হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি

হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি – সম্পর্কে ড. আর এম দেবনাথ তার সিন্ধু থেকে হিন্দু বইতে লিখেছেন : কর্মরক্ষণ ও বর্ধনে রাষ্ট্র, ব্যক্তি, সমাজ, পুরোহিত শ্রেণি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা এক নয়। তবে তাদের ভূমিকা পারস্পরিকভাবে সম্পূরক। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোতে ধর্মের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা অবশ্য শূন্য না হলেও সীমাবদ্ধ। কিন্তু লক্ষণীয় রাষ্ট্র সেখানে ধর্মের সাথে কোনো সংঘর্ষে যায় না। রাষ্ট্র বরং ধর্মকে সমীহ করেই চলে। অপরদিকে ব্যক্তির ক্ষেত্রে মেয়েরাই সাধারণত স্ব স্ব গৃহে ধর্মের অনুশীলন নিশ্চিত করে। পুরুষ অনেক সময় রীতি-নীতি ও সংস্কার ইত্যাদিকে ভাঙতে চায়। এতে ঘরে ঘরে মেয়ে-পুরুষের মধ্যে এক ধরনের আপোষরফার প্রক্রিয়া চলে।

হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি | সিন্ধু থেকে হিন্দু | ড. আর এম দেবনাথ

অপরপক্ষে ধর্মচর্চা ও অনুশীলণে সমাজের ভূমিকা খবরদারির। বলা যায় চাপের। এই চাপ রাষ্ট্রের চাপের চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। তবে রাষ্ট্র, ব্যক্তি, সমাজ, পুরোহিত শ্রেণি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ধর্ম রক্ষা ও বর্ধনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পুরোহিত শ্রেণি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।

[ হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি | সিন্ধু থেকে হিন্দু | ড. আর এম দেবনাথ ]

প্রত্যেক ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক একটা দিক আছে। তাই ধর্মরক্ষা ও বর্ধনে প্রতিষ্ঠানগুলো একটা বড় সুযোগ পায়। বস্তুত প্রতিষ্ঠান ছাড়া ধর্মের অস্তিত্ব ও সম্প্রসারণ এর কোনোটাই কল্পনা করা যায় না। যে ধর্মের প্রতিষ্ঠান যত বেশি কার্যকর ও সর্বজনীন সেই ধর্মের রক্ষণ ও বর্ধন তত বেশি। সাধারণভাবে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পৃষ্টপোষক। ব্যক্তির মধ্যে ব্যবসায়ী (বৈশ্য) শ্রেণির পৃষ্টপোষকতাই বেশি লক্ষণীয়। অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিদেশি পৃষ্টপোষকও আছে। বিশেষ করে যে সব ধর্ম ধর্মান্তরকরণে বিশ্বাস করে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য না পেলে ধর্মের অবনমন ঘটে। এমনকি অবলুপ্তিও ঘটে ! আমাদের অঞ্চলে এর একটি বড় উদাহরণ বৌদ্ধধর্মের প্রায় বিলুপ্তি।

 

যে কয়টি কারণে বৌদ্ধধর্ম এ অঞ্চল থেকে প্রায় তিরোহিত হয়েছে এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা একটি। ইতিহাসে দেখা যায় সপ্তম শতাব্দী থেকে ভারতে বৌদ্ধ মঠ ও মন্দির রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। বাংলায় এটি ঘটে ত্রয়োদশ শতাব্দীর সেন আমল থেকে। এক পর্যায়ে বৌদ্ধ মঠ ও মন্দির নানা শ্রেণির শাসক দ্বারা আক্রান্তও হয়। এই প্রক্রিয়ায় বৌদ্ধ মঠ ও মন্দির অনেক ক্ষেত্রেই ধ্বংস হয়। আবার অনেক মঠ ও মন্দির অন্য ধর্মাবলম্বীদের করতলগত হয়।

বড় বড় ধর্মের ন্যায় হিন্দুদেরও পুরোহিত শ্রেণি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এগুলো একটু ভিন্ন। হিন্দুর পুরোহিত বা যাজক যেমন যে কেউ হতে পারে না, তেমনি তার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও সর্বজনীন নয়। হিন্দুদের পুরোহিত শ্রেণি জন্মগত ও বংশগতভাবে ব্রাহ্মণ। তার কারণ হিন্দুর বর্ণপ্রথা।

Purohit Cartoon 4 হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি

বর্ণপ্রথার কারণে ব্রাহ্মণ পৌরোহিত্যসহ যেকোনো পেশায় নিয়োজিত হতে পারে। কিন্তু অন্য সম্প্রদায়ের লোক তা পারে না। এক সময়ে ব্রাহ্মণ আবার সকল সম্প্রদায়ের হিন্দুদের পৌরোহিত্য করত না। তথাকথিত নিম্ন শ্রেণির হিন্দুদের পূজা অর্চনা তারা করত না। আজকাল এ ব্যাপারে তারা একটু নমনীয় হয়েছে। অবশ্য এই ফাঁকে বহু সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব ব্রাহ্মণ তৈরি করে নিয়েছে। এমনকি আক্রমণকারী অনেক বিদেশি জাতি হিন্দুতে পরিণত হওয়ার সময় তাদের পুরোহিতকে ব্রাহ্মণ করে নিয়েছে।

