Site icon Sanatan Gurukul [ সনাতন গুরুকুল ] GOLN

জীবসেবা: করুণা, সদয়তা ও মানবিকতার পাঠ

জীবসেবা হলো মানবিকতা, করুণাবোধ এবং ঈশ্বরপ্রেমের এক চিরন্তন শিক্ষা। জীবন শুধু মানুষেরই নয়; পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ ও উদ্ভিদ—যথেষ্ট যে প্রাণ আছে, সবকিছুকে জীব বলা যায়। প্রাচীনকাল থেকে মহাপুরুষরা জীবসেবার অসামান্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তারা আমাদের দেখিয়েছেন, যখন আমরা জীবের কল্যাণে কাজ করি, তখন প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের সেবায় লিপ্ত হই।

এই আলোচনায় আমরা গৌতমবুদ্ধের বাল্যকালীন একটি চমকপ্রদ জীবসেবার গল্পের মাধ্যমে দেখব কিভাবে জীবের প্রতি করুণা, দয়া এবং সদয় মনোভাব মানুষকে নৈতিকতা ও মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ করে। আহত একটি হাঁসের প্রতি তাঁর সেবা এবং মমতার দৃষ্টান্ত আজও আমাদের জন্য জীবসেবার পথপ্রদর্শক।

জীবসেবা

 

 

মানুষ, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ প্রভৃতিকে জীব বলা হয়। উদ্ভিদকেও জীব বলে। কারণ এদের জীবন আছে। যাদের জীবন বা প্রাণ আছে তারাই জীব। ঈশ্বর জীব সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি আত্মারূপে জীবের মধ্যে বাস করেন। তাই আমরা যখন কোন জীবের সেবা করি, তখন জীবের সেবার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সেবা হয়ে যায়।

জীবের মধ্যে আত্মা রূপে ঈশ্বর আছেন, একথা কেউ যদি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়, তাহলে তার কাছে আর আপন- পরের ভেদাভেদ থাকে না। তখন অপরের দুঃখকে নিজের দুঃখ বলে মনে হয়। অন্যের আনন্দে নিজের আনন্দ হয়। অপরের দুঃখ দূর করতে তিনি নিজের জীবন বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হন না। জীবের জন্য এমনভাবে কাজ করাকেই বলা হয় জীবসেবা ।

যুগে যুগে মহাপুরুষেরা জীবসেবার অমর দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। জীবসেবার এমন একটি দৃষ্টান্ত রয়েছে সিদ্ধার্থ ও দেবদত্তের জীবনের একটি কাহিনীতে। গৌতমবুদ্ধ শান্তি, মৈত্রী, অহিংসা করুণার বাণী প্রচার করেছেন। তিনি বলেছেন, জীবকে ভালবাস, জীবের সেবা কর। জীবসেবার জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি ছিলেন রাজপুত্র ।

কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্ধোদন ছিলেন তাঁর পিতা । রাজপুত্র হয়েও তিনি বিলাস-ব্যাসনের জীবন পরিত্যাগ করে মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে ভেবেছেন। মানুষ যাতে দুঃখ থেকে মুক্তি পায়, মানুষ যাতে শান্তি পায় তার উপায় খুঁজে বের করার জন্য কঠোর সাধনা করেছেন । শুধু মানুষ নয়, পশু-পাখিসহ সকল প্রকার জীবের জন্যও তাঁর মমতা ছিল অপরিসীম।

 

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে জীবসেবার প্রেরণার পরিচয় পাওয়া যায়। গৌতমবুদ্ধের বাল্যনাম ছিল সিদ্ধার্থ। একদিন বিকেল বেলা। সিদ্ধার্থ বসে আছেন একটি বাগানে। বাগানে অনেক ফুল গাছ। ফুলের গন্ধে চারদিক ভরপুর। রকমারি ফুলের বিচিত্র রঙের দিকে তাকিয়ে আছেন সিদ্ধার্থ। আশ- পাশের গাছগুলো থেকে ভেসে আসছে পাখির কাকলি।

একি! পায়ের কাছে ঝুপ করে কি পড়ল ওটা? সিদ্ধার্থ তাকিয়ে দেখলেন, একটি হাঁস । হাঁসটির একটি পায়ে তীর বিধে আছে। সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে হাঁসটি। হাঁসটির দশা দেখে খুবই কষ্ট পেলেন সিদ্ধার্থ। জীবের এই কষ্টে করুণায় গলে গেল তাঁর মন। তিনি লেগে পড়লেন জীবসেবায়। তিনি হাঁসটির পা থেকে সযত্নে তীরটি খুলে ফেললেন যাতে হাঁসটি বেশি কষ্ট না পায়। তারপর শুরু করলেন হাঁসটির সেবা-শুশ্রূষা ।

যাদের জীবন বা প্রাণ আছে, তাদের জীব বলা হয়। ঈশ্বর শুধু যে জীব ও জগৎ সৃষ্টি করেছেন তা নয়। তিনি জীবের আত্মারূপে জীবের মধ্যে বাস করেন। তাই জীবসেবা করলে ঈশ্বরের সেবা করা হয় । মহাপুরুষেরা জীবসেবার অনেক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।

সিদ্ধার্থ বা গৌতব বুদ্ধের বাল্যকালে জীবসেবার একটি ঘটনা ‘জীবসেবা’ শীর্ষক বর্তমান পাঠটির বিষয়বস্তু। দেবদত্ত কর্তৃক তীরবিদ্ধ একটি হাঁসের কষ্টে কষ্ট পান এবং তার সেবা-শুশ্রূষা করতে থাকেন ।

 

 

সিদ্ধার্থ যেখানে বসে হাঁসটির শুশ্রূষা করছিলেন, সেখানে দৌড়ে এসে উপস্থিত হলেন দেবদত্ত। এই দেবদত্ত ছিলেন সিদ্ধার্থের
খেলার সাথী। দেবদত্ত এসে বললেন, হাঁসটি – এই যে সিদ্ধার্থ, দেখছি তোমার কাছে। আমিই হাঁসটিকে তীরবিদ্ধ করেছি। শিকার শিকারীরই প্রাপ্য। তাই হাঁসটি আমার। আমার হাঁস আমাকে দিয়ে দাও। উত্তরে সিদ্ধার্থ বললেন,

– দেবদত্ত, হাঁসটি তোমাকে আমি দেব না ।

– কেন, আমার হাঁস, আমাকে দেবেনা কেন?

– তুমি হাঁসটিকে তীরবিদ্ধ করে অন্যায় করেছ দেবদত্ত। তোমাকে আঘাত করলে যেমন তুমি কষ্ট পাও, তেমনি তোমার আঘাতে অন্য জীবও কষ্ট পায়। হাঁসটি তোমার তীরে আহত হয়ে কি কষ্ট পাচ্ছে, দেখ। এখন আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, ওর শুশ্রূষা করে ওর কষ্ট দূর করার চেষ্টা করা। দেবদত্ত রেগে গেলেন । বললেন – সিদ্ধার্থ, ওসব কথা শুনতে আমি আসি নি। শিকার করেছি, শিকার খুঁজে পেয়েছি। আমার শিকার আমি নিয়ে যাব, ব্যাস।’ শান্ত, ধীর ও গম্ভীর কণ্ঠে সিদ্ধার্থ বললেন –

– রাগ করো না, দেবদত্ত। নিজের কষ্টের কথা ভেবে অন্যের কষ্ট বোঝার চেষ্টা কর। এ হাঁসটিরও প্রাণ আছে। সুখ-দুঃখের অনুভূতি আছে। তুমি যেমন তোমার জীবনকে ভালবাস, হাঁসটিও তার জীবনকে তেমনি ভালবাসে। জীবন বিনাশ না করে জীবন রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।

 

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

দেবদত্ত একটু নরম হলেন ।

সিদ্ধার্থ বলে যেতে লাগলেন

– হাঁসটি তোমার হাতে দিয়ে তাকে আমি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না । তুমি এর পরিবর্তে যা চাইবে, আমি তাই দেব। বল, তুমি কি চাও?

আহত হাঁসটির জীবনের জন্য সিদ্ধার্থের মমতা দেখে মুগ্ধ হলেন দেবদত্ত। সিদ্ধার্থের জীবসেবার আদর্শ তাঁর হৃদয়কেও স্পর্শ করল। সিদ্ধার্থ হাঁসটিকে সুস্থ করে আকাশে উড়িয়ে দিলেন। আর দেবদত্ত সিদ্ধার্থের প্রশান্ত মুখের দিকে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

সিদ্ধার্থ যেখানে বসে আহত হাঁসটির শুশ্রূষা করছিলেন, সেখানে এলেন দেবদত্ত। তিনিই হাঁসটিকে তীর বিদ্ধ করেছিলেন। তিনি এসে তাঁর শিকার নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু সিদ্ধার্থ তাকে ফিরিয়ে দিতে রাজি হলেন না। কারণ জীব হত্যা পাপ।

জীবকে রক্ষা করা কর্তব্য। হাঁসটির পরিবর্তে দেবদত্তকে তিনি যা ইচ্ছা তাই চেয়ে নিতে বললেন। সিদ্ধার্থের জীবসেবার আদর্শ দেখে মুগ্ধ হলেন দেবদত্ত। সিদ্ধান্ত হাঁসটিকে শুশ্রূষা করে সুস্থ করে আকাশে উড়িয়ে দিলেন।

Exit mobile version