আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় হরিচাঁদ ঠাকুর অবতার ও আদর্শ
Table of Contents
হরিচাঁদ ঠাকুর অবতার ও আদর্শ
হরিচাঁদ ঠাকুর পূর্ণ অবতার
ঈশ্বর যুগে যুগে অবতার রূপে জন্মগ্রহণ করে থাকেন। হরিচাঁদ ঠাকুরও তেমনি একজন অবতার পুরুষ। তাঁর জন্মের পূর্বেই মা অন্নপূর্ণাদেবীর ভাবাবেশের কথা শুনে বাকসিদ্ধ সাধক রামকান্ত বলেছিলেন, “মা তোমার গর্ভে ব্রজের বাসুদেব আসছেন।” ঠিকই দেখা গেল যথাসময়ে অন্নপূর্ণাদেবীর গর্ভে বাসুদেব হরিচাদ রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। বাল্যকালেই হরিচাদের মধ্যে অলৌকিক শক্তির প্রকাশ ঘটে। আর যে শক্তি বলেই তিনি মানুষের কল্যাণ সাধন ও ধর্মসাধনার সহজ পদ্ধতি প্রবর্তন করে গেছেন। তাই ভক্তদের বিশ্বাস –
“রাম হরি কৃষ্ণ হরি হরি গোরাচাঁদ
সর্বহার মিলে এই পূর্ণ হরিচাঁদ।”
অর্থাৎ হরিচাঁদ ঠাকুর ভগবানের পূর্ণাবতার।
ঠাকুরের আদর্শ
হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর অনুসারীদেরকে সংসারী হয়ে ধর্মচর্চা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ঠাকুর নিজেও ছিলেন সংসারী। তাঁর ছিল দুই পুত্র ও তিন কন্যা। তাঁর পুত্র দুজনের নাম গুরুচরণ এবং উমাচরণ। ঠাকুরের অন্তর্ধানের পর গুরুচাঁদ এই সম্প্রদায়ের প্রধান রূপে পূজিত হন।সামাজিকভাবে ঠাকুর এদেশের নিম্নবর্ণের অবহেলিত সম্প্রদায় নমঃশূদ্রদের একতাবদ্ধ ও সনাতন ধর্মে একনিষ্ঠ থাকার প্রেরণা যুগিয়ে গেছেন।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর লোক যদিও ঠাকুরের অনুসারী হয়েছে তথাপি এদেশের নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের লোক বেশি করে ঠাকুরের মত এবং আদর্শের অনুসারী হয়ে চলেছে। ঠাকুরের জীবন ও আদর্শের বাণী নিয়ে হরিভক্ত তারকচন্দ্র সরকার রচনা করেছেন শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত নামক গ্রন্থ ।
শ্রীঠাকুরের অলৌকিক মহাপ্রয়াণ
হরিচাঁদ ঠাকুরের লীলাময় জীবন ক্রমেই শেষ হয়ে আসে। তিনি একদিন গোলক, হীরামন, তারক, মহানন্দ, দশরথ, ব্রজ, নাটু— এদের নিয়ে ঈশ্বরতত্ত্ব আলোচনা করছিলেন। হঠাৎ করে ঠাকুর ভক্তবন্দনার বাসনা ব্যক্ত করলেন। সকলেই বিস্ময়বোধ করে এ কাজ থেকে ঠাকুরকে বিরত থাকতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু ঠাকুর নাছোড়বান্দা। কোনমতেই ঠাকুরকে নিরস্ত করা গেল না।
তিনি উপস্থিত ঐ সাতজনের প্রত্যেককে এক একজন ঋষিকল্প ব্যাখ্যা দিলেন। তারপর ঠাকুর বাল্যলীলার ‘রাখাল রাজা’ ইত্যাদি স্মরণ করিয়ে দিয়ে নিজ হাতে সবার মাথায় ফুল রেখে আভূমি প্রণাম করলেন। ঠাকুরের উত্তরীয় উড়ে গিয়ে সকলকে স্পর্শ করল। ঠাকুরের পরশে এদের সকলেরই দিব্য দৃষ্টি লাভ হল।

তখন তাঁরা দেখতে পেলেন যে, শ্রীঠাকুরের ব্রহ্মতালু ভেদ করে এক মোহনীয় আলোকরশ্মি ঊর্ধ্বাকাশে চলে গেছে। আর রংধনুর সাতরঙে সাজানো দিব্য সিঁড়ি বেয়ে ঠাকুর অসংখ্য পার্ষদ নিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছেন। স্বর্গের দেবরাজ ইন্দ্র দেব-দেবী পরিবেষ্টিত হয়ে তাঁদের উপর করছেন পুষ্প বৃষ্টি। সেই পারিজাত পুষ্প কুড়াতে গিয়ে ভক্তবৃন্দ দেখলেন ঠাকুর নেই। সবাই শোকাকুল ।
ঠাকুরের মুখমণ্ডল দিব্যজ্যোতিতে হাস্যোজ্জ্বল হয়েই শোভা পাচ্ছে। বাংলা ১২৮৪ সনের ২৩শে ফাল্গুন বুধবার শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ৬৬ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।
হরিচাঁদ ঠাকুরের উপদেশ
হরিসাধনার দ্বাদশ আজ্ঞা:
ক. সদা সত্য কথা বলবে।
খ. পিতা-মাতাকে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করবে।
গ. নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে।
ঘ. জগৎকে প্রেম করবে।
ঙ. সকল ধর্মে উদার থাকবে।
চ. জাতিভেদ করবে না।
ছ. হরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে।
জ. প্রত্যহ প্রার্থনা করবে।
ঝ. ঈশ্বরে আত্মদান করবে।
ঞ. বহিরঙ্গে সাধু সাজবে না ।
ট. ষড়রিপু বশে রাখবে।
ঠ. হাতে কাম, মুখে নাম করবে।
২। গৃহেতে থাকিয়া যার হয় ভাবোদয়। সেই যে পরম সাধু জানিও নিশ্চয়।।
৩। কর্মক্ষেত্র সংসারেতে কর্ম মহাবল । সকলেই পায় কর্ম অনুযায়ী ফল ।
সারাংশ
ভগবান বাসুদেব অবতাররূপে হরিচাঁদ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর অলৌকিক শক্তির সামর্থ্য দেখে ভক্তগণ তাকে পূর্ণাবতার বলেন। হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুসৃত বৈষ্ণব ধর্মের নাম মতুয়াবাদ। সংসার ধর্ম রক্ষা করে হরিনাম ভজন-কীর্তনেই জীবের কল্যাণ। নাম ও নামী অভেদ। সত্য, প্রেম ও পবিত্রতা অনুশীলন করতে পারলে প্রেমময়ের কৃপালাভ সম্ভব।
তাঁর ভক্তদের মধ্যে নমঃশূদ্র শ্রেণীর লোকের সংখ্যাই বেশি। ১২৮৪ সালের ২৩শে ফাল্গুন ঠাকুর এক অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে ইহলীলা সংবরণ করেন। তাঁর জীবনাদর্শ ও বাণী অগণিত ভক্তকে সৎ ও ধার্মিক হয়ে জীবন যাপনে উৎসাহিত করছে।
আরও দেখুন :