পদবি পরিবর্তনের মাধ্যমেও অনেকে ব্রাহ্মণ হয়েছে। ফলে ব্রাহ্মণের সংখ্যা হয়েছে স্ফীত। আসল-নকল চাপা পড়েছে বাজারের চাহিদায়। ব্রাহ্মণ সমাজের এই সংকরাবস্থা সত্ত্বেও তাদের পৌরোহিত্যের অধিকার খর্ব হয় নি। দু’একটি ছোট ছোট প্রতিবাদী সম্প্রদায় ছাড়া হিন্দুর সকল সম্প্রদায়ের কাছে এখনও একমাত্র ব্রাহ্মণই পুরোহিত হিসেবে গ্রহণযোগ্য। অব্রাহ্মণ দ্বারা পূজার কাজ এখনও ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ এবং সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য।

আরও পড়ুন:

বর্ণাশ্রমের এই বিধান ব্রাহ্মণদেরই তৈরি, আশ্চর্যের বিষয় বাকিরা বিনা প্রতিবাদে এর নীরব অনুসারী। যেহেতু সাধারণ হিন্দুসমাজ ইচ্ছা-অনিচ্ছায় এই বিধান অনুসরণের পক্ষপাতী তাই মন্দিরে যেমন ব্রাহ্মণ পুরোহিতের অবারিত দ্বার, তেমনি হিন্দুর ঘরোয়া পূজা, আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কার পালনেও ব্রাহ্মণ পুরোহিতই একমাত্র ভরসা। ব্রাহ্মণ ছাড়া যেমন সামাজিক পূজা হয় না, তেমনি পারিবারিক পূজা থেকে শুরু করে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানই ব্রাহ্মণ ছাড়া সিদ্ধ হয় না। বস্তুত পূজা, মন্দির ও ব্রাহ্মণ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পূজার অধিকার তো দূরের কথা, এমনকি এখনও অনেক মন্দির আছে যেখানে অনেক ‘জাতির’ হিন্দুদের প্রবেশাধিকার পর্যন্ত নিষিদ্ধ। এই তো গেলো পুরোহিতদের কথা। হিন্দুর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কি ভিন্ন? না, সেখানেও প্রায় একই চিত্র পরিলক্ষিত হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো তো তাদের দখলে আছেই, এমনকি মন্দিরের পূজ্যও অবতারের বকলমে ব্রাহ্মণ-সন্তান।

Purohit Cartoon 3 হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি

অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মসজিদ, গির্জা অথবা প্যাগোডায় জন্মভিত্তিক পৌরোহিত্যের কোনো ব্যবস্থা নেই। সেখানে গুণ ও মেধার ভিত্তিতে পুরোহিত নির্ধারিত হয়। যে কেউ গুণ ও মেধার ভিত্তিতে এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের পুরোহিত হতে পারেন। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেও পৌরোহিত্য করে তারাই। জন্ম সেখানে কোনো বাধা নয়। এই কারণে মসজিদ, গির্জা অথবা প্যাগোডা যে অর্থে সর্বজনীন সেই অর্থে হিন্দুর মন্দিরগুলো সর্বজনীন নয়।

 

একইভাবে সর্বজনীন নয় হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠানগুলোও। বর্ণ ভেদে আচার-অনুষ্ঠানগুলো ভিন্ন ভিন্ন। হিন্দুর আচার অনুষ্ঠানও ব্যক্তি অথবা পারিবারিক পর্যায়ে থাকে। অপরদিকে অন্যান্য ধর্মে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটা ‘কেন্দ্রীয় কমান্ড’ হিসেবে কাজ করে। অধিকন্তু তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ধর্মীয় কাজেই সীমাবদ্ধ নয়, সেগুলো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূমিকাও পালন করে। কিন্তু হিন্দুর মন্দির এই ভূমিকা পালন করে না। এসব কারণে মন্দিরের পক্ষে সর্বজনীন চরিত্র ধারণ করার সুযোগ খুবই কম।

Purohit in Hindi Film 2 হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি

আমরা জানি সকল ব্রাহ্মণ পুরোহিতের কাজ করে না। যারা করে সেই পুরোহিত বা যাজক শ্রেণির ব্রাহ্মণদের মধ্যে আবার শ্রেণি বিভাগ আছে। সম্মানের দিক থেকে প্রথমেই আছে হিন্দুধর্ম ও দর্শনের ব্যাখ্যাদাতা ব্রাহ্মণ। এরা প্রয়োজনে পূজা অথবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানও পরিচালনা করে। এরপরেই স্থান পূজারী ব্রাহ্মণের। তৃতীয় স্তরে পড়ে বেতনভুক ব্রাহ্মণ যারা ধনীদের গৃহে পূজারী, এমনকি পাচক হিসেবেও কাজ করে। ধর্মীয় পুস্তক পাঠ করা, প্রয়োজনে তার ব্যাখ্যা প্রদান ও বিতর্ক অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ এবং জ্যোতিষী শাস্ত্র চর্চা ইত্যাদিতেও ব্রাহ্মণরা নিয়োজিত থাকে।

