কালীর তপস্যা – শিব মহাপুরাণ – পৃথ্বীরাজ সেন

কালীর তপস্যাঃ শিব পার্বতীকে বিবাহ করে কৈলাসে আনলেন। পার্বতী রাজার কন্যা। শিবের নিজস্ব কোনো ঘর নেই। তিনি থাকবেন কোথায়? এতোদিন ঘরের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু এখন ঘর না হলেই নয়, তাই বিশ্বকর্মাকে ডেকে ঘর নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হলো। তৈরি হল বিশাল প্রাসাদ। পার্বতী সেই প্রাসাদ দেখলেন এবং বললেন, মোটামুটি ঠিক আছে। তবে আমার বাবার প্রাসাদের থেকে সামান্য ছোটো। একেবারে নিরাশ্রয়ের থেকে এই ভাল। তিনি মহাদেবকে বললেন, যেদিন গৃহে প্রথম প্রবেশ করা হবে সেদিন যেন একটা যজ্ঞ করা হয়।

 কালীর তপস্যা - শিব মহাপুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

পার্বতীর কথা শুনে মহেশ্বর খুব খুশি হলেন। গৃহস্থদের মত তিনি যজ্ঞ করলেন। সেই যজ্ঞে ঋষিগণ, দেবতাগণ আর যতসব প্রমথগণও এলেন। মহা ধুমধামে যজ্ঞ ক্রিয়া শেষ হল, নানারকম ভক্ষ্য ভোজে সবাই খুশি হল। উমা সেই গৃহে মহাদেবের সঙ্গে আনন্দে থাকতে লাগলেন। আগে শিব একা একা থাকতেন, ‘বোম্‌ বোম্’ করে ঘুরে বেড়াতেন। এখন তিনি পার্বতীকে নিয়ে গার্হস্থ জীবনযাপন করছেন। কারও কোনও কষ্ট নেই।

কালীর তপস্যা – শিব মহাপুরাণ – পৃথ্বীরাজ সেন

মহাদেব একদিন কথার ছলে পার্বতীকে ‘কালী’ বলে সম্বোধন করলেন। শিব একটু রসিকতা করেছিলেন কিন্তু উমা বুঝতে পারেন নি। তিনি মনে খুবই দুঃখ পেলেন। তখন তাঁর মনে দীনতা এলো।

তিনি অভিমান করে বললেন–হে পরমেশ্বর, কোন গাছকে যদি কুঠার দিয়ে কেটে ফেলা হয় তখন কাটা জায়গা দিয়ে আবার কচি পাতা বের হয়। তারপর গাছটি বিশাল বৃক্ষের আকার ধারণ করে।

কিন্তু কেউ যদি কটু কথা বলে কাউকে আঘাত করে তাহলে সেই মনোব্যথা দূর করা যায় না। মুখ থেকে যে বাক্যবাণ বেরোয় সেটা যখন আঘাত করে, আহত জন সব সময় মনোবেদনা ভোগ করে।

যিনি জ্ঞানবান হন, তিনি কখনও কটুবাক্য প্রয়োগ করেন না। হে নাথ, আজ তুমি ধর্ম অতিক্রম করলে আর কোনদিন যাতে তুমি আমাকে কালী’ না বলতে পারো তার জন্য আমি তপস্যা করতে চাই। তুমি অনুমতি দাও।

এই বলে পার্বতী শিবের চরণে প্রণাম করলেন। তখন শিব কিছুক্ষণ চিন্তা করে উমাকে তপস্যার অনুমতি দিলেন।

স্বামীর অনুমতি পেয়ে উমা ব্যোমযানে উঠলেন। তারপর হিমালয়ে এক শৃঙ্গে একটি সুন্দর জায়গা পরিদর্শন করে সেখানে তপস্যায় বসলেন। তখন তিনি ভাবতে লাগলেন –একা তপস্যায় বসলে অনেক রকম বাধাবিঘ্ন আসতে পারে।

তাই তিনি তাঁর চারজন সখীকে ডেকে পাঠালেন। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে জয়া, বিজয়া, জয়ন্তী, আর অপরাজিতা হাজির হলেন। খুব আনন্দের সঙ্গে তারা পার্বতীর সেবায় ব্রতী হলো।

