কচের সঞ্জীবনী বিদ্যালাভ – মৎস্য পুরাণ – পৃথ্বীরাজ সেন

কচের সঞ্জীবনী বিদ্যালাভঃ কশ্যপের পুত্র দেবতা ও দানব। তারা বৈমাত্রেয় ভাই। নানা কারণে তাদের মধ্যে লড়াই হয়। কখন দেবতা আবার কখন দানবেরা জয়ী হয়।

মহর্ষি অঙ্গিরার পুত্র বৃহস্পতি দেবতাদের গুরু। আর শুক্রাচার্য্য হলেন দানবদের গুরু। স্বভাবতই বৃহস্পতি ও শুক্রাচার্য্যের মধ্যে একটা ঈর্ষান্বিত ভাব ছিল।

দেবাসুর যুদ্ধে যেসব দানবরা মারা যেত তাদের মন্ত্রবলে গুরু শুক্রাচার্য্য বাঁচিয়ে দিতেন। কিন্তু বৃহস্পতি নিহত দেবতাদের বাঁচাতে পারতেন না। বৃহস্পতি জানতেন না যে শুক্রাচাৰ্য্য সঞ্জীবনী মন্ত্র জানেন।

কচের সঞ্জীবনী বিদ্যালাভ - মৎস্য পুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

কচের সঞ্জীবনী বিদ্যালাভ – মৎস্য পুরাণ – পৃথ্বীরাজ সেন

একদিন দেবতারা চিন্তা করলেন যে, যেভাবেই হোক শুক্রাচার্য্যের জানা ঐ বিদ্যা আয়ত্ত করতে হবে। কিন্তু কে সেই বিদ্যা অর্জন করতে পারবে? কে শুক্রাচার্য্যের জানা ঐ বিদ্যা নিতে পারবে?

অবশেষে দেবতারা যুক্তি করে বৃহস্পতির জ্যেষ্ঠপুত্র কচের কাছে গিয়ে বললেন–আমরা বিপদে পড়েছি, হে কচ। অসুরদের দ্বারা আমাদের সৈন্য-সামন্তরা বেঁচে উঠতে পারছে না।

কিন্তু শুক্রাচার্য্যের মন্ত্রের প্রভাবে দানব-সৈন্য বেঁচে উঠছে। যেমন করেই হোক দৈত্যগুরুর কাছে গিয়ে তুমি ঐ বিদ্যাটি শিখে এস। এই কাজে তুমি সফল হলে আমাদের অংশভাগী তুমিও হবে। এখন বৃষপর্বার ঘরে শুক্রাচার্য্য অবস্থান করছেন। দানব ছাড়া অন্য কাউকে তিনি রক্ষা করেন না।

হে কচ, আমাদের একমাত্র গতি এখন তুমি। তুমি ছাড়া কেউ শুক্রাচার্য্যের আরাধনা করতে পারবে না। অপরূপ সুন্দর তুমি। শুক্রাচার্যের অতি প্রিয়তমা কন্যা দেবযানী। সেই সুন্দরীকে প্রসন্না করতে পারলে তার দ্বারা তুমি গুপ্তবিদ্যা লাভ করতে পারবে।

কচের সঞ্জীবনী বিদ্যালাভ - মৎস্য পুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

দেবতাদের এই আবেদন শুনে কচ তাদেরকে অবহেলা করতে পারলেন না। সঞ্জীবনী বিদ্যালাভ, সে তো আর যে সে কথা নয়। উৎসাহের সঙ্গে গিয়ে সে শুক্রাচার্যের সঙ্গে দেখা করে প্রণাম করে বলল–আমি মহর্ষি অঙ্গিরার পৌত্র, বৃহস্পতির পুত্র কচ। আপনার কাছে আমি বিদ্যার্জনের জন্য এসেছি। শিষ্যরূপে আপনি আমাকে গ্রহণ করুন। আপনারই আশ্রমে থেকে আমি সহস্র বৎসর ব্রহ্মচর্য পালন করব।

শুক্রাচার্য্য কচের বিনয় ভাব দেখে তাকে শিষ্য করে নিলেন। তারই গৃহে ব্রহ্মচর্য্য সাধন করছেন কচ। কিন্তু গুরুকন্যা দেবযানীকে দেখে চোখ ফেরাতে পারছে না কচ। গুরুকন্যার সঙ্গেই ঘুরে বেড়ায় বন উপবন। দেবযানী কচের প্রতি খুবই অনুরক্ত। কচ ছাড়া কিছু ভালো লাগে না।

পঁচিশ বছর এইভাবে কেটে গেল। সত্যযুগে সাধারণ মানুষের গড় আয়ু ছিল এক লক্ষ বছর।

দানবেরা একদিন বুঝতে পারল গুরুদেব শুক্রাচার্যের কাছে কচ এসেছে সঞ্জীবনী বিদ্যালাভের জন্য। কচ যদি সেই বিদ্যালাভ করে, তাহলে আর দেবতাদের বিনাশ করা যাবে না। কচকেই তার চেয়ে বিনাশ করে দেওয়া ভাল। কচ একদিন শুক্রাচার্য্যের গোরু নিয়ে চরাতে গেলে সেই সময় অসুররা তাকে গোপনে হত্যা করল। ব্যাস কাজ হাসিল।