পৌরোহিত্যসহ নানা কাজের সূত্রে ব্রাহ্মণ পুরোহিত বা যাজক শ্রেণি পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে সাধারণ ও মধ্যবিত্ত হিন্দুর খুব কাছের লোক। ধর্ম রক্ষা ও সম্প্রসারণ, সমাজের স্থিতিশীলতা রক্ষা, গ্রহণীয় ও বর্জনীয় নির্ধারণ, মঙ্গল ও অমঙ্গল চিহ্নিতকরণ থেকে শুরু করে হিন্দুর দৈনন্দিন সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে পুরোহিত বা ব্রাহ্মণরা জড়িত। এমনকি হিন্দুদের দৈনন্দিন আর্থিক ও কৃষি জীবনের সাথেও তারা জড়িত। এভাবে হিন্দু সমাজ তাদেরকে শুধু কাছের লোক করে নি, সমাজ তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উদারভাবে দানের ব্যবস্থা করেছে। তাকে নগদ টাকা ও অন্ন-বস্ত্রই শুধু নয় ভূমি দানের ব্যবস্থা পর্যন্ত করা হয়েছে।

Purohit Cartoon 2 হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি

দেখা যায় পুরোহিত ছাড়া অন্যান্য শ্রেণির ব্রাহ্মণরাও সমাজ কর্তৃক প্রদত্ত সুযোগ সুবিধার বদৌলতে বিগত কয়েক শতাব্দীর মধ্যে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা, প্রশাসন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তাদের প্রায় একচেটিয়া দাপট। এমন একটি অবস্থানে থেকে প্রতিদানে পুরোহিত শ্রেণি এবং সাধারণভাবে ব্রাহ্মণ শ্রেণি হিন্দু সমাজকে করতে পারত সুশীল, সভ্য, সংহত ও উন্নত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে শ্রেণি হিসেবে তারা জ্ঞান চর্চার নামে সমাজকে করেছে খণ্ড-বিখণ্ড ও শতধা বিভক্ত। নিয়ম নীতি, আচার-অনুষ্ঠানের বেড়াজাল ও কুসংস্কার তৈরি করে তারা হিন্দু সমাজকে একটি প্রথাবদ্ধ কারাগারে পরিণত করেছে।

রাষ্ট্রীয় অনুদান, সামাজিক দান এবং ব্যক্তিগত আনুকূল্য ও দান হিসেবে ব্রাহ্মণকে প্রদত্ত সামাজিক বিনিয়োগের কী অপচয় হয়েছে তার উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় পাতায় পাওয়া যায়। দূর অতীতে গিয়ে লাভ নেই। নিকট অতীতে কী ঘটেছে তাই দেখা যাক। মধ্যযুগে পুরোহিত শ্রেণিকে দেখা যায় প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকায়।

রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থে (বাঙালির ইতিহাস : দে’জ পাবলিশিং : ১৯৮৭ প্রথম সংস্করণ: ১৩২১) এর একটি পরিচয় দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করছেন। কথিত আছে যে শ্রীচৈতন্য যখন নবদ্বীপে নগর সংকীর্তন আরম্ভ করেন, তখন ভট্টাচার্যগণ নবদ্বীপের কাজীকে সংকীর্তন যাত্রা নিষেধ করতে অনুরোধ করেছিলেন। আমরা জানি শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব আন্দোলন হিন্দুর সমানাধিকারের আন্দোলন ছিল। এই প্রেক্ষাপটে ভট্টাচার্যগণ কর্তৃক সংকীর্তন বন্ধ করার আবেদন তাদের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ নয় কি?

Purohit Cartoon 1 হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি

বিখ্যাত “হীরক রাজার নামীয় চলচ্চিত্রে। এই চলচ্চিত্রে ব্রাহ্মণকে রাজার সকল বৈষম্যমূলক প্রতিক্রিয়াশীল কাজে একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। ক্ষুধার্ত মানুষ করছে, তখন ব্রাহ্মণের দিয়ে বলানো হচ্ছে “বেশি খেলে বাড়ে মেদ, কম খেলে নাহি খেদ”। মানুষ যখন শিক্ষার দাবি করছে তখন রাজার কাটছেন: কোন নেই, রকম প্রচুর উদাহরণ শ্লোক সত্যজিত ব্রাহ্মণের যে প্রতিক্রিয়াশীল চিত্র এঁকেছেন তার সত্যতা খণ্ডন করা খুবই কঠিন।

নিকটতম অতীতে পুরোহিত বা যাজক শ্রেণির ব্রাহ্মণদের ভূমিকা সম্পর্কে নীরদ সি চৌধুরী তাঁর গ্রন্থে (হিন্দুইজম এ্যা রিলিজিয়ন লিভ বাই: অক্সফোর্ড ইন্ডিয়া পেপারব্যাকস ১৯৯৬) বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাস থেকে উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন কিভাবে ব্রাহ্মণ তার্কিকরা ধর্মের আলোচনা করতে গিয়ে ধৈর্য্যের চেয়ে বীর্যের পরিচয় দিত। কারণ আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা তাদের ছিল না।