একদিন শিবকে পাবার জন্য গিরিরাজের কন্যা একমনে কঠোর তপস্যায় মন দিলেন। পার্বতী যেমন তপস্যা করেছিলেন, এখন ঠিক তেমনি তপস্যা করলেন।

 কালীর তপস্যা - শিব মহাপুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

একদিন একটি বাঘ ঘুরতে ঘুরতে আশ্রমে ঢুকে পড়ল। সে দেখল একটি নারী একপায়ে দাঁড়িয়ে তপস্যা করছে। তখন বাঘটি ভাবল–এই নারী তপস্বিনী, একে খাওয়া উচিত হবে না। তপস্যায় সিদ্ধ হলে এই নারী যখন বরলাভ করবে, তখন আমি একে খাইনি বলে আমিও বরলাভ করবো।

বাঘ যখন এই সমস্ত ভাবছে, তখন পার্বতীর চার সখী সেখানে ছিল না। সেই বাঘ তখন সেখানেই বসে রইলো। চার সখী আশ্রমে বাঘকে দেখে খুব ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু বাঘকে শান্ত থাকতে দেখে তারা যে যার কাজ করতে লাগলো।

বিধাতাকে প্রসন্ন করার জন্য পার্বতী কঠোর তপস্যা করছেন। এভাবে একশো বছর পার হয়ে গেল। ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে উমার সামনে উপস্থিত হলেন।

ব্রহ্মা বললেন, আমি তোমার তপস্যায় সন্তুষ্ট। এখন তুমি বল, কি প্রার্থনা তোমার?

ব্রহ্মার কথা শুনে দেবী পার্বতী খুব খুশি হলেন এবং বললেন, হে পদ্মাসন, আমাকে বর দেবার আগে এই বাঘটিকে বর দিন।

দেবীর কথা শুনে ব্রহ্মা সেই বাঘকে বর দিলেন–হে বাঘ, তুমি সানপত্য লাভ করবে। ভগবানে তোমার ভক্তি থাকবে আর সব জায়গাতেই তোমার জয় হবে।

বাঘকে ব্রহ্মা বরদান করার পর পার্বতীকে বললেন, এবার তুমি বর চাও। তুমি যা চাইবে আমি তাই দেবো।

তখন দেবী পার্বতী ব্রহ্মাকে বললেন, আমার গায়ের রঙ কালো, এই রঙকে আপনি সোনার বর্ণ করে দিন।

ব্রহ্মা বললেন–তাই হবে, এই বলে তিনি চলে গেলেন।

দেবী তখন কৃষ্ণবর্ণ মূর্তি ত্যাগ করে সোনার প্রতিমার রূপ ধারণ করলেন। দেবী যে দেহটি পরিত্যাগ করলেন, সেখান থেকে আর একজন দেবীর উৎপত্তি হলো।

সেখানে ইন্দ্র উপস্থিত হয়ে বললেন–হে দেবী, তোমার দেহকোষ থেকে উৎপন্ন এই দেবীর নাম হবে কৌশিকী, এই কৌশিকী আমার ভগ্নী হল। তাই আমি হলাম কৌশিক। হে পর্বত নন্দিনী, এই দেবীকে এখন আমাকে দাও।

পার্বতী ইন্দ্রের সব কথা শুনলেন, এবং তারপরে তিনি কৌশিকীকে ইন্দ্রের হাতে তুলে দিলেন। ইন্দ্র তাকে নিয়ে আনন্দে বিন্ধ্যাচলে চলে গেলেন। বিন্ধ্যাচলের সৌন্দর্য দেখে দেবী খুব খুশি হলেন। বললেন–আমি এখানেই বাস করবো।

ইন্দ্র তখন দেবীকে সেখানেই স্থাপন করলেন। একটা সিংহকে এনে তার বাহন করে দিলেন। তারপর বললেন–হে দেবী, এই বিন্ধ্যপর্বত তোমার অধিষ্ঠানের জন্য ধন্য, আর পুণ্যক্ষেত্র রূপে পরিগণিত হবে।

আর তুমি বিন্ধ্যবাসিনী নামে খ্যাত হবে। দেবতাগণ এখানে এসে যথাবিধিমতো তোমার পূজা করবে। সবার পূজা পেয়ে তুমি বিজয়িনী হবে। আর তুমি আমাদের শত্রুদের সংহার করবে।