সন্ধ্যার সময় গোরুগুলি তাদের রক্ষক ছাড়াই গোশালায় ফিরে এল। কচকে দেখতে না পেয়ে দেবযানীর বুকটা কেঁপে উঠল।

পিতা ভার্গবের কাছে ছুটে গিয়ে বলল–বাবা, সূৰ্য্য অস্তাচলে, রক্ষকহীন অবস্থায় গোধনগুলি ফিরে এল। কিন্তু কচকে দেখছি না। আমার শঙ্কা হচ্ছে কেউ তাকে হত্যা করেছে। কচ ছাড়া আমি জীবনধারণ করতে পারব না বাবা।

শুক্রাচার্য্য ধ্যানযোগে অসুরদের চক্রান্ত জানতে পেরে সঞ্জীবনী বিদ্যার প্রভাবে কচকে বাঁচিয়ে দিলেন। কচ তার চরণে প্রণাম করে সব কথা জানিয়ে দিল, কিভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

কচের সঞ্জীবনী বিদ্যালাভ - মৎস্য পুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

গুরুদেবের এমন কাজে স্বস্তি না পেয়ে দানবেরা মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করল। কচ একদিন শাশ্বত বিদ্যাপাঠ করতে এলে, দানবেরা তাকে হত্যা করে পুড়িয়ে ছাই করে, সুরার সঙ্গে মিশিয়ে শুক্রাচাৰ্য্যকে খাইয়ে দিলেন।

কচ না ফেরাতে দেবযানী চিন্তিত হয়ে পিতার কাছে গিয়ে বলল–বাবা, বহুক্ষণ হল কচ ফিরছে না। মনে হয় তাকে কেউ আবার হত্যা করেছে। তুমি কচকে ফিরিয়ে দাও বাবা, তা না হলে আমি বাঁচব না।

সেই কথা শুনে শুক্রাচাৰ্য্য বললেন–হে কন্যা, একবার আমি বৃহস্পতির পুত্র কচকে বাঁচালাম। তার আবার মৃত্যু হল। আর আমি কি করতে পারি? তুমি আর কচের জন্য কেঁদ না।

দেবযানী বলল–যার মাতামহ অঙ্গিরা, পিতা যার বৃহস্পতি, ব্রহ্মচারী, তপোধর, কর্মদক্ষ, উন্নতিশীল, এমন যুবকের জন্য আমি কঁদব না–এ কি বলছ তুমি বাবা? যদি তুমি তাকে না বাঁচাও, তাহলে আমিও তার পথের পথিক হব। আজ থেকে জলগ্রহণও করব না।

স্নেহের কন্যার আবদার রক্ষা করতে শুক্রাচার্য বললেন–যে অসুরদের গুরু আমি, সেই অসুরেরাই আমাকে হিংসা করছে! প্রচণ্ড প্রকৃতির এরা, ব্রাহ্মণ বধ করা শুরু করেছে এরা। এদের খুব শীঘ্রই পতন হবে। কে কবে ব্রহ্মহত্যা করে রক্ষা পেয়েছে?

তারপর শুক্রাচার্য্য তাঁর অমোঘ বিদ্যার প্রভাবে কচকে বাঁচিয়ে তুলে তাকে ডাকতে লাগলে, কচ তারই পেটের মধ্য থেকে বলল–গুরুদেব, আমি আপনারই উদরে।

শুক্রাচার্য্য তখন জিজ্ঞাসা করলেন–আমার পেটের মধ্যে তুমি কেমন করে এলে?

কচ তখন সব ঘটনা বলাতে ভার্গব কন্যা দেবযানীকে বললেন–কচ যদি আমার উদর চিরে বেরিয়ে আসে, তাহলে আমাকে মরতে হবে। এখন আমি কি করি?

দেবযানী বলল-কচের বিনাশে আমার সুখ-শান্তি নেই। তোমার বিহনেও আমি বাঁচব না। যে ভাবেই হোক যাতে সবার মঙ্গল হয়, তুমি তেমন কর বাবা।

অগত্যা শুক্রাচার্য্য কচকে উদ্দেশ্য করে যেহেতু দেবযানী তোমার ভজনা করছে, যদি তুমি কচরূপী ইন্দ্র না হও, তাহলে, আমার সঞ্জীবনী বিদ্যা আজ তোমাকে দিলাম। ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কেউ আমার পেট থেকে জীবিত অবস্থায় বের হতে পারবে না। তাই তুমি সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করলে। তুমি আমার পুত্রের মত। তুমি বাইরে এসে আমাকে সেই বিদ্যাবলে বাঁচিয়ে তুলবে।

গুরুর আজ্ঞামত কচ বেরিয়ে এসে সেই মন্ত্রের প্রভাবে গুরুদেবকে সুস্থ করে তুলল।

তারপর শুক্রাচাৰ্য্য ব্রাহ্মণদের হিতের জন্য বললেন–যে কোন অল্প বুদ্ধি ব্রাহ্মণ আজ থেকে অজ্ঞানবশতঃ সুরা পান করলে, সে ইহ-পরলোকে ধর্মভ্রষ্ট হবে। ব্রহ্মহত্যা পাপে লিপ্ত হবে, সবার কাছে। নিন্দিত হবে।

তারপর দানবগণের প্রতি তিনি বললেন–তোমরা অতি মূর্খ, যাকে তোমরা দু’বার বিনাশ করলে সে আমার শিষ্য কচ। সে আমার কাছে সঞ্জীবনী বিদা লাভ করল। আমারই তুল্য প্রভাবশালী হল সে।

এক হাজার বছর পাঠ করে কচ স্বর্গে ফিরে যাবার জন্য শুক্রাচার্যের কাছে অনুমতি নিতে এলেম, এভাবে কচকে চলে যেতে দেখে দেবযানী বলল–হে প্রিয়, তুমি কুল, শীল, বিদ্যা, তপ ও ইন্দ্রিয় সংযম করে মহাগুণমান। মহর্ষি অঙ্গিরা যেমন আমার পিতার মাননীয়, তেমনি আমার মাননীয় মহাভাগ বৃহস্পতিও।

কচের সঞ্জীবনী বিদ্যালাভ - মৎস্য পুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

তোমার ব্রত নিয়মাদি পালনের সময় আমি তোমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছি, তোমার ব্রত পালন শেষ হওয়াতে তোমার প্রতি অনুরক্তা আমাকে পরিত্যাগ করা তোমার উচিত নয়। তুমি এখন মন্ত্রপাঠ করে আমাকে বিয়ে কর।

দেবযানীর কথা শুনে কচ বলল–তোমার মুখে এমন কথা শোভা পায় না, কারণ, তোমার পিতা যেমন আমার পূজনীয়, তেমনি গুরুকন্যা হিসাবে তুমি আমার পূজনীয়া।

তখন দেবযানী বলল–অসুরগণ যখন তোমাকে বার বার হত্যা করল, তখন থেকেই তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মেছে। তা তোমার স্মরণ করা উচিত।

হে প্রিয়তম, তোমার প্রতি আমার যে অনুরাগ জন্মেছে তা তোমার অজানা নয়, তাই আমাকে উপেক্ষা করা উচিত নয় তোমার।

কচ আবার বলল–আমাকে ক্ষমা কর দেবযানী। যাঁর ঔরসে তুমি জন্মগ্রহণ করেছ, তার উদরে আমিও বাস করেছি। কাজেই ধর্মানুসারে তুমি আমার ভগিনী হও। এমন কথা আর বোলো না। ধর্মানুসারে কথা প্রসঙ্গে তুমি আমাকে স্মরণ কোরো। আর নিত্য আমার গুরুদেবের সেবা কোরো।

দেবযানী বল–হে কচ, দৈত্যদের দ্বারা যখন তুমি মারা গেলে, তখন তোমাকে আমি স্বামীর জ্ঞানেই রক্ষা করেছি। তারপর একটু রেগেই বলল দেবযানী–আমাকে বিয়ে না করে যদি তুমি চলে যাও, তাহলে তোমাকে এই অভিশাপ দিচ্ছি, তোমার বিদ্যা সিদ্ধ হবে না।

দুঃখিত হয়ে কচ বলল–দেবযানী, তোমাকে গুরুকন্যা রূপেই ত্যাগ করছি। গুরুর অনুমতি পেয়েছি আমি ফিরে যাবার। কেন আমাকে এমন অভিশাপ দিলে তুমি?

ধর্মানুসারেই সব কথা বলেছি আমি। তোমার উচিত হয়নি আমাকে শাপ দেওয়া। তুমি যেমন অন্যায়ভাবে আমাকে শাপ দিলে, তাই তোমারও কামনা সিদ্ধ হবে না। কোন ঋষিকুমার তোমাকে বিয়ে করবে না।

হে গুরুপুত্রি, আমার বিদ্যা তোমার শাপে সিদ্ধ না হলেও, যাকে আমি শিক্ষা দেব তার বিদ্যা সিদ্ধ হবে। এই কথা বলে কচ স্বর্গলোকে উপস্থিত হলে ইন্দ্রাদি দেবগণ মহানন্দে কচকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল–তুমি আমাদের মহামঙ্গলজনক কর্ম করেছ। তোমার এই কীর্তি অক্ষয় হবে। তুমি দেবগণের ফলভোগী হবে।

আরও পড়ুনঃ

ভাগবত পুরাণ – ০৫ম স্কন্ধ – ভাগবত পুরাণ – পৃথ্বীরাজ সেন

ভাগবত পুরাণ

Leave a Comment