 

তারা বাড়িতেই পূজা-অর্চনার রীতি শিখত। তাই বিতর্কে তাদের ধৈর্য্যচ্যূত হওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। নীরদ চৌধুরীর মতে যজমানদের আধ্যাত্মিক বা নৈতিক উন্নতির কোনো দায়িত্ব পুরোহিত নেয় না। যজমানদের দারিদ্র্য, দুঃখ অথবা রোগের ক্ষেত্রেও পুরোহিতরা কোনো দায়িত্ব পালন করে না। তারা অর্থোপার্জনকে বড় মনে করে। যথেষ্ট পরিমাণে সম্মানী দিলে তারা যজমানদের সম্পর্কে নিন্দাবাদ করে। বস্তুত তারা এক ধরনের কর আদায়কারী সম্প্রদায়।

Purohit in Hindi Film 3 হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি

আব্বে দুবয় নামীয় এক ফরাসি লেখকের “হিন্দু ম্যানার্স কাস্টমস এ্যান্ড সিরিমনিজ (১৮১৭)” নামীয় গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করে নীরদ চৌধুরী দেখিয়েছেন কী নির্মমভাবে দক্ষিণ ভারতে এই পুরোহিত বা যাজকশ্রেণি যজমানদের কাছ থেকে ‘দক্ষিণা’র নামে কর আদায় করত। এই দক্ষিণা দিতে কেউ অপারগ হলে তাকে প্রকাশ্যে অপমান করা হতো, মুখে গোবর মেখে দেওয়া হতো। এতেও কাজ হলে যজমানের একটি সন্তানকে পুরোহিতের বাড়িতে দক্ষিণার টাকা পরিশোধিত না হওয়া পর্যন্ত বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে হতো। এমনকি যজমানের স্ত্রীকেও তারা অধিগ্রহণ করত।

নীরদ চৌধুরী মনে করেন অমানবিক আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দক্ষিণ দেশে ব্রিটিশ আমলে প্রচণ্ড ব্রাহ্মণ বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। ব্রাহ্মণ ভোজনের এক রীতির ফলে বাংলার গ্রামে গ্রামে এক শ্রেণির পরজীবী ব্রাহ্মণ সৃষ্টি হয়েছিল। এদের পেশাই ছিল এই ভোজনে অংশগ্রহণ করে গ্রাসাচ্ছদন করা। এসবের বর্ণনা নীরদ চৌধুরী তাঁর গ্রন্থে দিয়েছেন।

 

ব্রাহ্মণদের নিম্ন নৈতিক মানের একটি চিত্র আঁকতে গিয়ে নীরদ চৌধুরী আব্বে দুবয় এর শরণাপন্ন হয়েছেন। দুবয় এর বরাত দিয়ে তিনি বলছেন ব্রাহ্মণরা অতি মাত্রায় নিজের গুরুত্ব সম্পর্কে সজাগ এবং তাই উদ্ধত স্বভাবের। সে কলের কাছ থেকে দূরে থাকে। সকলকে করে অবজ্ঞা ঘৃণা। তার মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধ ও দয়াবোধ ইত্যাদি কাজ করে না। অতিভোজন তার বৈশিষ্ট্য।

Purohit Cartoon 5 হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি

শুধু দক্ষিণ ভারত নয়, অবিভক্ত বাংলায়ও ব্রাহ্মণ্য সমাজের ভূমিকা একই রকম ছিল। ব্রাহ্মণদের সৃষ্ট কুপ্রথা, কুসংস্কার ও অমানবিক রীতি-বিধিতে ক্ষুব্ধ হয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) তাঁর প্রবন্ধে (প্রবন্ধ: নারীর মূল্য): শরৎ সাহিত্য সমগ্র : সম্পাদক : সুকুমার সেন : আনন্দ পাবলিশার্স : ১৯৯৩) ব্রাহ্মণকুলকে এক হাত নিয়েছেন। তিনি দুঃখ করে বলেন: মানুষ এখনও শাস্ত্র বোঝার জন্য ‘ভট্টাচার্য্যের কাছে যায়। অথচ এই ভট্টাচার্য্যরা জানে শুধু শ্লোক। তারা মুখস্থ করবার ক্ষমতাকেই বুদ্ধি ও জ্ঞান বলে মনে করে।

শরৎচন্দ্রের মতে ব্রাহ্মণরা হৃদয়হীন। তিনি এখানেই থামেন নি। বোধ হয় ব্রাহ্মণ বলেই তিনি ব্রাহ্মণের এই অধঃপতন সহ্য করতে পারেন নি। তিনি দুঃখ করে বলছেন : বামুনের ছেলে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে পয়সা নিয়ে রাত্রি যাপন করে এবং পরদিন সেই পয়সা দিয়ে গাঁজা গুলি খায়।

