আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় শ্রীচৈতন্য জন্ম-অধ্যাপনা
Table of Contents
শ্রীচৈতন্য জন্ম-অধ্যাপনা
জন্ম ও বাসস্থান
পাঁচ’শ বছরেরও আগের কথা। ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্য জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতার নাম শচীদেবী। এঁদের উভয়েরই পৈত্রিক নিবাস বর্তমান বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলায়। জগন্নাথ মিশ্র বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ । বিদ্যা শিক্ষার জন্য তিনি শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপে আসেন।
শিক্ষা শেষ করে স্থায়ীভাবে সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। জগন্নাথ মিশ্র ছিলেন অতিশান্ত প্রকৃতির ও ধার্মিক পুরুষ। তার স্ত্রী শচীদেবীও ছিলেন পরম ভক্তিমতী রমণী। ভগবদ্ভাবে বিভোর হয়ে একদিন যখন গঙ্গাস্নান করছিলেন তখন অলৌকিকভাবে গঙ্গার স্রোতের বিপরীত দিক থেকে একটি তুলসীপত্র ভাসতে ভাসতে এসে শচীদেবীর নাভি স্পর্শ করে। এ ঘটনার কিছুদিন পর তাঁর গর্ভে এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এই ছেলেই পরবর্তীকালের শ্রীচৈতন্য ।
শ্রীচৈতন্যের বাল্যনাম নিমাই। কারও মতে তিনি নিম গাছের খ্রীষ্টচক্র জন্মেছিলেন বলে তাঁর নাম হয় নিমাই। আবার কেউ কেউ মনে করেন, শচীদেবীর আটটি কন্যা সন্তান মারা যাওয়ায় তিনি যমের মুখে নিম-তেতো দেবার জন্য ছেলের নাম রাখেন নিমাই।
অন্নপ্রাশনের সময় তাঁর সোনার বরণ দেহ দেখে নাম রাখেন গৌরাঙ্গ। সন্ন্যাস গ্রহণ করে গৌরাঙ্গ হলেন শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বা শ্রীচৈতন্য। আবার ইনিই ভক্তের কাছে নবদ্বীপচন্দ্র, মহাপ্রভু, শ্রীগৌরাঙ্গ সুন্দর।
সামাজিক অবস্থা
শ্রীচৈতন্য যখন আবির্ভূত হন তখন এ দেশের সামাজিক অবস্থা ভাল ছিল না। হৃদয়বান মানুষের, বড়ই অভাব ছিল। দেশে ধনৈশ্বর্য ছিল, বিদ্যাবত্তা ছিল, পাণ্ডিত্যও ছিল, ধর্মতত্ত্বের আলোচনাও ছিল। কিন্তু জীবনে সে সব জ্ঞানের অনুভব ছিল না। ফলে ধর্ম শুধুমাত্র কতকগুলো প্রাণহীন আচার- অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’– অর্থাৎ জগতের সব কিছুই ব্ৰহ্ম এ কথার পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দেবার লোকের অভাব ছিল না।
হয়তো দেখা গেল যে পণ্ডিত প্রবর এই মন্ত্রের সারগর্ভ বক্তৃতা দিলেন, তিনিই স্নান করে জল বা শালগ্রাম নিয়ে যাবার সময় অন্যের স্পর্শ এড়িয়ে চলছেন। আপনি যদি তাঁকে ছুঁয়ে দেন, অমনি তিনি বলে উঠলেন, “তুমি আমায় ছুঁয়ে দিলে কেন? আমার গঙ্গা, আমার শালগ্রাম অপবিত্র হল ইত্যাদি।” ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’ এই মন্ত্র যে জীবনে আচরণের মধ্যে রূপ দিতে হবে, এ কথা পণ্ডিত মশায়ের মনে নেই।
এরূপ অবস্থায় জাতিভেদের কুসংস্কারে সমাজের নীচ শ্রেণীর লোকেরা উচ্চ শ্রেণীর লোকদের হাতে নির্যাতিত হয়ে দলে দলে অন্য ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ প্রবল হয়েছিল, কিন্তু ছিল না মানুষে মানুষে ভালবাসা বা প্রেম। সেই মরণোনুখ জাতিকে বাঁচাবার জন্য নাম-প্রেম নিয়ে নদীয়ায় অবতীর্ণ হলেন শ্রীচৈতন্য ।

শিক্ষা ও পাণ্ডিত্য
পিতা-মাতার স্নেহ-যত্নে দুরন্ত বালক নিমাই বড় হতে লাগলেন। কিন্তু তার দুরন্তপনা কমছে না। এদিকে মাত্র দশ-এগার বছর বয়সেই তাঁর পিতা মারা যান। বালক নিমাইকে নিয়ে শচীদেবীর চিন্তার অন্ত নেই। নিমাইয়ের শিক্ষা-দীক্ষার সমগ্র দায়িত্ব এসে পড়ে বিধবা মায়ের ওপর। গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে পড়েন নিমাই।
অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ব্যাকরণ, অলঙ্কার প্রভৃতি শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করলেন। তারপর নিজেই টোল খুলে অধ্যাপনার কাজ শুরু করলেন। ছাত্র-মহলে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগল ।
“নিমাই পণ্ডিত অধ্যাপক শিরোমণি।
সর্ব নবদ্বীপে সর্বলোকে হৈল ধ্বনি।।”
নিমাইকে বিয়ে দিতে মা শচীদেবী উপযুক্ত পাত্রী খুঁজছেন। বল্লভাচার্যের সুলক্ষণা কন্যা লক্ষ্মীদেবীকে তাঁর পছন্দ হল। শচীদেবী যৌতুকপত্রের কোন কথা তুলবেন না। পণপ্রথার বিষবৃক্ষের মূলে কুঠারঘাত করলেন তিনি। শুভক্ষণে লক্ষ্মীদেবীর সাথে নিমাই পণ্ডিতের বিয়ে হয়ে গেল। নিমাই পণ্ডিতের মধ্যে যে এক অলৌকিক প্রতিভা রয়েছে তা একদিন হঠাৎ প্রকাশ হয়ে পড়ে।
ঘটনাটি ঘটে কাশ্মীরের প্রখ্যাত পণ্ডিত কেশব মিশ্রকে নিয়ে। কেশব মিশ্র কাশী, কাঞ্চী, নালন্দা প্রভৃতি স্থানের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদেরকে শাস্ত্র বিচারে পরাস্ত করেছেন। এবার তিনি উপস্থিত হয়েছেন নবদ্বীপে। এখানে এসে তিনি সগর্বে পণ্ডিতদেরকে বললেন, “হয় তর্ক বিচার করুন, না হয় জয়পত্র লিখে দিন।” তাঁর পাণ্ডিত্যের কথা শুনে নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজ বেশ কিছুটা ভীত হয়ে পড়েন।
অবশেষে দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতের সামনে এসে দাঁড়ালেন তরুণ পণ্ডিত নিমাই। গঙ্গাতীরে দু’জনের মধ্যে আলাপ পরিচয় হল। নিমাই পণ্ডিতের অনুরোধে কেশব মিশ্র তৎক্ষণাৎ ঝড়ের গতিতে স্বরচিত শতাধিক শ্লোকে গঙ্গাস্তোত্র বলে গেলেন। তখন নিমাই পণ্ডিত আরম্ভ করলেন পণ্ডিতপ্রবর কেশব মিশ্রের শ্লোকগুলোর সমালোচনা। শব্দ ও ভাবের অশুদ্ধি, ভুল অলঙ্কার প্রয়োগ সবকিছু ত্রুটি দেখিয়ে দিলেন নিমাই।
দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। তিনি নিমাই পণ্ডিতের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নবদ্বীপ ছেড়ে চলে গেলেন। এই ঘটনার পর নবদ্বীপে নিমাই পণ্ডিতের প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক বেড়ে যায়। কিছুদিন পর নিমাই একবার পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে আসেন। ভ্রমণ শেষ করে নবদ্বীপে ফিরে গিয়ে শোক সংবাদ পেলেন; স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী সর্প দংশনে মারা গেছেন।
স্ত্রীর মৃত্যুতে নিমাই শোকাভিভূত । সংসার তাঁর কাছে ভাল লাগছে না। ধীরে ধীরে তাঁর মধ্যে ধর্মানুরাগ প্রবল হয়ে উঠতে লাগল। শচীদেবী পুত্রকে সংসারের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য সনাতন পণ্ডিতের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে নিমাইয়ের বিয়ে দিলেন। সংসারে পুনরায় শান্তি ফিরে এল।
সারাংশ
শ্রীচৈতন্য ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতা শচীদেবী। প্রতিভাবান নিমাই গঙ্গাদাস পণ্ডিতের চতুষ্পাঠীতে পড়াশুনা করার পর নিজেই টোল খুলে অধ্যাপনা করতে থাকেন। কাশ্মীরের দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত কেশব মিশ্রকে পাণ্ডিত্যের প্রতিযোগিতায় পরাভূত করায় নিমাই-এর পণ্ডিতের খ্যাতি বেড়ে যায়। প্রথম স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী সর্পাঘাতে মারা গেলে নিমাই পুনরায় বিষ্ণুপ্রিয়াকে বিয়ে করে সংসার করতে থাকেন।
আরও দেখুন :