 কালীর তপস্যা - শিব মহাপুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

এইভাবে দেবীকে সেখানে প্রতিষ্ঠা করলেন ইন্দ্র এবং তারপরে তিনি নিজে ইন্দ্রপুরীতে ফিরে গেলেন।

পার্বতী এদিকে ব্রহ্মার বর লাভ করে খুব খুশি হয়েছেন। তিনি আনন্দে কৈলাসে গিয়ে মহেশ্বরের চরণে প্রণাম করলেন। পার্বতীকে দেখে শিব একেবারে অবাক।

প্রেমপূর্ণভাবে তখন গৌরীকে আলিঙ্গন করলেন, পরিহাসছলে তিনি উমাকে কালো বলেছিলেন, আর সেইজন্যই আজ গৌরী স্বর্ণপ্রভা সমউজ্জ্বলা।

শিব পার্বতীর সঙ্গে কৈলাসে খুব আনন্দের সঙ্গে বাস করছেন। তাঁরা হাজার বছর ধরে রতিক্রিয়ায় রত হলেন, অগত্যা সবাই ছুটলেন ব্রহ্মার কাছে, সবার মুখে একই কথা, কেন এমন হল?

স্থির হয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন ব্রহ্মা। অন্তর্যামী দেখতে পেলেন হর- গৌরীর রতিক্রিয়ার ফলে এমন হচ্ছে দেবগণকে জানালেন সেই কথা। সেজন্য ত্রিভুবন আক্রান্ত।

ব্রহ্মা দেবতাদের এই কথা বলে চুপ করে গেলেন। শঙ্করের এই মোহ কীভাবে নাশ হবে তার উপায় তিনি বললেন–না। যতকাল শিবের এই মোহের সমাপ্তি না হয়, ততকাল তারা সেখানে অবস্থান করবেন বলে স্থির করেন।

শঙ্করের এই রতিক্রিয়া শেষ হলে নিশ্চয় তাঁর পুত্র হবে। হাজার বছর রতিক্রিয়ার ফলে যে পুত্র হবে, সে নিশ্চয় খুব তেজস্বী হবে।

এই সকল কথা ভেবে ইন্দ্র খুব ভয় পেয়ে গেলেন দেবতাদের এই আলোচনা শুনে। শঙ্করের পুত্র যদি খুব তেজীয়ান হয়, তাহলে সে যুদ্ধে ইন্দ্রকে হারিয়ে দিয়ে স্বর্গের সিংহাসন লাভ করবে।

কাজেই আর দেরি করা উচিত নয়। সব দেবতাগণ চললেন কৈলাসের মন্দার পর্বতে কিন্তু শিবের প্রাসাদ ঘরে যেতে কেউ সাহস করছেন না। না জানি কি বিপদ ঘটবে।

সব দেবতারা ঠিক করলেন, তারা অগ্নিকে সেখানে পাঠাবেন। কারণ দেবতাদের মধ্যে সব থেকে ছোটো হল অগ্নি। সবাই তাকে ভৃত্যের মতো খাটায়।

সবার আজ্ঞায় অগ্নি ভয়ে ভয়ে শিবের দ্বারের কাছে গেলেন। সেখানে গিয়ে ভাবতে লাগলেন সেখানে তিনি ঢুকবেন কি করে, কারণ দ্বারদেশে দ্বারপালিনিরূপে নন্দী দাঁড়িয়ে আছেন, দেখে সবারই ভয় লাগে। বহু চিন্তা করলেন, কিন্তু তিনি কোনো উপায় বার করতে পারলেন না।

তিনি হঠাৎ করে দেখতে পেলেন একটি হাঁসের দল সেই দ্বারদেশ দিয়ে বাইরে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি উপায় স্থির করে ফেললেন। ওই হাঁসগুলো সন্ধ্যায় যখন প্রসাদে ঢুকবে তখন তাদের সঙ্গে তিনিও হাঁসরূপে ঢুকে পড়বেন। সেই ভাবেই নন্দীকে ফাঁকি দিয়ে প্রাসাদে ঢুকে পড়লেন।