এই ধরনের ব্রাহ্মণ্য কাজকে হীন কাজ বলে আখ্যায়িত করে তিনি বলছেন : ক্ষমাহীন সমাজ, প্রীতিহীন ধর্ম, জাতিগত (কাস্ট) ঘৃণা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও মেয়েদের প্রতি চিত্তহীন কঠোরতা দিয়ে ব্রাহ্মণ্য শ্রেণি সমাজে এক চিরস্থায়ী আত্মকলহের আবহ সৃষ্টি করেছে। তাঁর মতে এই প্রেক্ষাপটেই মুসলমানদের এদেশে আগমন। শরৎচন্দ্রের মতে (প্রবন্ধ : তরুণের বিদ্রোহ) এতে ‘ব্রাত্য’-বৌদ্ধরা (বেদ বিরোধী) খুশি হয়। তারা মুসলমানদের যশোগান করে ধর্মমঙ্গলে লিখলেন:

ধর্ম হইলা যবন রূপী

মাথায় দিলা কালোটুপী

ধর্মের শত্রু করিতে বিনাশ।

এই কবিতায় স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে মুসলমানদের আগমনে বৌদ্ধরা আনন্দ প্রকাশ করছে। কারণ বৌদ্ধ-নির্যাতনকারী হিন্দুদেরকে মুসলমানরা আঘাত দিচ্ছে। শরৎচন্দ্রের এই ব্যাখ্যা থেকে মধ্যযুগের ধর্মীয় টানাপোড়েনে যে শেষ পর্যন্ত বাংলা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

শরৎচন্দ্র হিন্দুদের অধঃপতনে যারপরনাই ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে নমঃশূদ্র, মালো, নট, রাজবংশী ও পোদ ইত্যাদি তথাকথিত নিম্ন শ্রেণির হিন্দুদেরকে কাছে টেনে নিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন (প্রবন্ধ: স্বদেশ ও সাহিত্য)। তিনি মনে করতেন এতে হিন্দুর শক্তি বাড়বে।

শরৎচন্দ্র এখানেই থামেন নি। তিনি হিন্দুর শাস্ত্রগুলো সম্পর্কেও কঠোর মন্তব্য করেন (প্রবন্ধ: সমাজ ধর্মের মূল্য)। তাঁর মতে হিন্দু শাস্ত্রগুলোতে সত্য ও স্বাধীন বিচারের কোনো ব্যবস্থা নেই। ধর্মের কথা বলে মিথ্যা ও বেনামিতে বহু কল্পকাহিনী শাস্ত্রে ঢুকানো হয়েছে। এগুলোতে দেওয়া হয়েছে প্রাচীনতার ছাপ। বলা হয়েছে। এগুলোই ভগবানের অনুশাসন। এ সবই করেছেন ব্রাহ্মণরা।

Purohit Cartoon 6 হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি

বেদ সম্পর্কে শরৎচন্দ্র বলছেন: “যে কেহ হিন্দু শাস্ত্র আলোচনা করিয়াছেন, তিনিই বোধ করি অত্যন্ত ব্যথার সহিত অনুভব করিয়াছেন কি করিয়া ঋষিদিগের স্বাধীন চিন্তার শৃঙ্খলা এই বেদেরই তীক্ষ্ণ খড়গে ছিন্নভিন্ন হইয়া পথে-বিপথে যেখানে-সেখানে যেমন-তেমন করিয়া আজ পড়িয়া আছে। চোখ মেলিলেই দেখা যায়, যখনই সেই সমস্ত বিপুল চিন্তার ধারা সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধির অনুসরণ করিতে ছুটিতে গিয়াছে, তখনই বেদ তাহার দুই হাত বাড়াইয়া তাহাদের চুলের মুঠি ধরিয়া টানিয়া আর এক দিকে ফিরাইয়া দিয়াছে।” শরৎচন্দ্র যে চিত্র এঁকেছেন তার সমর্থন নোবেল বিজয়ী ভি.এস. নৈপালের গ্রন্থেও (ইন্ডিয়া: এ্যা মিলিয়ন মিউটিনিজ নাও মিনার্ভা : ১৯৯০) পাওয়া যায়।

শরৎচন্দ্রের সমাজ বিষয়ক প্রবন্ধাবলী পাঠ করলে দেখা যায় ব্রাহ্মণ্য সমাজ রামমোহন রায়কে ধর্মদ্বেষী ও রাক্ষস বলে অভিহিত করেছিল । আবার দেখা যায় ব্রাহ্মণ্য সমাজের রোষ থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও বাদ যান নি। অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ বিদ্যাসাগর বহু বিবাহ প্রথা রোধে খড়গহস্ত হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর রচনাবলীতে (সম্পাদনা : সুবোধ চক্রবর্তী : কামিনী প্রকাশনালয় : অখণ্ড সংস্করণ : কলকাতা) হাজার হাজার বহু বিবাহের ঘটনার মধ্যে প্রায় দুই শত ব্রাহ্মণের নাম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। এরা সবাই একাধিক বিয়ে করে।

