আদ্যশ্রাদ্ধ সংস্কার হিন্দুধর্মীয় প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম। এটি মৃত পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের এক বিশেষ প্রথা, যা আত্মার তৃপ্তি ও পরিবারের কল্যাণের জন্য পালন করা হয়। ‘শ্রদ্ধা’ থেকে উৎপন্ন ‘শ্রাদ্ধ’ মূলত সেই ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ, যেখানে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে দান, ভোজ ও পুণ্যকর্ম করা হয়। আদ্যশ্রাদ্ধ হল অশৌচ ত্যাগের পর প্রথমবারের শ্রাদ্ধ, যা একোদ্দিষ্টভাবে মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তি ও তৃপ্তির জন্য করা হয়। এই সংস্কারের মাধ্যমে ব্যক্তি শাস্ত্রানুগ নিয়ম, আচার-অনুষ্ঠান এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ ব্যবহার করে আত্মিক উন্নতি ও ধর্মীয় কর্তব্য পালন করে।
Table of Contents
আদ্যশ্রাদ্ধ সংস্কার
আদ্যশ্রাদ্ধ সংস্কার
‘শ্রদ্ধা’ শব্দ থেকে শ্রাদ্ধ শব্দটি এসেছে। তবে শ্রাদ্ধ শব্দটি হিন্দুধর্মীয় শাস্ত্রে একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তা হচ্ছে মৃত ব্যক্তি তথা মৃত সকল পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁদের তৃপ্তির জন্য দান করা, তৃপ্তিকর ভোজের আয়োজন করার যে অনুষ্ঠানে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার সঙ্গে মাস, তিথি, নাম ও গোত্র উচ্চারণ করে অন্ন, ঘৃত, দধি প্রভৃতি দান করা হয় তাকে শ্রাদ্ধ বলে। শ্রাদ্ধ বারো প্রকার। যথা : নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য, বৃদ্ধি, সপিণ্ডন, পার্বণ, গোষ্ঠী, শুদ্ধার্থ, কর্মাঙ্গ, বৈদিক, তীর্থযাত্রা ও পুষ্টিশ্রাদ্ধ।
নিত্যশ্রাদ্ধ : প্রতিদিনের কর্তব্য শ্রাদ্ধকে নিত্য শ্রাদ্ধ বলা হয়।
নৈমিত্তিক শ্রাদ্ধ : মৃত ব্যক্তির মৃত্যু তিথি-নিমিত্ত যে শ্রাদ্ধ হয় তাকে নৈমিত্তিক শ্রাদ্ধ বলে। মৃত ব্যক্তির মৃত্যু-তিথি নির্দিষ্ট করে যে একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ করা হয়, সেই শ্রাদ্ধই নৈমিত্তিক শ্রাদ্ধ ।
কাম্য শ্রাদ্ধ : কোন ইচ্ছা পূরণ কামনায় পিতৃপুরুষের যে অর্চনা করা হয়, তাকে কাম্য শ্রাদ্ধ বলে ।
বৃদ্ধি শ্রাদ্ধ : বৃদ্ধি অর্থাৎ উন্নতি বা সুফল লাভের জন্য যে শ্রাদ্ধ করা হয়, তাকে বৃদ্ধি শ্রাদ্ধ বলা হয়। দশ সংস্কারভিত্তিক কোন অনুষ্ঠান করার আগে এ শ্রাদ্ধ করা হয়।
সপিণ্ডন শ্রাদ্ধ : পিতৃপুরুষের সঙ্গে প্রেত পিণ্ডাদি সমন্বয় করার নিমিত্তে যে শ্রাদ্ধ করা হয়, তাকে সপিণ্ডন শ্রাদ্ধ বলে। পার্বণ
শ্রাদ্ধ : পর্বদিনে বিহিত শ্রাদ্ধ পার্বণ শ্রাদ্ধ ।
গোষ্ঠী শ্রাদ্ধ : জনগণের সম্পদ ও সুখের জন্য পিতৃপুরুষের যে অর্চনা করা হয়, তাকে গোষ্ঠী শ্রাদ্ধ বলে।
শুদ্ধার্থ শ্রাদ্ধ : প্রায়শ্চিত্তের শেষে শুদ্ধির জন্য যে শ্রাদ্ধ করা হয় তাকে শুদ্ধার্থ শ্রাদ্ধ বলে।
কর্মাঙ্গ শ্রাদ্ধ : সীমন্তোন্নয়ন, গৃহ প্রবেশ প্রভৃতি কাজের পূর্বে যে শ্রাদ্ধ করা হয় তাকে কর্মাঙ্গ শ্রাদ্ধ বলে।
দৈবিক শ্রাদ্ধ : বিশেষ তিথিতে যে শ্রাদ্ধ করা হয়, তাকে দৈবিক শ্রাদ্ধ বলে।
তীর্থযাত্রা শ্রাদ্ধ : তীর্থ গমন ও প্রত্যাগমনে যে শ্রাদ্ধ করা হয় তাকে তীর্থযাত্রা শ্রাদ্ধ বলে।
পুষ্টি শ্রাদ্ধ : শরীর, অর্থ ইত্যাদির জন্য যে শ্রাদ্ধ করা হয় তাকে পুষ্টি শ্রাদ্ধ বলে ।

শ্রাদ্ধের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি পৌরাণিক কাহিনী আছে। কাহিনীটি বলছি :
পুরাকালে মনু বংশে নিমি নামক এক মহাতপামুনি ছিলেন। তাঁর পুত্র পরম ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও পিতার আগে মৃত্যুবরণ করেন। পুত্রশোকে অস্থির হয়ে তিনি তিন দিবস অতিবাহিত হবার পর স্থির করলেন, আমার ছেলে তিনদিন অনাহারে আছে, কারণ দেহ বিনষ্ট হলেও আত্মা মরে না। সে এখন যেখানে যে অবস্থায় থাকুক না কেন আমি তার তৃপ্তি সাধনের জন্য ভোজের আয়োজন করব।
তিনি পুত্র যা ভালবাসতেন তা তৈরি করে ভোজের আয়োজন করলেন এবং ব্রাহ্মণদের নানা দ্রব্য দান করলেন। কুশের ওপর দক্ষিণমুখী হয়ে বসে পিণ্ডদান করলেন। এ অনুষ্ঠান করে মহামুনি নিমির খুব ভাল লাগল। তিনি তৃপ্ত হলেন। এমন সময় দেবর্ষি নারদ এলেন। তিনি এ অনুষ্ঠান অনুমোদন করলেন। তিনি জানালেন, এতে মুনি নিমির পুত্রের আত্মাও তৃপ্ত হয়েছে। এ থেকে শ্রাদ্ধের উৎপত্তি।
আদ্যশ্ৰাদ্ধ
অশৌচ ত্যাগের পর যে শ্রাদ্ধ করে শুদ্ধ হতে হয় তাকে আদ্যশ্রাদ্ধ বলে। আদ্যশ্রাদ্ধের পূর্ণ নাম আদ্য একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ । একজন মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে এ শ্রাদ্ধ করা হয়। তাই একে একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ বলে। জ্যেষ্ঠ পুত্রাদিক্রমে যারা শ্রাদ্ধের অধিকারী তারা পূর্ব ব্যক্তির অভাবে পরবর্তী ব্যক্তি শ্রাদ্ধ করবে। প্রথমে পুরক পিণ্ডদান ও পরে শ্রাদ্ধ কাজ করতে হয়।
জড়, আতুর, ক্লীব, পণ্ডিত, জন্মান্ধ, জন্মবধির উন্মত্ত, বোবা, ইন্দ্রিয়রহিত ইত্যাদি ব্যক্তিগণ শ্রাদ্ধের অধিকারী হন না।
আদ্যশ্রাদ্ধের প্রথমে প্রদীপ জ্বালিয়ে বাস্তুপুরুষ যজ্ঞেশ্বরের পূজা করতে হয়। তারপর অন্যান্য করণীয় পূজা করে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ করতে হয়।
আদ্য শ্রাদ্ধের প্রয়োজনীয় দ্রব্য আতপ চাউল, কলাপাতা, ধূতি, ভোজ্যের গামছা, শ্রাদ্ধের কাপড়, তিল, জল, হরীতকী, ঘৃত, মধু, চিনি, দধি, কুশ, ধূপ, দীপ, ফুল, তুলসী, পান-সুপারি, মালসা, পাটকাঠি, আদা, গুড়, কুশাসন, কলার খোলা, অগ্রদানীর দক্ষিণা, পুরোহিত দক্ষিণা প্রভৃতি।
শাস্ত্রে ছয়, আট, ষোল প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার দানের বিধান রয়েছে। ভূমি, আসন, জল, বস্ত্র, প্রদীপ, অন্ন, তাম্বুল, ছত্র, গন্ধ, থালা, ফল, শয্যা, পাদুকা, গো, স্বর্ণ ও রূপা- এই ষোল প্রকারের দানকে ষোড়শ শ্রাদ্ধ বলে । তবে মনে রাখতে হবে, শ্রদ্ধার সাথে যা দান করা হয় তাই শ্রাদ্ধ। শ্রদ্ধাহীনভাবে অহংকারের সঙ্গে আড়ম্বরপূর্ণভাবে দান করলে শ্রাদ্ধ হয় না ।
সারাংশ
মৃত ব্যক্তির আত্মার তৃপ্তির জন্য শ্রদ্ধার সঙ্গে দান করাকে শ্রাদ্ধ বলে। অধিকারী জ্যেষ্ঠ পুত্র। তার অভাবে কনিষ্ঠ বা অন্য কেউ শ্রাদ্ধ করতে পারবেন। শ্রাদ্ধ বারো প্রকার। পুরাণে আছে, মহামুনি নিমি নিজ পুত্রের আত্মার জন্য পূজনীয় ব্যক্তিদের ভোজন করান এবং দান করেন। এ ভাবেই উৎপত্তি। অশৌচ ত্যাগের পর যে শ্রাদ্ধ করে শুদ্ধ হতে হয়, তাকে আদ্যশ্রাদ্ধ বলে। আদ্যশ্রাদ্ধের বিধি- বিধান আছে। শ্রাদ্ধে দানক্রিয়াই প্রধান।