রাজনীতি কালিকা – কালিকা পুরাণ

চতুরশীতিতম অধ্যায় – রাজনীতি কালিকা:  ঋষিগণ বলিলেন,–মহাভাগ। আপনি সকল কথাই বলিলেন, আমাদিগের সন্দেহ ভঞ্জনও করিলেন; গুরুদেব! আপনার প্রসাদে আমরা কৃতার্থ হইলাম। ১

দ্বিজবর! ভৃঙ্গী ও মহাকালই ত বেতাল ভৈরবরূপে উৎপন্ন হইল; কিন্তু গুরুদেব! বেতাল, মহাকাল, ভৃঙ্গী ও ভৈরব–এই চারিজনের কথা শুনিতে পাই কিরূপে? ২-৩

দ্বিজবর! বেতাল ভৈরব-ব্যতীত আর দুইজন ভৃঙ্গী মহাকাল কে? ইহা পুনরায় শুনিতে ইচ্ছা করি। ৪

মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–দ্বিজবরগণ! মহাকাল ও ভৃঙ্গী-মনুষ্যত্ব প্রাপ্তির পর বেতাল ভৈরব নামে প্রসিদ্ধ হয়। ৫

ইহার পর বরলাভ করিলে, মহেশ্বর তপোনিষ্ঠ অন্ধকাসুরকে ভৃঙ্গিস্থানীয় করিলেন। ৬

রাজনীতি - কালিকা পুরাণ

পূৰ্বে অন্ধকাসুর, শিবের সহিত বিরোধ করিয়া বিপন্ন হয়, পশ্চাং শিবকে আরাধনা করিয়া তদীয় পুত্ৰত্বলাভ করিল। ৭

রাজনীতি কালিকা – কালিকা পুরাণ

ভৃঙ্গীর প্রতি স্নেহবশত মহাদেব, সেই অন্ধকের নাম রাখিলেন ভৃঙ্গী। কৃষ্ণ, বলিপুত্র বাণ-রাজার বাহুচ্ছেদ করিলে মহাদেব, তাহাকে মহাকালস্থানীয় করিয়া মহাকাশের প্রতি স্নেহবশত বাণেরই মহাকাল নাম রাখিলেন। ৮

মুনিবরগণ! এইরূপেই বেতাল, ভৈরব, ভৃঙ্গী, মহাকাল–পৃথক পৃথক এই চারিজন হইয়াছেন। ৯

ঋষিগণ বলিলেন–ভাৰ্য্যা, পুত্র, আত্মা ও গুরুর প্রতি যেরূপ নীতি প্রয়োগ করা উচিত, তৎসম্বন্ধে এবং রাজনীতি, সাধুনীতি এবং সদাচারে যে সকল বিশেষ নিয়ম আছে, তদ্বিষয়ে সগর রাজা, মহামতি মহাত্মা ঔর্ব ঋষিকে জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি যে উত্তর প্রদান করেন। ১০-১১

হে দ্বিজবর! তপোধন! তৎসমস্ত বিশেষরূপে শুনিতে ইচ্ছা করি, মহাভাগ গুরুদেব! আমাদিগের নিকট তাহা কীর্তন করুন। ১২

মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–মহাত্মা ঔৰ্ব নীতিসম্বন্ধে যে যে বিশেষ কীৰ্ত্তন করিয়াছেন, তৎসমস্ত বলিতেছি। ১৩

হে দ্বিজবরগণ! শ্রবণ কর। রাজা সগর, মন্ত্ৰকল্পাদি শ্রবণ করিয়া মহামুনি ঔর্বকে নীতি সম্বন্ধে বিশেষ বিবরণ জিজ্ঞাসা করিলেন। ১৪

ঋষিবর! পুত্র, আত্মা এবং ভাৰ্যার প্রতি যে নীতি প্রয়োগ করা উচিত, তৎসমুদায় এবং সদাচার-আমার নিকট বলুন। ১৫

ঔর্ব বলিলেন,–রাজেন্দ্র! আত্মা, পুত্র, ভাৰ্যার প্রতি যে নীতি প্রয়োগ করা উচিত, তাহা সবিশেষরূপে আমি কীৰ্ত্তন করিতেছি, ক্ৰমে শ্রবণ কর। ১৬

প্রথমে জ্ঞান-বৃদ্ধ, তপোবৃদ্ধ, বয়োবৃদ্ধ, অসূয়া-বর্জিত উদারচিত্ত বিপ্রমণ্ডলীর সেবা কর্তব্য। ১৭