তালিকা থেকে দেখা যায় প্রতিটি ব্রাহ্মণের বিয়ের সংখ্যা ছিল সর্বনিম্ন ২টি এবং সর্বোচ্চ ৮০টি। এদের প্রত্যেকের বয়স ছিল সর্বনিম্ন ২৮ বছর এবং সর্বোচ্চ ৭০ বছর। এ ব্রাহ্মণদের মধ্যে কয়েকজন ‘গাঙ্গুলি’ বাদে সবারই পদবি হচ্ছে: বন্দোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় ও মুখোপাধ্যায়।

কুল রক্ষার নামে যে অনাচারের বিবাহ পদ্ধতি ব্রাহ্মণ্য সমাজ চালু করেছিল তার অসারতা সম্বন্ধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি কুলীনদের এই বহু বিবাহের ব্যবস্থাকে জঘন্য বলে আখ্যায়িত করেন। এই বহু বিবাহ কালে কুলীন ব্রাহ্মণরা যে সব অনাচার করত তার বহু বর্ণনা বিদ্যাসাগর দিয়েছেন। দেখা যায় পূজার চাঁদার টাকা সংগ্রহের জন্যও কুলীন ব্রাহ্মণরা বিয়ে করত। তারা তাদের তথাকথিত স্ত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিছুদিন পরপর ‘ভিজিটের’ মত টাকা আদায় করে আনত। স্ত্রীদের নাম পর্যন্ত তারা জানত না।

Purohit Cartoon 7 হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি

কোনো দিন দেখা-সাক্ষাত না হওয়া স্ত্রীর গর্ভে যখন সন্তান আসত, তখন এই কুলীনরা টাকার বিনিময়ে সেই সন্তানদের পিতৃত্বের ভার বহন করত। এই অমানবিক পন্থায় কত ব্রাহ্মণের (?) যে জন্ম হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এ ধরনের একটি কুৎসিত প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর যখন আন্দোলন গড়ে তুলেন তখন ব্রাহ্মণ্য সমাজ ক্ষেপে লাল হয়। এই সব দেখে প্রমথ চৌধুরীও (প্রবন্ধ পাঠান-বৈষ্ণব রাজকুমার বিজুলি খাঁ : প্রবন্ধ সংগ্রহ: বিশ্বভারতী : ১৯৯৩) পুরোহিত ধর্মযাজক ও বেদান্ত শাস্ত্রীদের শুষ্ক জ্ঞান ও বাহ্যকর্মের ব্যবসায়ী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

এবারে আসা যাক বাঙালি হিন্দুর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আলোচনায়। দেখা যায় এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তির নামে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে বৈষ্ণবদের। এই আন্দোলনটি গড়ে ওঠে ‘মিশ্র’ বংশের ব্রাহ্মণ শ্রীচৈতন্যকে (বিশ্বম্ভর মিশ্র বা নিমাই) (১৪৮৬-১৫০৩) কেন্দ্র করে।

বৈষ্ণব আন্দোলনকে উৎপাটিত করে বাঙালি হিন্দুর ব্রাহ্মণ্য সমাজ একসময় বাংলার প্রাচীনতম ধারা তন্ত্র ও যোগের দিকে ধাবিত হয়। এর ফলে প্রথমেই পাওয়া যায় ‘ঘোষাল’ বংশের এক ব্রাহ্মণ যোগীকে যিনি (১৭৩১-১৮৯০) ‘লোকনাথ’ নামে পরিচিত। তাঁর নামেই বর্তমানের ‘লোকনাথ আশ্রম’। এর পরেই পাওয়া যায় ‘রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন’কে। এটি গড়ে ওঠেছে গদাধর চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৬-১৮৮৮) এর নামে যিনি ‘রামকৃষ্ণ’ নাম ধারণ করেন।

এর পরে পাচ্ছি আরও চারটি বৈষ্ণব অথবা শাক্ত প্রতিষ্ঠান যথা: ১. দীননাথ ন্যায়রত্নের পুত্রকে (১৮৭১-১৯২১) ঘিরে গড়ে ওঠা ‘জগবন্ধু’ আশ্রম, ২. শিব চক্রবর্তীর পুত্রকে (১৮৮৮-১৯৬৯) ঘিরে গড়ে ওঠা ‘অনুকূল ঠাকুরের আশ্রম’, ৩. বিপিন ভট্টাচার্য্যের কন্যাকে (১৮৯৬-১৯৮২) ঘিরে গড়ে ওঠা মা আনন্দময়ীর আশ্রম’, ৪. বিষ্ণুচরণ ভূঁইয়ার পুত্রকে (১৮৯৬-১৯৪১) ঘিরে গড়ে ওঠা ‘প্রণবানন্দ মঠ’ এবং ৫. লক্ষ্মীনারায়ণ সরকারের পুত্র প্রভাত রঞ্জন সরকারকে (শ্রীশ্রী আনন্দমূর্তিজি) (১৯২১-১৯৯০) ঘিরে গড়ে ওঠা ‘আনন্দ মার্গ’।

