস্থল বাজিতপুরে। ভোলানাথ সেটেলমেন্ট বিভাগে চাকরি করেন। নির্মলার মধ্যে দিব্যভাব প্রস্ফুটিত হয়ে চলছে। কোথাও কৃষ্ণ গুণগান হলেই কৃষ্ণপ্রেমে মন তাঁর আকুল হয়। একবার ভূদেবচন্দ্র বসুর বাড়িতে কীর্তনের আয়োজন করা হয়েছে। নির্মলা সুন্দরীও সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। কীর্তন শুরু হয়—

“হরিহরয়ে নমঃ কৃষ্ণযাদবায় নমঃ।

যাদবায় মাধবায় কেশবায় নমঃ”

কীর্তন শুনতে শুনতে নির্মলার মধ্যে ভাবের উদয় হয়। কৃষ্ণনাম-ধ্বনির তরঙ্গে তরঙ্গায়িত হয়ে ওঠে। নির্মলার মধ্যে ভাবের আবেশে মাটিতে পড়ে গিয়ে চৈতন্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। কীর্তন চলছে। সুমধুর কণ্ঠনিঃসৃত নাম ধ্বনি ধীরে ধীরে নির্মলাকে সুস্থ করে তুলল। আশ্বস্ত হলেন সকলে। কিন্তু ঘটনাটি রটে গেল সমস্ত বাজিতপুরে। পাড়া-প্রতিবেশীরা এসব দেখে রমণীমোহনকে ভাল ডাক্তার বা ওঝা দেখাতে বললেন।

রমণী মোহন একজন ওঝা নিয়ে আসেন। কিন্তু সে ওঝা নিৰ্মলা সুন্দরীর দেহে অলৌকিক ক্রিয়া-কলাপের কিছু দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। আর কিছুক্ষণ পরে গো- গো শব্দ করতে করতে মা, মা বলে ডাকতে থাকেন। সুস্থ হওয়ার পর ওঝাটি বলে যান এসব অসুখ সারানো আমাদের কাজ নয়, এই মা সাক্ষাৎ ভগবতী। ডাক্তার মহেন্দ্র নন্দীও তখন মার ঐ অবস্থা দেখে বলেছিলেন, “এ সব খুব উচ্চ স্তরের অবস্থা।

কোন অসুখ নয়।” এভাবে নির্মলা সুন্দরীর মধ্যে মহাভাবের শুরু। সাধারণ মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে তাঁর শরীরে চলতে থাকে সাধন-ভজনের নানা রকম লীলা। দিব্য জ্যোতির আভায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর সমস্ত শরীর। একদিন ঝুলন পূর্ণিমা তিথিতে অলৌকিকভাবে নির্মলা সুন্দরীর দীক্ষা হয়ে গেল। ঠিক লোকাচার অনুযায়ী নয়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে। দৈব প্রভাবে কিছু সময়ের জন্য তাঁর বাকশক্তি রহিত হয়ে গেল।

এক অপ্রাকৃত ভাবের ঘোরে দিন অতিবাহিত হতে লাগল। রমণীমোহন চক্রবর্তীর গৃহবধূ নির্মলা ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়ে উঠতে লাগলেন সচ্চিদানন্দময়ী রূপে । ইংরেজি ১৯২৪ সাল। তখনকার নবাবের বাগানের তত্ত্বাবধায়কের কাজ পেয়ে ভোলানাথ চলে এলেন ঢাকার ‘শাহবাগে’। এই শাহবাগে সিদ্ধেশ্বরী মা কালীর পীঠস্থানে নির্মলার প্রকাশিত হয় মহা সাধিকার নির্মলা তখন হলেন শাহবাগের মা, ঢাকা মা শ্রীমা।

শাহবাগে অবস্থানকালে মায়ের অলৌকিক শক্তির আরও প্রকাশ ঘটতে থাকে। বাজিতপুরে থাকা অবস্থাতেই মা ‘সিদ্ধেশ্বরী গাছ’ দেখেছিলেন। প্রবাদ আছে যে, সিদ্ধেশ্বরী গাছ অর্থাৎ ঐ স্থানের অশ্বত্থ বৃক্ষ থেকে এক সময় একটি জ্যোতি বেরিয়ে কালী মূর্তির সঙ্গে মিলিয়ে গিয়েছিল। শোনা যায়, এখানে পূর্বে কোন মন্দির ছিল না। সুমেরুবন নামে এক সন্ন্যাসী এখানে কালীমন্দির স্থাপন করেন। এরই পার্শ্বে ছিল অশ্বত্থ বৃক্ষ।

প্রথম দিন রাতের বেলায় মা ও ভোলানাথ লণ্ঠন নিয়ে মন্দির দেখে চলে এলেন। তখন সেখানে কোন ঘরবাড়ি ছিল না। কালীমন্দিরের সাথে ছিল একটি পঞ্চ-মুণ্ডীর আসন। ভাইজি বলে অভিহিত এক সাধক, শ্রীমা ও ভোলানাথ এসেছেন সিদ্ধেশ্বরীতে। মন্দিরের উত্তর পার্শ্বে মা একটি কুণ্ডস্থল আবিষ্কার করেন।

 

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

পরে দক্ষিণ দিকে মুখ করে মা বসে পড়েন এবং তাঁর মুখ থেকে স্তোত্রাদি বের হতে থাকে। দিব্যভাব উন্মাদনায় মা ধারণ করলেন আনন্দময়ী মূর্তি। মায়ের সেই রূপ দেখে ভাইজির কণ্ঠ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হল ‘আনন্দময়ী মা’। ভাইজি তখন ভোলানাথকে বলেন, ‘আজ আমরা এঁকে শুধু মা বলে ডাকব না, বলব আনন্দময়ী মা।’ ইংরেজি ১৯২৬ সালের মার্চ মাসে সিদ্ধেশ্বরীতে প্রথম মায়ের মন্দির নির্মিত হয়।

এখানেই মা আনন্দময়ী আশ্রমের সূত্রপাত। এটিই মায়ের আদি আশ্রম। এই আশ্রম সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের পেছনের দিকে অবস্থিত। এ বছরই সিদ্ধেশ্বরীতে প্রথম বাসন্তী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকায় দীর্ঘদিন অতিবাহিত করার পর একদিন মা বললেন, “তোমরা এ শরীরটাকে ছেড়ে দাও। এ শরীর আজই ঢাকা ছেড়ে চলে যাবে।” যেমন কথা তেমনি কাজ।

মা একটি মাত্র পরিধেয় বস্ত্র সম্বল করে ঢাকা ত্যাগ করলেন। কিন্তু কোথায় যাবেন কিছুই ঠিক নেই। ১৯৩২ সালের জুন মাসে মা আনন্দময়ী, ভোলানাথ ও ভাইজিসহ বহুপথ অতিক্রম করে দেরাদুনে পৌঁছেন। আনন্দময়ী মার লীলাক্ষেত্র ঢাকা থেকে স্থানান্তরিত হয় উত্তর ভারতে। সেখানকার কয়েকটি ধর্মপ্রাণ পরিবার মায়ের সান্নিধ্যে এসে দিব্য ভাবের পরিচয় জানল।

মা আনন্দময়ী মানুষকে আধ্যাত্মিকভাবে উদ্বুদ্ধ করার জন্য উপমহাদেশের পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ সর্বত্র পরিভ্রমণ করেছিলেন। তিনি নৈমিষারণ্যে উপস্থিত হয়ে প্রাচীন ভারতীয় এই তীর্থস্থানের পুনরুজ্জীবন ঘটান। সজল নেত্রে ভক্তদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “দেখ, কতকাল ধরে এই স্থান জঙ্গল হয়ে পড়ে আছে। মানুষ, পশু-পক্ষী কতভাবে তাঁকে অপবিত্র করছে।

তারা তো জানে না এ স্থানের মাহাত্ম্য।” ভারতীয় সংস্কৃতির মর্মস্থল, কয়েক সহস্র ঋষির তপস্যাভূমি নৈমিষারণ্যকে মা জাগিয়ে তুললেন। দিবারাত্র চলছে কীর্তন, নাচ-গান, নানা ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও সৎসঙ্গ। এমনভাবে মা আনন্দময়ী বিভিন্ন স্থানের সুপ্ত, লুপ্ত, ধর্মস্থানকে জাগ্রত করে, যাগ-যজ্ঞ, মন্দির ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে সনাতন ধর্মের ভাবধারায় উজ্জীবিত করে তুলেছেন।

মানুষের মনকে ভগবৎমুখী হওয়ার জন্য দিয়ে গেছেন অশেষ প্রেরণা। বাংলাদেশের রমনা ও খেওড়ায় দুটি আশ্রমসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ২৫টি আশ্রমের কথা জানা যায়। এই মা আনন্দময়ী ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট দেহ ত্যাগ করেন। হরিদ্বারে কণখল আশ্রমে গঙ্গার তীরে শ্রী শ্রী মায়ের মরদেহ সমাধিস্থ করা হয়।

 

মা আনন্দময়ী ২

 

সারাংশ

মা আনন্দময়ী সুপ্ত, লুপ্ত, ধর্মস্থানকে জাগ্রত করে, যাগ-যজ্ঞ, মন্দির, বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে সনাতন ধর্মের ভাবধারায় উজ্জীবিত করে তুলেছেন। প্রতিটি নর-নারীর মধ্যে আনন্দবর্ধন করে নিজে হয়েছেন আনন্দময়ী।

আরও দেখুন :

Leave a Comment