তাহাদিগের নিকট প্রতিদিন শ্রুতি-স্মৃতিবিহিত বিধিব্যবস্থা শ্রবণ করিবে; তাঁহারা যাহা বলিবেন, বিজ্ঞ রাজা তাহাই করিবেন। ১৮

শরীর একখানি রথ; পঞ্চ ইন্দ্রিয় তাঁহার পাঁচটি অশ্ব; আত্মা তাঁহার আরোহী রথী, জ্ঞান অশ্বের লাগাম, মন তাহার সারথি। ১৯

রাজনীতি - কালিকা পুরাণ

অশ্ব সকল বিনীত করিবে, সারথিকে রথীর বশ করিবে, লাগাম দৃঢ় করিবে এবং শরীরের (রথের) স্থৈর্য সম্পাদন করা কর্তব্য। ২০

রথী, দুর্বিনীত-অশ্বচালিত রথে আরোহণ করিয়া অশ্বদিগের ইচ্ছানুসারে গমন করিতে করিতে বিপথে উপনীত হয়, আবার সারথি, রথীর অবশ হইয়া ইচ্ছামত অশ্ব চালনা করিলে, রথী বীর হইলেও তাহাকে রিপুর অধীন করিয়া ফেলে। ২১-২২

অতএব রাজা, বিষয় ভোগ করিবার সময় ইন্দ্রিয় এবং মনকে বশীভূত করিবে, জ্ঞান যাহাতে দৃঢ় হয়, তাহা করিবে। ২৩

রাজশ্রেষ্ঠ জ্ঞান বা কশা (লাগাম) দৃঢ় হইলে, সারথি বশবত্তা থাকিলে, বিনীত অশ্ব ঠিক পথেই চালিত হইয়া থাকে। ২৪

অতএব রাজা, নিজ ইন্দ্রিয় ও মন বশে রাখিয়া জ্ঞানপথে অধিষ্ঠান করত আত্ম-হিতানুষ্ঠান করিবে। ২৫

রাজা স্বেচ্ছাক্রমে ভোগ করিবে, কিন্তু বিপথে মন দিবে না। দেখা উচিত বলিয়া দেখিবে, ঔৎসুক্য সহকারে কিছুই দেখিবে না। ২৬

শ্রোতব্য হইলে শ্রবণ করিবে, অতিরিক্ত বিষয় শ্রবণ করিবে না। ধীর রাজা শাস্ত্ৰতত্ত্ব ব্যতীত, আর কিছুতেই হঠাৎ বিশ্বাসযুক্ত হইবে না। ২৭

রাজা, নাসিকা ও ত্বগিন্দ্রিয়কেও এইরূপ নিজ ইচ্ছার বশবর্তী করিয়া স্বেচ্ছাক্রমেই বিষয়েপভোগ করিবে এবং স্বেচ্ছাক্রমেই বিষয়লাভ করিবে। ২৮

রাজা এইরূপ হইলেই জিতেন্দ্রিয় হয়। শাস্ত্রানুশীলন ও বৃদ্ধসেবাই ইন্দ্রিয় জয়ের হেতু। ২৯

অবৃদ্ধসেবী, শাস্ত্রানভিজ্ঞ রাজা, শত্রুবশ হইয়া পড়েন। এই জন্য রাজা, শাস্ত্র অবলম্বনপূর্বক জিতেন্দ্রিয় হইবেন। ৩০

প্রসন্নতা, প্রাগলভ্য, উৎসাহ, বাকপটুতা, বিবেচনা, কুশলতা, সহিষ্ণুতা, জ্ঞান, মৈত্রী, কৃতজ্ঞতা, শাসন-দার্ঢ়্য, সত্য, শৌচ, কাৰ্যস্থিরতা, পরের অভিপ্রায় জ্ঞান, সচ্চরিত্রতা, বিপদে ধৈৰ্য, ক্লেশ-সহিষ্ণুতা, গুরুদেব-দ্বিজপূজা, অসূয়া হীনতা, অক্ৰোধতা–রাজা এই সমস্ত গুণ অভ্যস্ত করিবে। ৩১-৩২

রাজা, কাৰ্যাকাৰ্য-বিভাগ, ধর্ম, অর্থ এবং কামের প্রতি সতত লক্ষ্য রাখিবেন; অবসর মত তাহা পালনও করিবেন। ৩৩

