হরিচাঁদ ঠাকুর

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় হরিচাঁদ ঠাকুর

হরিচাঁদ ঠাকুর

 

হরিচাঁদ ঠাকুর

 

হরিচাঁদ ঠাকুর

অনেক দিন আগের কথা। বাংলা ১২১৮ সালের ফাল্গুন মাস। কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশ তিথিতে মহা বারুণি স্নানের শুভদিনে শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ওড়াকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন। ওড়াকান্দি গোপালগঞ্জ জেলার একটি গ্রাম। এই গ্রামটি শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্তদের কাছে পবিত্র তীর্থস্থান। হরিচাঁদ ঠাকুরের পিতার নাম যশোমন্ত ঠাকুর। এবং মাতা অন্নপূর্ণা দেবী। পিতা যশোমন্ত ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব।

তাঁর গৃহে সাধু বৈষ্ণদেব সমাগম হত। মুখডোবা গ্রামের সাধু রামকান্ত প্রায়ই আসতেন এঁর বাড়িতে। ধর্মপ্রাণ রামকান্ত আচার-আচরণে ছিলেন বালকের মত সরল। যশোমন্তের স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবীকে তিনি মা বলে ডাকতেন। এই অন্নপূর্ণাদেবীর একদিন ভাবাবেশ হয়। তিনি দেখতে পান ব্রজের শিশুকৃষ্ণ যেন তাঁকে ‘মা’ ‘মা’ বলে ডাকছে। আর কোলে এসে পান করছে তাঁর বুকের দুধ। অন্নপূর্ণাদেবী স্বামীকে ঘটনাটি জানালেন ।

ঐ দিন দুপুরে সাধু রামকান্ত এসে উপস্থিত হয়েছেন যশোমন্ত ঠাকুরের গৃহে। অন্নপূর্ণাদেবীর ভাবাবেশে দেখা শ্রীকৃষ্ণের কাহিনী শুনে তিনি বললেন, “মা তোমার গর্ভে বাসুদেব জন্মগ্রহণ করবেন।” এই রামকান্ত ছিলেন বাক্যসিদ্ধ সাধক। যাকে যা বলতেন ঠিক ঠিক তা হয়ে যেত। অন্নপূর্ণাদেবীর ভাবাবেশ ও সাধু রামকান্তের ভবিষ্যদ্বাণী সার্থক করে বাসুদেব অন্নপূর্ণাদেবীর গর্ভে হরিচাঁদ রূপে জন্মগ্রহণ করেন।

হরিচাঁদ যশোমন্ত ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র। তাঁর প্রথম পুত্রের নাম কৃষ্ণদাস। এছাড়া বৈষ্ণবদাস, গোরীদাস ও স্বরূপদাস নামে তাঁর আরও তিন পুত্র ছিল। শৈশব থেকেই হরিচাঁদ ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির। তিনি বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন মাত্র কয়েক মাস। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সমুদয় বর্ণমালা ও গণিতের সংখ্যা শিখে ফেলেন তিনি। তাঁর ছিল প্রখর মেধা। কিন্তু বিদ্যালয়ের সীমিত গণ্ডীবদ্ধ পাঠ তার যেন ভাল লাগল না।

প্রকৃতির উদার আহ্বানে সাড়া দিলেন তিনি। বিদ্যালয় ছেড়ে নেমে এলেন মাঠে। রাখাল বন্ধুদের সাথে মিশে তিনি গোচারণ করেন, তাদের সাথে খেলাধুলা করেন। তাঁর যেমন ছিল দেহের সৌন্দর্য তেমন ছিল গানের গলা। মাঝে মাঝে ভজনগীতি শুনিয়ে মানুষকে আনন্দ দিতেন। রাখাল বালকদের কাছে হরিচাঁদ বড়ই প্রিয়। তারা তাঁকে ‘রাখাল রাজা’ বলে ডাকত ।

ঠাকুরের অলৌকিকত্ব

ঠাকুরের অলৌকিকত্ব সম্বন্ধে কিংবদন্তী আছে। রাখাল বালকদের মধ্যে ব্রজ, নাটু এবং বিশ্বনাথ ছিল তাঁর খুবই অন্তরঙ্গ। একদিন বিশ্বনাথকে মাঠে দেখা গেল না। নাটু বলল, বিশ্বনাথের বিসূচিকা রোগ হয়েছে, ভেদ বমি হচ্ছে। হরিচাঁদ আর দেরি করলেন না।