তারপরে হংস দেহে শঙ্করের মাথার কাছে গিয়ে বললেন–হে মহেশ্বর, আপনি কি করছেন? আপনার গৃহের দ্বারে কত দেবতা বসে আছেন, আপনি একবার গিয়ে দেখুন।

শঙ্কর এই কথা শুনে চমকে উঠলেন। তখন তিনি পার্বতীকে ছেড়ে অগ্নির সঙ্গে দ্বারের বাইরে এলেন। দেবতাদের দেখলেন। তিনি দেখলেন তার অপেক্ষায় সবাই দাঁড়িয়ে আছেন।

শিবকে দেখতে পেয়ে দেবতারা তাঁকে প্রণাম করলেন। মহেশ্বর তখন বললেন, আপনারা কিসের জন্য এসেছেন? যদি কোনো বরের প্রয়োজন থাকে, তাহলে আমি এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছি।

তখন দেবতারা বললেন, হে ঈশ্বর, আপনি মহতি মৈথুন কাজে লিপ্ত আছেন। তা থেকে বিরত হোন।

মহেশ্বর বললেন, আপনারা যা চাইছেন তাই হবে। কিন্তু এই মৈথুনে এ পর্যন্ত যে রেতঃ সংগৃহীত হয়েছে, আপনাদের মধ্য থেকে কাউকে ধারণ করতে হবে।

শঙ্করের কথা শুনে দেবতারা একেবারে ভেঙে পড়লেন। মাথা নিচু করে সকলে উঠে পড়লেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই। মহাবলবান শিব রেতঃ ধারণ করতে পারবে কে? তাই সবাই বিশেষ চিন্তাগ্রস্ত হলেন।

অগ্নিদেব সকল দেবতাদের অবস্থা নিরীক্ষণ করলেন। তিনি নিজে শিবের কাছে গিয়ে বললেন, হে মহেশ্বর, আপনার রেতঃ আমাকে দিতে পারেন।

 কালীর তপস্যা - শিব মহাপুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

শঙ্কর তার রেতঃ অগ্নিদেবকে দিলেন! অগ্নি তা পান করে পরিতৃপ্ত হলেন। তার পর শঙ্করকে সবাই প্রণাম করে যে যার গৃহে চলে গেলেন।

শিবের শুক্র পান করে ক্রমে ক্রমে অগ্নি হীনবল হয়ে পড়লেন। এইভাবে পাঁচ হাজার বছর কেটে যায়। অগ্নি আর সেই রেতঃ তেজ সহ্য করতে পারছেন না দেখে দেবতারা ভাবতে লাগলেন, কী করা যাবে। সবাই যুক্তি দিলেন পিতামহের কাছে যাবার।

অগ্নি ব্রহ্মলোকে চলেছেন। যেতে যেতে তাঁর কুটিলার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তিনি সব ঘটনা বললেন–জলময় কুটিলাকে। তারপর অগ্নি অনুরোধ করলে কুটিলাকে বললেন, শিবের রেতঃ ধারণ কর। তুমি যদি এই কাজ কর তাহলে তোমার সুন্দর পুত্র হবে। সেই পুত্র সকলের কাছে প্রশংসা পাবে।

কুটিলা গিরিরাজের কন্যা, কুটিলা চিন্তা করে দেখল এমন সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। তখন অগ্নিকে কুটিলা বলল, শিবের রেতঃ তার জলে ফেলে দিতে।

কুটিলার কথা শুনে অগ্নি খুব খুশি হয়ে সেই রেতঃ ফেলে দিলেন কুটিলার জলে। কুটিলা আনন্দের সঙ্গে সেই রেতঃ ধরে রাখলেন।

অগ্নিদেব পাঁচ হাজার বছর ধরে রেখেছিলেন শিবের রেতঃ। তাই অগ্নির মাংস, মেদ, রক্ত, মজ্জা, রোম, চক্ষু, মাথার চুল, গোঁফ-দাঁড়ি পর্যন্ত সোনার মত হয়ে গেল। তখন থেকেই অগ্নিদেব ‘হিরণ্যরেতা নামে খ্যাত হলেন।

কুটিলাও শিরেয় রেতঃ ধরে রাখলেন পাঁচ হাজার বছর ধরে। এতে তার গর্ভ পূর্ণ হল। কিন্তু তিনি এই গর্ভ ধরে রাখতে না পেরে ব্রহ্মার কাছে গেলেন, ব্রহ্মা তাকে দেখে বললেন, তোমার গর্ভ কে তৈরি করল?