Purohit in Hindi Film 1 হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি

উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রভাব ও প্রতিপত্তির দিক থেকে ‘রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনই সবচেয়ে অগ্রগামী। ঘটনাক্রমে এটি গড়ে ওঠেছে ‘রামকৃষ্ণ নাম নিয়ে। পৌরাণিক কাহিনী মতে রাম ছিলেন ক্ষত্রিয় রাজা। পরবর্তীকালে ‘অবতারবাদের’ মাধ্যমে তিনি হন ‘অবতার’ এবং আরও পরে বিষ্ণুর অবতার। এদিকে কৃষ্ণও ছিলেন ক্ষত্রিয়। কৃষ্ণ কমপক্ষে মোট তিন জন: একজন ট্রাইবাল রাজা, একজন গোপদের কৃষ্ণ ও আর একজন মহাভারতের কৃষ্ণ। বৈষ্ণব আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দুর কল্পনায় ‘রাম’ ও ‘কৃষ্ণ’ অশরীরী দেবতা হিসেবে একসময় আবির্ভূত হন। এই জনপ্রিয় দুই দেবতাতুল্য চরিত্রের নাম একত্রিত করে ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা হয় ‘রামকৃষ্ণ’ ধারণা।

ব্রাহ্মণ সন্তান গদাধর চট্টোপাধ্যায় ‘রামকৃষ্ণ’ নাম ধারণ করে ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। কালক্রমে তার প্রতিকৃতিই হিন্দু ‘ভদ্রলোকের’ ঘরে পূজার আসনে স্থান পায়। ক্ষত্রিয় রাম ও কৃষ্ণের ছবি হিন্দুর পূজার ঘর থেকে ধীরে ধীরে ওঠে যায়। এতে ফলাফল দাঁড়ায় : ক্ষত্রিয় ও অশরীরী রাম ও কৃষ্ণের স্থলে হিন্দুরা পায় একজন ব্রাহ্মণ যোগীকে। লক্ষণীয় ‘রামকৃষ্ণ মিশনের’ প্রাণ-পুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ (নরেন্দ্রনাথ দত্ত) কিন্তু পূজার ঘরে স্থান পান নি। তাঁকে বৈঠক ঘরে স্থান দিয়েই ‘ভদ্রলোকরা’ ক্ষান্ত হন। অথচ হিন্দুধর্মে বিবেকানন্দের অবদান কারও চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। অপরদিকে লোকনাথ সম্বন্ধেও একই কথা খাটে।

Purohit in Hindi Film 2 হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি

যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের গ্রন্থে (বিক্রমপুরের ইতিহাস : শৈব্যা প্রকাশন বিভাগ কলকাতা, ১৯৯৮) আমরা ‘লোকনাথের’ দুটো প্রাচীন মূর্তি দেখতে পাই। মধ্যযুগে পূজিত ‘লোকনাথের একটি ছবিতে দেখা যায় ‘অবলোকিতেশ্বর’ বা ‘লোকনাথ’ দ্বাদশভুজ। অন্যটিতে তিনি দ্বিভুজ।

অপরদিকে রজনীকান্ত চক্রবর্তীর গ্রন্থে (গৌড়ের ইতিহাস সম্পাদনা ড. মলয়শঙ্কর ভট্টাচার্য্য দে’জ পাবলিশিং : ১৯৯৯) যে ‘অবলোকিতেশ্বরের’ মূর্তি স্থান পেয়েছে তাও একই ধরনের। এর থেকে বোঝা যায় মধ্যযুগে শিবই ‘অবলোকিতেশ্বর’ বা ‘লোকনাথ’ হিসেবে পূজিত হতেন। দেখা যাচ্ছে ব্রিটিশ আমলে ‘ঘোষাল’ বংশের এক ব্রাহ্মণ সন্তান লোকপ্রিয় ‘লোকনাথ’ নামে হিন্দু সমাজের সামনে আবির্ভূত হন। এ সব ঘটনা থেকে আমরা কি শিক্ষা পাই?

ওপরের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় কেবল মাত্র শ্রীচৈতন্যকে বাদ দিলে বাকি সবাই ব্রিটিশ আমলের ফসল। দ্বিতীয়ত কেবল মাত্র ‘প্রণবানন্দ মঠ’ ও ‘আনন্দ মার্গ’ ছাড়া বাকি সবগুলোই গড়ে ওঠেছে ব্যক্তি ব্রাহ্মণকে কেন্দ্র করে। তৃতীয়ত দুই-একজন বাদে প্রত্যেকেই নাম বদল করে অতি পরিচিত পুরোনো দেব-দেবীর নাম ধারণ করেছেন।

চতুর্থত ‘রামকৃষ্ণ মিশনের’ ক্ষেত্রে দেখা যায় ক্ষত্রিয় ও অশরীরী দেবতা রাম ও কৃষ্ণের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ব্যক্তি ব্রাহ্মণ। এদিকে ‘লোকনাথ’ আশ্রমের ক্ষেত্রে অশরীরী দেবতা শিব ও ক্ষত্রিয় বুদ্ধের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ব্যক্তি ব্রাহ্মণ। এই ঘটনাগুলো কি পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করার ব্রাহ্মণ্য পণের চূড়ান্ত ফল, না নিতান্তই কাকতালীয়?

Purohit Cartoon 3 হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি

এ কথা জানা যে, ব্রাহ্মণ পরশুরাম পণ করেছিলেন তিনি পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করবেন (বস্তুত তিনি তা ২১ বার করেছিলেন)। কারণ ক্ষত্রিয়রাই (শাসক) ব্রাহ্মণদের (শিক্ষিত) পথের কাঁটা। যুগে যুগে তাই ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে দ্বন্দ্ব ও ক্ষণে ক্ষণে মিলনের আভাস পাওয়া যায়। বৈশ্যরাও (ব্যবসায়ী) এতে শামিল। বস্তুত বৈশ্যরা যে দিকে পাল ধরেছে সেই দিকেই পালা ভারি হয়েছে। এসব দূর ও নিকট অতীতের কথা।

আধুনিক যুগেও এই তিনের সহাবস্থানই পরিলক্ষিত হয়। তা না হলে বর্তমান কালের ব্যবসায়ীরা অশরীরী দেবতার স্থলে রক্ত-মাংসের মানুষকে পূজ্য করতে দু’হাতে দান-খয়রাত করত না। এই তিনের সম্মিলিত শক্তিই বোধ করি ‘ব্রাহ্মণ্য’ সমাজের শক্তি। এই শক্তির ভিত্তি ভক্তি, যুক্তি নয়। এই শক্তি ধৈর্য্য দাবি করে, বীর্য নয়। তাই সাধারণ হিন্দুকে ধৈর্য্য ও ভক্তি চর্চার নিদর্শন হিসেবে অশরীরী দেবতার স্থলে শরীরী ব্যক্তিকে দেবত্বে বরণ করতে হয়। এই ক্ষেত্রে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় ‘জন্মান্তরবাদ’ ও ‘অবতারবাদকে’। অথচ ‘অবতারবাদ’ যে হিন্দুর মূল দেবতাদেরকে আড়াল করে দিচ্ছে এ কথা কেউ গ্রাহ্যই করতে চায় না।

ইতিহাস সাক্ষী, হিন্দুর এই পুরোহিত শ্রেণি ও ব্রাহ্মণ্য সমাজ তাদের স্বার্থে হিন্দু সমাজকে করেছে অবতারমুখী এবং বহুধা বিভক্ত। এ বিভক্তিকে হিন্দুর অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। পুরোহিত ও ব্রাহ্মণ্য সমাজ প্রথাকেই ধর্ম মনে করে। এটি করতে গিয়ে তারা হিন্দু সমাজকে নানাবিধ প্রথা ও সংস্কারে আবদ্ধ করে তুলেছে। তাদের তৈরি নানা ধরনের রীতি-নীতি ও সংস্কার হিন্দু সমাজকে এক অচলায়তনে পরিণত করেছে।

সেখানে পুরোহিত তথা ব্রাহ্মণের স্বার্থই ধর্ম হয়ে ওঠেছে। পুরোহিত ও ব্রাহ্মণের স্বার্থই সমাজ শাসনের ভিত্তি। নতুবা বাল্য বিবাহ, সহমরণ, সতীদাহ ও গঙ্গা সাগরে সন্তান নিক্ষেপ এবং নরবলী থেকে শুরু করে নানা নৃশংস প্রথা গড়ে তোলার জন্য এই পুরোহিত ও ব্রাহ্মণ্য সমাজ শ্লোক বাধত না, তৈরি করত না এতসব মনগড়া শাস্ত্র ।

Purohit Cartoon 4 হৃদয়হীন পুরোহিত শ্রেণি

আশার কথা এসব কুপ্রথা থেকে হিন্দু সমাজ আজ মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু এখনও রয়ে গেছে বহু প্রথা যা যুক্তির বিচারে অচল। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য সমাজ এগুলোকে এখনও লালন পালন করে যাচ্ছে। এই প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে পুরোহিত সমাজ। এটি অনুধাবন করে স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন: পুরোহিততন্ত্রের স্বভাব নিষ্ঠুর ও নিষ্করুণ। সেই জন্যই যেখানে পুরোহিততন্ত্রের উদ্ভব হয় সেখানেই ধর্মের পতন বা গানি হয়। তাই তিনি মানুষকে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রথমে দুষ্ট পুরুতগুলোকে দূর করতে বলেছেন। কারণ এই মস্তিষ্কহীন লোকগুলো কখনও ভাল কথা শুনবে না। তাদের হৃদয়ও শূন্যময়, তার কখনও প্রসার হবে না। শতশত শতাব্দীর কুসংস্কার ও অত্যাচারের মধ্যে তাদের জন্ম। বিবেকানন্দ আগে তাদের নির্মূল করতে চান। তিনি বলছেন: পৌরোহিত্যই ভারতের সর্বনাশের মূল (গ্রন্থ : বিবেকানন্দ কথামৃত:ড. হরপদ চট্টোপাধ্যায় : বুলবুল প্রকাশন: ১৯৯৪)।

Leave a Comment