বন্ধুদের নিয়ে বিশ্বনাথের বাড়িতে গেলেন। বিশ্বনাথের মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “হরি, বিশা বুঝি আর বাঁচে না, আজ ছেড়ে যায় তাঁর বিশ্বনাথ।” তখন হরিচাঁদ বললেন, “আইলাম বিশারে কিনিতে।” এরপর তিনি বিশ্বনাথকে হাত ধরে টেনে তুলে বললেন, “চল গোষ্ঠে যাই।”

“এত বলি হস্ত ধরি বিশারে তুলিল।

নিদ্রাভঙ্গে যেন বিশে গোষ্ঠেতে চলিল।।”

এই ঘটনায় সবাই অবাক। বিশাকে নিয়ে সবাই গোষ্ঠে চলে গেলেন । এ ঘটনা থেকে হরিচাদের মধ্যে যে অলৌকিকত্ব রয়েছে তা প্রচার হয়ে গেল। নিরাময়ের আশায় দলে দলে রুগ্ন ব্যক্তি আসতে লাগল তাঁর কাছে। হরিচাঁদ ঠাকুরের চিকিৎসা পদ্ধতি কোন শাস্ত্রসম্মত চিকিৎসা ছিল না।

 

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

ঠাকুরের মতবাদ

শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর কোন নতুন ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করেন নি। শ্রীমন্‌মহাপ্রভু প্রবর্তিত প্রেম-ভক্তির ধর্মের প্রবহমান ধারাকে তিনি আরো সহজভাবে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই সহজ পথে প্রেম-ভক্তির সাধনার নাম ‘মতুয়াবাদ’। তাঁর অনুসারীদের বলা হয় মতুয়া।

মতুয়া শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়: হরিঠাকুরের নামে মৌতাত বা আমেজ এসেছে যার সেই মতুয়া। ভাষ্যকাররা বলেন, “হরিনামে যার আঁখি ঝরে, সাধু সঙ্গে যার প্রাণ ভরে এবং জীব প্রেমে যার হৃদয় গলে, সেই-ই মতুয়া।” এক কথায় আস্তিক মাত্রই মতুয়া ।

হরিচাঁদ সম্প্রদায়ের পরিচিতি

হরিচাঁদ সম্প্রদায়ের নাম মতুয়া সম্প্রদায়। এরা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। এই একেশ্বর বেদান্তের নিৰ্গুণ ব্রহ্ম নন। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত সগুণ ব্রহ্ম বা ভগবান। এই ভগবানকে লাভ করার উপায় হচ্ছে ভগবানের নাম করা। ‘যেই নাম সেই হরি, ভজ নিষ্ঠা করি’। নাম আর নামী অভেদ । তাই মতুয়া সম্প্রদায়ের ভজনের পথ হচ্ছে নামসংকীর্তন। তাদের বিশ্বাস ভক্তিতেই মুক্তি।

মতুয়াবাদের মূলকথা

মনুষ্যত্ব অর্জন, আত্মোন্নতি এবং সার্বিক কল্যাণ সাধন হচ্ছে শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তিত সাধন পথের মূলকথা। সত্য, প্রেম ও পবিত্রতা—এই তিনটি হচ্ছে মতুয়াবাদের স্তম্ভ। ঈশ্বরলাভ বা সত্যদর্শন হলো সাধনার লক্ষ্য। আর ঈশ্বর লাভের জন্য চাই প্রেম। প্রেমের পূর্বশর্ত হচ্ছে পবিত্রতা। পবিত্র দেহ—মনে প্রেমের উদয় হয়। তখন প্রেমিক ভক্তের হৃদয়ে প্রেমময় হরি জাগ্রত হন।

সারাংশ

গোপালগঞ্জ জেলার ওড়াকান্দি গ্রামে ১২১৮ সালে হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা যশোমন্ত ঠাকুর এবং মাতা অন্নপূর্ণাদেবী বৈষ্ণব ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। হরিচাদ শৈশব থেকেই ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির। হরিচাদের মধ্যে অলৌকিক শক্তির প্রকাশ ঘটে। তাঁর অনুসারীদের বলা হয় মতুয়া ।

 

হরিচাঁদ ঠাকুর

 

পবিত্র দেহ-মনে প্রেমের উদয় হয়। আর প্রেমপূর্ণ হৃদয়ে প্রেমময় হরি জাগ্রত হন। হরিনামে আঁখি ঝরে, সাধু সঙ্গে প্রাণ ভরে, জীবে প্রেমে যার হৃদয় গলে তিনি মতুয়া। পবিত্র দেহ-মনে প্রেমের উদয় হয়। আর প্রেমপূর্ণ হৃদয়ে প্রেমময় হরি জাগ্রত হন।

আরও দেখুন :

Leave a Comment