কুটিলা তখন সব ঘটনা বলল। তিনি বললেন, আমি পাঁচ হাজার বছর ধরে আছি কিন্তু পুত্র প্রসব হচ্ছে না।

পিতামহ বললেন, তুমি উদয়াবনে যাও। সেখানে বিশাল শরবন আছে, সেখানে তুমি এই গর্ভ ত্যাগ কর, আরও দশ হাজার বছর পরে ওর থেকে পুত্রের জন্ম হবে।

ব্রহ্মা কথামতো কুটিলা উদয়াবনে গেল এবং সেখানে তিনি মুখ দিয়ে গর্ভ পরিত্যাগ করলেন।

এইভাবে দশ হাজার বছর কেটে গেল। সেই তেজের প্রভাবে উদয়াবনে বৃক্ষলতা, পশু-পক্ষী সবই সোনার মত রং হয়ে গেল। তারপরে সেই তেজঃ থেকে এক পুত্রের জন্ম হল। শিশুটি মুখে আঙুল দিয়ে ‘উঙা উঙা’ কাঁদতে লাগল।

বনের মধ্যে সেই সময় ছয়জন কৃত্তিকা ঘুরছিল। তারা শুনতে পেল একটি সদ্যোজাতের কান্না, তারা গিয়ে দেখল শিশুটি অপূর্ব সুন্দর, তারা ভাবল এমন জায়গায় সদ্যোজাত শিশু এল কেমন করে?

কে ফেলে দিয়ে গেল? যাইহোক তারা সকলেই শিশুটিকে কোলে নিতে চাইল। সকলেই তাকে নিজের স্তনপান করাতে চাইল।

অগ্নিকে ডেকে ব্রহ্মা বললেন, গুহ নামে তোমার পুত্র হল সে কেমন হল। ব্রহ্মার কথা শুনে অগ্নি অবাক হলেন এবং ব্রহ্মাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি গুহ কাকে বলছেন? এই নামে আমি কাউকে চিনি না।

তখন ব্রহ্মা বললেন–তুমি যে শঙ্করের রেতঃপান করেছিলে এবং তুমি কুটিলাকে দিলে পরে কুটিলা তা শরবনে ফেলেছে, তা থেকেই পুত্র জন্মেছে, তারই নাম গুহ।

 কালীর তপস্যা - শিব মহাপুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

ব্রহ্মার কথা শুনে অগ্নি তাড়াতাড়ি শরবনের দিকে গেল। যেতে গিয়ে কুটিলার সঙ্গে দেখা হলো। কুটিলা জিজ্ঞেস করলো, তুমি কোথায় যাচ্ছো?

অগ্নিদেব বললেন, শরবনে যাচ্ছি সেখানে আমার পুত্র সন্তান জন্ম নিয়েছে।

কুটিলা শুনে বললেন, সে তো আমার পুত্র। তুমি তাকে ধরে রাখতে পারোনি বলে আমি তাকে ধরেছিলাম, কাজেই সে আমার পুত্র।

তুমি ঠিক বলেছো কিন্তু আমি যদি তোমাকে না দিতাম, তাহলে তুমি পেতে কেমন করে?

এইবারে দুজনে ঝগড়া করতে লাগলেন, তখন নারায়ণ জিজ্ঞেস করলেন কলহের কারণ।

অগ্নি বললেন–শঙ্করের তেজে শরবনে এক পুত্রের জন্ম হয়েছে, সেই পুত্র কার? এই নিয়েই আমাদের দ্বন্দ্ব।

নারায়ণ তখন তাদের শিবের কাছে যেতে বললেন। তিনিই বলতে পারবেন এই পুত্র কার।

দুজনেই তারা চলল শিবের কাছে। শিবকে প্রণাম জানিয়ে তাকে তারা জিজ্ঞেস করলেন, শরবনে যে পুত্রের জন্ম হয়েছে সেটি কার?

