আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় শ্রীরামকৃষ্ণ আদর্শ জীবনচরিত
Table of Contents
শ্রীরামকৃষ্ণ আদর্শ জীবনচরিত
শ্রীরামকৃষ্ণ আদর্শ জীবনচরিত
সময় ১৮৭৫ সাল। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এবার তিনি শুধুমাত্র সিদ্ধসাধক পুরুষ নন, তিনি হলেন লোকগুরু। দলে দলে লোক এসে ঠাকুরের নিকট শিক্ষাগ্রহণ করতে লাগল। কলকাতায় শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টিও পড়ল এদিকে। সমাজের একজন শ্রেষ্ঠ বক্তা কেশব সেন আসেন শ্রীরামকৃষ্ণের নিকটে। তার দেখাদেখি বিজয়কৃষ্ণ, প্রতাপ মজুমদার, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিও ঠাকুরের সান্নিধ্যে আসেন।
একদিন কেশব সেন দুঃখ করে ঠাকুরকে বলেন, “মশাই বলে দিন, কেন আমার ঈশ্বর দর্শন হচ্ছে না।” উত্তরে ঠাকুর সোজাসুজি বলে দিলেন, “লোকমান্য, বিদ্যা – এসব নিয়ে তুমি আছ কিনা, তাই হয় না। ছেলে চুষি নিয়ে যতক্ষণ চোষে ততক্ষণ মা আসে না। খানিক্ষণ পরে চুষি ফেলে দিয়ে যখন ছেলে চিৎকার করে তখন ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে মা ছুটে আসে।” শ্রীরামকৃষ্ণের লোকশিক্ষার পদ্ধতি ছিল অভিনব।
ভক্তের জিজ্ঞাসার উত্তরে ঠাকুর গল্পের মাধ্যমে অনেক জটিল তত্ত্ব সহজ-সরল কথায় ব্যক্ত করতেন। প্রেমের ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে তিনি বলেন, “কোন ধর্মেই ভুল নেই । আর যদি ভুল থাকে, যদি আন্তরিক হয়, যদি ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকে তা হলে তিনি শুনবেনই শুনবেন। মনে কর, এক বাপের ছোট-বড় অনেকগুলো ছেলে। সকলেই বাবা বলতে পারে না।
কেউ বলে ‘বাবা’ কেউ বলে, ‘বা’ কেউবা কেবল ‘পা’ বলে। যারা বাবা বলতে পারল না, তাদের উপর বাপ রাগ করবে নাকি? না, বাপ সকলকেই সমান ভালবাসবে। লোকে মনে করে আমার ধর্ম ঠিক। আমি ঈশ্বর কি বস্তু বুঝেছি। ওরা বুঝতে পারেনি। আমি ঠিক তাঁকে ডাকছি। ওরা ঠিক ডাকতে পারে না। এজন্য ঈশ্বর আমাকেই কৃপা করেন, ওদের করেন না।
এসব লোক জানে না ঈশ্বর সকলের বাপ-মা, আন্তরিক হলেই তিনি সকলকে দয়া করে থাকেন।” ঈশ্বর লাভের উপায় সম্বন্ধে ঠাকুর বলেন, “বিচার নয়, বিশ্বাস। তর্ক নয়, প্রেম। প্রেমেই সকল চাওয়া, সকল পাওয়ার শান্তি। বিচার বন্ধ হলেই দর্শন। তখনই মানুষ অবাক, সমধিস্থ। থিয়েটারে গিয়ে বসে লোকে নানা রকম গল্প করে, এ গল্প, সে গল্প। যেই পর্দা উঠে যায়, সব গল্প-টল্প বন্ধ হয়ে যায়। যা দেখে তাতেই মগ্ন হয়ে থাকে। বিচার যেখানে থেমে যায়, সেখানেই ব্রহ্ম।”
ঠাকুর বলেছেন, ঈশ্বর লাভের জন্য ব্যাকুলতা চাই, ব্যাকুলতাকে তিনি তিন টানের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, “তিন টান একসঙ্গে হলে তবে তাঁকে লাভ করা যায়। বিষয়ীর বিষয়ের প্রতি টান, সতীর পতির প্রতি টান, আর মায়ের সন্তানেতে টান। এই তিন ভালবাসা একসঙ্গে করে কেউ যদি ভগবানকে দিতে পারে তাহলে তৎক্ষণাৎ সাক্ষাৎকার হয়।”
এমনিভাবে প্রতিদিন শ্রীরামকৃষ্ণের লোকশিক্ষার কাজ চলতে থাকে। আর তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ফলে প্রবীণদের ন্যায় নবীনেরাও আসতে থাকে ঠাকুরের নিকটে। তরুণদলের মধ্যে আসেন নরেন্দ্র নাথ দত্ত। ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে তার মনে সংশয়। ঈশ্বর দর্শন করেছেন এমন একজন সাধকের সন্ধান করে ফিরছিলেন তিনি।
শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট এসে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “মশাই, আপনার কি ঈশ্বর দর্শন হয়েছে?” উত্তরে ঠাকুর বললেন, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই হয়েছে। তোকে যেমন দেখছি, তার চেয়েও স্পষ্ট দেখেছি। তুই যদি দেখতে চাস, তোকেও দেখাতে পারি।” নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃপায় ঈশ্বর দর্শন করে ধন্য হলেন এবং ঠাকুরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন।
এই নরেন্দ্রনাথ হলেন শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ স্বামীবিবেকানন্দ, যিনি দেশ-বিদেশে ঠাকুরের আদর্শ বাণী ‘যত মত তত পথ’, ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’ প্রচার করে গেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ শুধু উপদেশ দেন নি, তিনি নিজেও ঐ উপদেশ প্রতিপালন করতেন। তিনি অহংকার ত্যাগ করে জীবকে শিবজ্ঞানে সেবা করেছেন।
কালীবাড়ীর কাঙ্গালীদের দরিদ্র নারায়ণ জ্ঞানে নিজ হাতে ভোজন করিয়ে তিনি জীবসেবার আদর্শ স্থাপন করেন। এই মহাপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের ইহলীলা সংবরণের দিন ক্রমে ঘনিয়ে আসে। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট (১২৯৩ বঙ্গাব্দ, শ্রাবণ সংক্রান্ত) শ্রীরামকৃষ্ণ যাত্রা করলেন অমৃতধামের পথে ।
শ্রীরামকৃষ্ণের কয়েকটি উপদেশ
পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য বিষয়ে :
ক. পিতাকে ভক্তি কর, পিতার সঙ্গে প্রীতি কর। জগৎরূপে যিনি সর্বব্যাপী হয়ে আছেন, তিনিই মা। জননী, জন্মস্থান, বাপ-মাকে ফাঁকি দিয়ে যে ধর্ম করবে, তার ছাই হবে।
খ. মা গুরুজন, ব্রহ্মময়ীস্বরূপ। যতক্ষণ মা আছে, মাকে দেখতে হবে।
গ. মা যতদিন ছিলেন, নারদ ততদিন তপস্যায় যেতে পারেন নি। মার সেবা করতে হয়েছিল কিনা। মায়ের দেহত্যাগ হলে তবে হরিসাধন করতে বেরুলেন।
ঈশ্বর লাভের উপায় সম্বন্ধে:
ক. ঈশ্বর আছেন বলে বসে থাকলে হবে না। জো-সো করে তাঁর কাছে যেতে হবে। নির্জনে তাঁকে ডাকো, প্রার্থনা করো ।
খ. ঈশ্বর এক, তাঁর অনন্ত নাম ও অনন্ত ভাব। যার যে নামে ও যে ভাবে ডাকতে ভাল লাগে, সে সেই নামে ও সেইভাবে ডাকলে দেখা পায় ।
গ. আন্তরিক হলে সব ধর্মের ভেতর দিয়েই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। ঈশ্বরের কাছে নানা পথ দিয়ে পৌঁছান যায়। ‘যত মত তত পথ’
সারাংশ
শ্রীরামকৃষ্ণ একাধারে সিদ্ধ সাধক ও লোকগুরু। গল্পের মাধ্যমে সহজ কথায় তিনি ধর্মের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতেন। ঈশ্বর লাভের জন্য সাধককে আন্তরিক এবং ব্যাকুল হয়ে সাধনা করতে হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপায় নরেন্দ্র নাথ ঈশ্বর দর্শন করেন ও তাঁর শিষ্য হন। শিবজ্ঞানে জীবসেবা করতে হয়। পিতা-মাতাকে সেবা না করলে ধর্ম হয় না। গভীর আন্তরিকতা নিয়ে সাধনা করলে যে কোন সাধন পথেই ঈশ্বরকে লাভ করা যায়।
আরও দেখুন :