সাম (সদ্ব্যবহারে মিটমাট), দান (কিছু দিয়া মিটমাট), ভেদ (শত্রু পক্ষের লোক ভাঙ্গান), দণ্ড (যুদ্ধ) এই চতুর্বিধ উপায়; রাজা ইহা জানিয়া যথাস্থানে প্রয়োগ করিবেন। ৩৪

সামপ্রয়োগ স্থলে, ভেদ-উপায় প্রয়োগ মধ্যম বলিয়া কীর্তিত। দানপ্রয়োগ স্থলে দণ্ডপ্রয়োগ বা দণ্ড প্রয়োগস্থলে দানপ্রয়োগ-অধম বলিয়া নিদিষ্ট।  ৩৫-৩৬

সামপ্রয়োগ-স্থলে দণ্ডপ্রয়োগ অধমাপেক্ষা অধম। সাম, দান–এই দুইটি উপায় পরস্পরেই পরস্পরের সাহায্য কারী। ৩৭

রাজা, সাম, দান, ভেদ, দণ্ড–সকল উপায় প্রয়োগস্থলেই মৌখিক সৌজন্য প্রকাশ করিবেন। ৩৮

রাজার পক্ষে, কাম, ক্রোধ, লোভ, হর্ষ, অভিমান ও মদ-ইহাদিগের আতিশয্য শত্রুবং নিরাকরণীয়। ৩৯

ক্ষোভ এবং গৰ্ব ব্যতীত, কাম প্রভৃতি অপর কয়েকটির–যথাকালে কিছু কিছু ব্যবহার করা যাইতে পারে। ৪০

রাজাদিগের তেজই সূর্যের ন্যায় তীব্র; গৰ্ব্ব তাহার রোগ, অতএব রোগ যুক্ত দেহের ন্যায় গৰ্ব্বমিশ্রিত তেজকে পরিত্যাগ করিবে। ৪১

মৃগয়াসক্তি, দ্যূতক্রীড়া, অত্যন্ত স্ত্রী-সম্ভোগ, পানদোষ, অর্থদূষণ, বাক পারুষ্য এবং দণ্ডপারুষ্য–রাজা এই সাতটি দোষ পরিত্যাগ করিবে। পরস্ত্রীতে কিংবা অননুরক্তা নিজ-স্ত্রীতেও কখনই আসক্ত হইবে না। ৪২-৪৩

 

তবে আপনার অনুরাগিণী সাধ্বী পত্নীতে অনুরূপ সময়ে উপগত হইবে। রতিক্রীড়া ও পুত্রোৎপত্তি ভাৰ্যা করিবার ফল, অতএব সতী নিজ ভাৰ্য্যাকে একেবারে পরিত্যাগ করিবে না; প্রত্যুত ঐ দুই প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য সময়ে আসক্ত হইবে, কিন্তু অতিশয় আসক্ত হইবে না। ৪৪

মৃগয়াতে অত্যাহিত হইবার বিশেষ সম্ভাবনা, অতএব মৃগয়া রাজার সতত পরিহার্য; আর সৎকাৰ্য-শক্তি-নাশক দ্যূতক্রীড়াও সৰ্ব্বতভাবে পরিত্যাজ্য। ৪৫

তবে অপরে দ্যূতক্রীড়া করিতেছে, রাজা কদাচিৎ তাহা দেখিতে পারেন। কিন্তু স্বয়ং কদাচ খেলিবেন না। ৪৬

দ্যূতক্রীড়ার ন্যায় কুকার্যের মূল এবং কৰ্মনাশক আর কিছুই নাই। গূঢ় মন্ত্রণা পান দোষে অযথাকালে প্রকাশ হইয়া পড়ে, অসময়ে অকারণে কলহ উপস্থিত হয়। ৪৭

সৎকাৰ্য, শৌচ এবং মঙ্গল বিনষ্ট হয়, অতএব পানদোষ সৰ্ব্বতভাবে পরিহার করিবে। প্রাণক্ষয়কর অর্থ-দূষণ সতত পরিত্যাজ্য। ৪৮

অভিশস্ত, চোর, হত্যাকারী এবং আততায়ীদিগের উপরে, নরপতি সতত দণ্ডপারুষ্য করিবেন। কিন্তু হে নৃপবর! অন্যত্র দণ্ডপারুষ্য করা রাজার অনুচিত। রাজা বাক্যপারুষ্য (কটুবাক্য-প্রয়োগ) কখনই কাহারও প্রতি করিবেন না। ৪৯-৫০

সতত সত্য পালন করিবেন; সত্যই একমাত্র অবলম্বনীয়। রাজা কাৰ্য্য বুঝিয়া ক্ষমা এবং তেজস্বিতা অবলম্বন করিবেন। ৫১

যান, স্থিতি, আশ্রয়-গ্রহণ, দ্বৈধ, সন্ধি এবং বিগ্রহ এই ছয়টি গুণ সতত অভ্যাস করিবেন; যে স্থানে যে গুণ অবলম্বনীয়, তাহাও স্থির করিবেন। ৫২

যে ব্যক্তি স্থান, বৃদ্ধি, ক্ষয়, কোষ, জনপদ এবং দণ্ডের পরিমাণাদি না বুঝে, সে রাজা রাজ্য শাসনে অনুপযুক্ত। ৫৩

কোষ জনপদ এবং দণ্ড এতৎসম্বন্ধীয় এক একটি কার্যে তিন তিন জনকে নিযুক্ত করিবে। আর একজনকে এই সকল কার্যে চিরস্থায়ী করিয়া রাখিবে না। ৫৪

মিত্র হউক, শত্রুই হউক, আর উদাসীনই হউক,-প্রভাব ত্রিবিধ ব্যক্তিকেই দেখাইবে। রাজারা জিগীষা, ধর্মকাৰ্য, অষ্টবর্গ এবং শরীর-যাত্রা-নিৰ্বাহেও উৎসাহ-সম্পন্ন হইবেন। ৫৫-৫৬

মন্ত্র, শস্ত্র, রাজ্য, পুত্র এবং অন্তঃপুর এই সকল বিষয়ে মন্ত্রণাপূৰ্ব্বক বুদ্ধি চালনা করিবে। ৫৭

কৃষি, দুর্গ, বাণিজ্য, সেতু-বন্ধন, গজ-বাজি বন্ধন; খনি-আকরাধিকার, করগ্রহণ এবং শূন্যনিবেশন চর-শুন্যাদি স্থানে চরাদিস্থাপন–ইহা অষ্টবর্গ। এই অষ্টবর্গে চর নিয়োগ করিবে। ৫৮-৬০

এই অষ্টবর্গে নিযুক্ত ব্যক্তিদিগের কাৰ্যাকাৰ্য্য পরিজ্ঞানের জন্য আটজন চর নিযুক্ত করিবে। ৬১

অন্য যে দশ বিষয়ে চর নিয়োগ করিবে, যথাক্রমে তাহা শ্রবণ কর; রাজা, অমাত্য, রাজচক্র, মিত্র, কোষ, সৈন্যসামন্ত এবং দুর্গ–রাজ্যের এই গুরুকথিত সপ্তাঙ্গ। ৬২

অষ্টবর্গের মধ্যে দুর্গের কথা একবার বলা হইয়াছে, এবং আপনার প্রতিও চর প্রয়োগ করিতে হইবে না;–সুতরাং সপ্তাঙ্গের মধ্যে পঞ্চাঙ্গে চর প্রয়োগ করিবে। ৬৩

অন্তঃপুর, নিজপুত্র, মাল্য-পূগাদি, পাকশালা এবং শত্রু ও উদাসীনের বলাবল পরীক্ষা এই পাঁচবিষয়ে–সৰ্বশুদ্ধ এই অষ্টাদশ বিষয়ে চর প্রয়োগ করিবে। ৬৪-৬৫

যাহা গোপনে জানিতে ইচ্ছা হইবে, তদ্বিষয়েই চর প্রয়োগ কর্তব্য। চর মুখে অবগত হইয়া প্রতিকাৰ্য বিষয়ের অবশ্য প্রতিকার করিবে। ৬৬

নিযুক্ত চর, নিয়োগের অন্যথাচরণ করিতেছে জানিতে পারিলে, রাজা তাহাকে উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত করিয়া অধিকারচ্যুত করিবেন। ৬৭

মন্ত্রিসমেত রাজা, প্রদোষকালে নির্জনস্থানে বসিয়া চরদিগকে বিবরণ জিজ্ঞাসা করিয়া তৎক্ষণাৎ তদনুসারে কাৰ্য্য করিবেন। ৬৮

নিজপুত্র, অন্তঃপুর, মহানস (পাকশালা) এবং মন্ত্রীর প্রতি যে সকল চর নিযুক্ত থাকিবে, রাজা নিশীথকালে তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিবেন। ৬৯

এই সকল চরকে রাজা মন্ত্রীব্যতীত একাকীই পরিদর্শন করিবেন। রাজা, অন্য চরদিগকে মন্ত্রীর সহিত পরিদর্শন করিয়া ফলাফল নির্দেশ করিবেন। ৭০

একবেশধারী, উৎসাহ-বর্জিত, সৰ্বত্ৰ পরিচিত, অতিদীর্ঘাকৃতি, খৰ্বাকার, সতত দিবাচারী, বেগসম্পন্ন, নির্বুদ্ধি, ধন-সম্পত্তি-হীন, পুত্ৰদার-বর্জিত ব্যক্তিদিগকে গোপনীয় সংবাদ জানিবার জন্য রাজা চর নিযুক্ত করিবেন না। চর একজন রাখিবেন না। ৭১-৭৩

বহুদেশতত্ত্ববিৎ, বহুভাষাভিজ্ঞ, পরাভিপ্ৰায়বেত্তা, দৃঢ়ভক্তি, সমর্থ ও নির্ভয় ব্যক্তিকে চর নিযুক্ত করা উচিত। ৭৪

রাজা–কৃষিকৰ্ম্ম, বাণিজ্য এবং দুর্গাদিতে তত্তদ্বিষয়ে সুদক্ষ আত্মসদৃশ চর দিগকে নিযুক্ত করিবেন। ৭৫

অন্তঃপুরে, বৃদ্ধ বীর পিতৃতুল্য পুরুষদিগকে, বিচক্ষণ ষণ্ঢ-পণ্ড (খোজা) দিগকে এবং সুবুদ্ধি সুপণ্ডিতা বৃদ্ধা রমণীমণ্ডলীকেও চর নিযুক্ত করিবে। ৭৬

রাজা, কদাচ একাকী শয়ন বা ভোজন করিবেন না; একাকী মলত্যাগ করিতে যাইবেন না বা একাকিনী মহিষীর নিকট একাকী যাইবেন না। রাজা, নিজ মনের সন্তোষ হওয়া পর্যন্ত মন্ত্রী, ভাৰ্যা ও পুত্রদিগকে সতত উপধা-শুদ্ধ করিবেন। ৭৭-৭৮

প্রত্যেক পরিশুদ্ধ ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ–চতুৰ্বর্গ সেবার নামই উপধা। ভাৰ্যা ও পূত্রদিগকে অর্থ কাম-উপধাদ্বারা, ব্রাহ্মণদিগকে ধর্ম-উপধাদ্বারা এবং মন্ত্রীদিগকে সকল উপধাদ্বারা শুদ্ধ করিবে। ৭১-৮০

এই সকল কাৰ্য্য, যজ্ঞ এবং দানাদিদ্বারা রাজা পুণ্যভাগী হইবে; অতএব রাজ্যার্থী তুমিও এইরূপ ধৰ্ম্মাচরণ কর। ৮১

রাজনীতি - কালিকা পুরাণ

এই রাজধর্ম, অশ্বমেধাদি যজ্ঞ, মন্ত্রণা, চরপ্রেরণাদি কাৰ্য–যে রাজার নাই, অবিলম্বে তাঁহার রাজ্যচ্যুতি এবং প্রাণত্যাগ ঘটে সন্দেহ নাই। অতএব হে সাধুবর! তুমি এ সকল কার্য করিতে থাক। ৮২-৮৩

রাজা এইরূপ মন্ত্রণা করিয়া দৈবজ্ঞ ব্রাহ্মণদিগকে গোপনে আনিয়া এবং প্রকৃতি পর্যালোচনা করিয়া লোকের মন বুঝিতে চেষ্টা করিবেন। ৮৪

মন্ত্রী যদি রাজ্যাভিলাষী হইয়া রাজা হইতে অধিক ধর্মাচরণ করেন, তাহা হইলে, রাজা তাঁহার ধর্মাচরণে ব্যাঘাত করিবেন। ৮৫

রাজার বিরুদ্ধে অভিচার কার্য করিলে, রাজা তাহার প্রাণদণ্ড করিবেন; ব্রাহ্মণ এরূপ করিলে রাজা তাহাকে নির্বাসিত করিবেন। ৮৬

ইহার নাম ধর্মোপধা; পুত্র ও মন্ত্রীদিগকে ইহার দ্বারা জয় করিবে। এতাদৃশ অন্য উপধাও রাজা, ধর্মত আশ্রয় করিবেন। ৮৭

মন্ত্রী বা মন্ত্রণা-গোপন-ক্ষম রাজপুত্র বসিয়া আছেন, এমন সময় রাজার নিয়মমত কোষাধ্যক্ষ আসিয়া বলিবে। ৮৮

এই প্রচুর ধন আপনার আয়ত্ত রহিয়াছে, অনুমতি করেন ত লইয়া আসি, আপনার অধীনে আমাদিগেরও জীবন নির্বাহ হইবে। এ প্রচুর ধন দ্বারা আপনিও যাহা ইচ্ছা করিতে পারেন। রাজা কোষসম্বন্ধীয় এই উপায় দ্বারা পুত্র এবং মন্ত্রীদিগকে পরিশোধিত করিবেন। ৮৯-৯১

কোষ-হানিকর ব্যক্তিদিগের প্রাণদণ্ড করিবেন, কিংবা নির্বাসিত করিবেন। কোষ-হানি করি কি–না করি এইরূপ বিতর্কিতচিত্ত ব্যক্তিকে অধিকারচ্যুত করিবেন এবং কোষরক্ষণে যত্ন করিবেন। ৯২

যে সকল বৃদ্ধা বিচক্ষণা দাসী ও শিল্পিনীগণ, মন্ত্রী প্রভৃতির জ্ঞাতসারে অন্তঃপুরে ও বাহিরে গতিবিধি করে। ৯৩

রাজা নির্জনে ভাৰ্য্যাদির অলক্ষ্যে, তাহাদিগকে বলিয়া-কহিয়া মন্ত্রীদিগের নিকট পাঠাইবেন। ৯৪

তাহারা গিয়া ইহাদিগের মন বুঝিবে; বলিবে, রাজমহিষী প্রভৃতি সুন্দরীগণ, তোমার প্রতি অনুরক্তা হইয়াছে। ৯৫

তোমার যদি ইচ্ছা থাকে ত বল, আমি ঘটনা করিয়া দিতে পারি। আবার রাজমহিষী-প্রভৃতিকে বলিবে, বরবৰ্ণিনি! মন্ত্রী তোমার প্রতি অনুরক্ত। ৯৬

যদি ইচ্ছা হয় ত বল, আমি তাঁহার সহিত তোমার মিলন করাইয়া দিতে পারি। ৯৭

রাজা, এইরূপ উপায় এবং অন্য উপায় দ্বারা ভাৰ্য্যা, কন্যা, পৌত্রী, স্নুষা ও পৌত্রবধূদিগকে এবং মন্ত্রী, পুত্র, পৌত্র ও সেবকদিগকে বিশুদ্ধ কি না জানিবে। ৯৮

ইহার মধ্যে যে সকল স্ত্রী-পুরুষ কামোপধাতে অশুদ্ধ, অবিবাদে তাহাদিগকে প্রাণদণ্ড করিবে। ব্রাহ্মণ হইলে নির্বাসিত করিবে। ৯৯

মোক্ষমার্গাসক্ত হিংসা-পৈশুন্যবর্জিত ক্ষমা-সৰ্বস্ব মন্ত্রীকে রাজা পরিত্যাগ করিবেন। ১০০

মোক্ষ-মার্গাসক্ত ব্যক্তি, দণ্ডের উপযুক্ত হইলেও তাহাকে রাজা দণ্ডিত করিবেন না; কারণ মোক্ষমার্গাসক্ত ব্যক্তি সর্বত্র সম-বুদ্ধি। ১০১

উপধার এই সূত্র। উশনা অনেক প্রকার উপধার বিষয় বিবেচনা করিয়াছেন; তৎসমস্ত ঔশনস শাস্ত্রেই জ্ঞাতব্য। ১০২

ভূমিসম্পত্তি এবং মিত্রলাভ বহুতর হইবে,–নিশ্চয় থাকিলেই শত্রুর সহিত যুদ্ধ করিবে। ১০৩

নচেৎ অন্য উপায় অবলম্বনই শ্রেয়স্কর। সপ্তাঙ্গের পরস্পর সম্ভাব, কোয় সঞ্চয় ও কোষ-রক্ষা, নৃপশ্রেষ্ঠগণের সর্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। ১০৪

রাজা, বহুবিদা-বিশারদ, বিনীত, সৎ-কুলোদ্ভব, ধৰ্মার্থ-কুশল, সরল চিত্ত ব্রাহ্মণদিগকেই মন্ত্রিপদে নিযুক্ত করিবেন। ১০৫

যথাকালে তাহাদিগের মধ্যে কাহারও কাহারও সহিত মন্ত্রণা করিবেন। অনেকের সহিত মন্ত্রণা এবং সর্বদা মন্ত্রণা করা নিষিদ্ধ। ১০৬

বিশেষ আবশ্যক হইলে, একবার একজনের সহিত আর একবার আর এক জনের সহিত-এইরূপে সকল মন্ত্রীর সহিতই মন্ত্রণা করিয়া লইবেন। অন্যের ছল করিয়া একেবারে সকলের সহিত মন্ত্রণাও করিতে পারেন। ১০৭

অত্যন্ত গোপনীয় এবং সুরক্ষিত গৃহে কিংবা উপদ্রব নির্জন অরণ্যে গিয়া মন্ত্রণা করা উচিত; রাত্রিতে মন্ত্রণা করা নিষিদ্ধ। মন্ত্রণাস্থলে, বালক, বানর, নপুংসক, শুক-সারিকা, এবং বিকৃত মনুষ্যদিগকেও আসিতে দেওয়া নিষেধ। ১০৮

রাজাদিগের গূঢ় মন্ত্রণা প্রকাশ পাইলে যে দোষ হয়, তাহার প্রতিকার করা সুদক্ষ শত শত রাজারও সাধ্য নহে। ১০৯

রাজা দণ্ডনীয় ব্যক্তিদিগকে দণ্ডিত করিবেন, অদণ্ডনীয় ব্যক্তিদিগকে দণ্ডিত করিবেন না। রাজা, দণ্ডার্হব্যক্তির দণ্ড না করিলে বা অদণ্ডনীয় ব্যক্তির দণ্ড করিলে অকীর্তি প্রাপ্ত হন এবং চোর-পাপে পাপী হইয়া থাকেন। ১১০-১১১

রাজা–প্রাকার, অট্টালিকা ও তোরণ দ্বারা ভূষিত দুর্গ-নগরের অদূরে প্রস্তুত করাইবেন। ১১২

নগর যদি কোনরূপ শত্ৰুকর্তৃক আক্রান্ত হয়, তাহা হইলে দুর্গমধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করা রাজার কর্তব্য। দুর্গ, রাজাদিগের প্রধান সহায়; দুর্গের প্রশংসা সর্বত্রই আছে। দুর্গস্থিত একজন ধনুর্ধারী অন্য স্থানস্থিত একশত লোকের সহিত এবং দুর্গস্থিত একশত লোক অন্য স্থানের দশসহস্র লোকের সহিত যুদ্ধ করিতে পারে, এইজন্য দুর্গের এত প্রশংসা। ১১৩-১৪

জলদুর্গ, ভূমিদুর্গ, বৃক্ষদুর্গ, বনদুর্গ, মরুদুর্গ এবং পৰ্বত-দুর্গ এই ষড়বিধ দুর্গ। সকল দুর্গেরই শেষে পরিখা করিতে হয়। ১১৫

এই ষড়বিধ দুর্গের মধ্যে দেশানুসারে যে কোন দুর্গ করিতে পারে। পার্বত্যদেশে সুবিধা হইলে পৰ্বত-দুর্গ, মারব দেশে মরুদুর্গ ইত্যাদি। দুর্গ করিতে হইলে, নগর ধনুর ন্যায় ত্রিকোণ, গোল বা চতুষ্কোণ করিবে, অন্যরূপ দুর্গ করিবে না।১১৬

মৃদঙ্গাকার দুর্গ, কুল-নাশক; রাক্ষসরাজের লঙ্কাদুর্গ মৃদঙ্গাকৃতি ছিল। ১১৭

বলিরাজের নগর শোনিতপুর–তোয়োময় দুর্গে প্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু ব্যজনাকৃতি ছিল, এই জন্য বলি শ্রীভ্রষ্ট হন। ১১৮

রাজন! শাল্বরাজের যে পঞ্চকোণ সৌভনগর আকাশে রহিয়াছে, তাহাও ভ্রষ্ট হইবে। ১১৯

রাজন্! ইক্ষাকুবংশীয় রাজাদিগের এই অযোধ্যানগর ধনুর ন্যায় ত্রিকোণ, এই জন্য ইহা ভূরি-জয়প্রদ। ১২০

রাজা, দুর্গ-ভূমিতে দুর্গাদেবীকে দুর্গদ্বারে দিপালগণকে,–যথাবিধি পূজা করিলে জয় লাভ করেন। ১২১

এই জন্য রাজা, জয়-বৃদ্ধি কামনায় দুর্গ সন্নিবেশিত করেন। রাজা, কদাচ ব্রাহ্মণের অবমাননা করিবেন না। ১২২

ব্রাহ্মণের অবমাননা করিলে রাজা পরলোকে দুঃখভাগী হইবেন। ব্রাহ্মণের সহিত বিরোধ বা ব্রাহ্মণের ধন হরণ করা রাজার অকৰ্ত্তব্য। ১২৩

রাজা তাহাদের কার্যশেষে সমুচিত সম্মানে সন্তোষিত করিবেন এবং ইহাদের নিন্দা অথবা দ্বেষ আচরণ করিবেন না। ১২৪

এই প্রকার স্বীয় বুদ্ধি-কৌশলে স্বপরাদিমশুল পরিবৃত হইয়া, সাবধান গূঢ়দূত দ্বারা সৰ্ববার্তাবিং গুণবান্ মিষ্টভাষী ভাগ্যশালী নৃপতি,-প্রত্যহ তোমার ন্যায় অতুল ঐশ্বর্যের ঈশ্বর হন। ১২৫

এবং নিজের সদগুণসমূহ পুত্রে উপদেশ করেন। সেই পুত্র পৃথিবীপতি হইলেও তাহাকে স্বাধীন হইয়া কোন কার্য করিতে নিবারণ করা উচিত। ১২৬

যেহেতু রাজপূত্র স্বতন্ত্র হইলেই কামাদিদ্বারা অবস্থান্তর লাভ করে। সঙ্গদোষে চিত্তের বিকার জন্মে বলিয়া নীতিবিজ্ঞ বৃদ্ধমণ্ডলীর মধ্যে সর্বদা যুবরাজকে অবস্থাপিত করিবেন। ১২৭

পৃথিবীপতি অতিভোজন, রমণ, সুরাপান, বহুজনতা এবং ইচ্ছানুরূপ কাৰ্য্যে-সদাচার বিযোজিত করিবেন। পৃথিবীপতি স্ত্রীগণকে সর্বদা অস্বতন্ত্র করিবেন। ১২৮

স্ত্রীগণ যদি স্বতন্ত্র হইয়া কাৰ্য্য করে, তাহা হইলে মহৎ অনিষ্টের সম্ভাবনা হয়। অতএব রাজা, সুন্দর ধর্ম এবং অর্থকাম প্রভৃতি দ্বারা পুত্র এবং পত্নীকে সংশোধিত করিয়া যৌবরাজ্য এবং অন্তঃপুরে নিয়োগ করিবেন। ১২৯-৩০

ভূপতি, পুত্র এবং পত্নীকে বহিঃপ্রদেশে এবং অন্তঃপুরে স্বতন্ত্র হইয়া কোন কাৰ্য্য করিতে দিবেন না। ১৩১

রাজনীতি - কালিকা পুরাণ

আমি সংক্ষেপে রাজধর্ম বিশেষ বর্ণন করিলাম এবং রাজপুত্রের গুণবর্ণন প্রসঙ্গে মহিষীগণের আচার বলিলাম। ১৩২

শুক্র এবং বৃহস্পতি রাজনীতি-তন্ত্রের স্রষ্টা, ইহারা যে সকল রাজনীতি শাস্ত্ৰ নিৰ্মাণ করিয়াছেন, তাহাতে অন্য বিষয় বিশেষরূপে বর্ণিত আছে। ১৩৩

এই প্রকারে পৃথিবীপতি রাজনীতিতে বিশেষ বিজ্ঞ হইলে কোন ক্লেশ অনুভব করেন না এবং অতুল ঐশ্বর্যের ঈশ্বর হন। ১৩৪

চতুরশীতিতম অধ্যায় সমাপ্ত। ৮৪

আরও পড়ুনঃ

নরকাসুরের উপাখ্যান – কালিকা পুরাণ

কালিকা পুরাণ

Leave a Comment