তাদের কথা শুনে শিব আনন্দে বললেন, আজ আমি পুত্রের মুখ দেখতে পাব।

পার্বতী সব শুনে বললেন, চলুন, আমরা এক্ষুনিই যাই সেই বালকের কাছে। সেই পুত্রকে দেখার জন্য আমার মনটা বড় অস্থির হয়ে উঠেছে। আর বালকটিকে নিয়ে যখন এতো দ্বন্দ্ব তখন তাকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে কে তার পিতা-মাতা।

উমার কথা শুনে শিব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লেন কুমারকে দেখার জন্য। সঙ্গে গেলেন গিরিজা, পাবক আর কুটিলা।

তাঁরা গিয়ে দেখলেন কুমার দুজন কৃত্তিকার কোলে শুয়ে আছেন। ছয়মুখ দিয়ে প্রত্যেকের স্তন্য পান করছে।

সেই কুমার তাদের প্রত্যেকের অভিসন্ধি বুঝতে পারলেন, তিনি কুমার মূর্তি দেখালেন শঙ্করকে। বিশাল দেহে দেখা দিলেন গিরিরাজকে।

আর সুন্দর রূপ দেখালেন কুটিলাকে এবং অগ্নিকে দেখালেন মহান রূপ। শঙ্কর, শঙ্করী, অগ্নি, কুটিলা সকলেই কুমারকে দেখে খুশি হলেন। কৃত্তিকাগণ তখন উপলব্ধি করলেন এই পুত্র শিবের।

শিব কৃত্তিকাগণকে বললেন, এই শিশু তোমাদের। তাই আমি এর নাম দিলাম কার্তিকেয়। আর এই শিশু কুটিলার কুমার, পার্বতীর স্কন্দ।–আর গুহ আর পাবকের মহাসেন। আর সে যেহেতু সারবনে জন্মেছে তাই তার নাম হবে সারস্বত।

নামকরণ করার পর শিব দেবতাদের এবং ব্রহ্মাকে স্মরণ করলেন। তারা সকলে এসে হর পার্বতীকে প্রণাম জানালেন। এবং তারা ছয় মুখ যুক্ত শিশুকে দেখে অবাক হলেন। তার দেহ থেকে সূর্যের জ্যোতি বের হচ্ছে।

অগ্নিকে সকল দেবতারা বললেন, হে পাবক, এই বালকের দেবকার্য অভিষেক কার্য সমাধা কর আমরা এখন কুরুক্ষেত্রে সরস্বতী তীর্থে গিয়ে এই কুমারের অভিষেক করব। এই কুমারের জন্য আমরা বহুকাল প্রতীক্ষা করে আছি। এই কুমারের হাতেই মরবে তারকাসুর।

 কালীর তপস্যা - শিব মহাপুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

শিব দেবতাদের কথায় খুব খুশি হলেন। দেবতাগণ তখন কুমারকে নিয়ে কুরুক্ষেত্রে গেলেন। মহা ধূমধামে সেখানে ঋষি ও ব্রহ্মা অভিষেক করলেন কুমারের।

তাঁকে অনেক বনৌষধি ও সাত সমুদ্রের জল ঢেলে স্নান করানো হলো। অভিষেক অনুষ্ঠানে সন্দর্য ও চারণগণ মধুর গীত গাইলেন এবং নানারকম বাদ্য বাজালেন।

উমা তার স্কন্দকে কোলে নিলেন এবং তাকে আদর করলেন এবং চুমু খেলেন। শিব, কুটিলা, অগ্নি সবাই খুব আনন্দিত হলেন। তারপর সেই কুমারকে দেবসেনাপতি পদে বরণ করা হলো।

শিব, ব্রহ্মাদি এবং সকল দেবতারা সেই কুমারের সাহায্যের জন্য বহু বাণকে উপহার দিলেন। কার্তিকের বাহনের জন্য গরুড় তাঁর পুত্র ময়ূরকে দিলেন। তারপর সেই কুমার পিতা-মাতাকে প্রণাম করলেন।

 কালীর তপস্যা - শিব মহাপুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

বিষ্ণু, ব্রহ্মাদি দেবতাগণকে প্রণাম জানিয়ে ময়ূরের পিঠে চড়লেন এবং তারকাসুরকে বিনাশ করবার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment