দেবী দুর্গাকে নিয়ে মানুষের বিস্ময় ও আগ্রহের শেষ নেই। বিশেষত, দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব, যা বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব, সেই সময়ে প্রায় সকলের মনেই প্রশ্ন জাগে—
👉 দেবী দুর্গার দশ হাতে কোন কোন অস্ত্র থাকে?
কারণ, দুর্গা হলেন দশভুজা মহাশক্তি—তার প্রতিটি হাতে ভিন্ন ভিন্ন অস্ত্র, যা প্রতীকী অর্থে অসুরবিনাশ ও মানবকল্যাণের শক্তি প্রকাশ করে।
মহালয়া ও মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্র:
প্রতি বছর মহালয়ার দিনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্র:
“আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর;
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।
আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে আনে নব ভাবমাধুরীর সঞ্জীবন।
তাই আনন্দিতা শ্যামলীমাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন।
আজ চিৎ-শক্তিরূপিনী বিশ্বজননীর শারদ-স্মৃতিমণ্ডিতা প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা।”
এই আহ্বান দেবী দুর্গাকে চিৎ-শক্তিরূপিনী বিশ্বজননী রূপে মর্ত্যে আবাহনের প্রতীক।
Table of Contents
দেবী দুর্গার কোন হাতে কোন অস্ত্র থাকে
দেবী দুর্গার আবির্ভাব ও অস্ত্রলাভ
মহিষাসুরকে বধ করার জন্য দেবতারা আশ্রয় নেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের কাছে। তিন দেবতার মিলিত তেজ থেকে জন্ম নেন মহাশক্তি দুর্গা। দেবীর প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠিত হয় দেবশক্তির দ্বারা, এবং তার দশটি হাত সৃষ্ট হয় দশ দিকের প্রতিভূ হিসেবে।
দেবতারা তাঁকে অসুরবিনাশী রূপে সুসজ্জিত করার জন্য দেন নানা অস্ত্র ও অলঙ্কার।
মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্রে (বাণীকুমারের রচনায়) উল্লেখ আছে—
- হিমাচল দিলেন সিংহবাহন
- বিষ্ণু দিলেন চক্র
- মহাদেব শঙ্কর দিলেন ত্রিশূল
- যম দিলেন দণ্ড
- কালদেব দিলেন খড়্গ
- চন্দ্র দিলেন অষ্টচন্দ্র শোভা চর্ম
- সূর্য দিলেন ধনুক-বাণ
- বিশ্বকর্মা দিলেন অভেদ্য বর্ম
- ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলু
- কুবের দিলেন রত্নহার
এভাবেই দেবী দুর্গা হলেন দশপ্রহরণধারিণী।
দেবী দুর্গার অস্ত্রসমূহ — শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা
দেবী দুর্গাকে অস্ত্রে সুসজ্জিত করার পেছনে গভীর তাৎপর্য নিহিত। মার্কণ্ডেয় পুরাণ এবং অন্যান্য শাস্ত্রে দেবীর অস্ত্রসমূহের উৎপত্তি, প্রতীকী অর্থ এবং আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে। নিচে দেবীর দশ হাতে ধারণ করা প্রধান অস্ত্রগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া হলো—
চক্র
ভগবান বিষ্ণু দেবী দুর্গাকে সুদর্শন চক্র প্রদান করেন। দেবীর ডান হাতে থাকে এই চক্র।
অর্থ: ‘সু’ মানে সুন্দর, ‘দর্শন’ মানে দৃশ্যমান।
প্রতীক: মহাবিশ্বের চক্রাকার গতি, ন্যায় ও শৃঙ্খলা।
ব্যাখ্যা: বিশ্বকর্মা এটি শ্রীবিষ্ণুর জন্য নির্মাণ করেছিলেন। অশুভ শক্তির বিনাশ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দেবীকে এটি প্রদান করা হয়।
শঙ্খ
দেবীর বাম হাতে শঙ্খ থাকে। এটি বরুণদেবের দান।
অর্থ: জাগরণের প্রতীক।
প্রতীক: সৃষ্টির সূচনা ও জীবনীশক্তি।
ব্যাখ্যা: পুরাণ মতে, শঙ্খের ধ্বনি থেকেই প্রাণের উত্থান। যুদ্ধের সূচনা শঙ্খধ্বনিতে ঘোষিত হতো। মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও দেবী শঙ্খ বাজিয়ে অশুভ শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানান।
গদা বা কালদণ্ড
দেবী দুর্গার বাম হাতে থাকে গদা বা কালদণ্ড, যা ধর্মরাজ যমের দান।
অর্থ: কাল বা মহাকালের আনুগত্যের প্রতীক।
প্রতীক: শক্তি ও শৃঙ্খলা।
ব্যাখ্যা: এই অস্ত্রের দ্বারা দেবী শত্রুকে সম্মোহিত করেন ও অসুর নিধনে ব্যবহৃত করেন।
পদ্ম, অক্ষমালা ও কমণ্ডলু
প্রজাপতি ব্রহ্মা দেবীকে এই তিনটি প্রদান করেন।
অর্থ: পদ্ম — আলোর ও পবিত্রতার প্রতীক, অক্ষমালা — অনন্তকাল ও ধ্যান, কমণ্ডলু — পবিত্রতা।
প্রতীক: পদ্ম জন্ম নেয় আঁধার থেকে, তবুও আলোক ছড়ায়। এভাবে অশুভ বিনাশ করে শুভ শক্তি জাগ্রত হয়।
খড়গ
খড়গ দেবীর ডান হাতে থাকে। কালদেব এটি প্রদান করেছিলেন।
অর্থ: ষড়রিপু দমন (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য)।
প্রতীক: আত্মশুদ্ধি, মুক্তি ও মোক্ষ।
ব্যাখ্যা: দেবী চামুণ্ডা খড়গ হাতে অসুর নিধন করেন। এটি সর্বদা অভয় ও মুক্তির প্রতীক।
ধনুর্বাণ
পবনদেব দেবীকে ধনুক-বাণ প্রদান করেন। এটি দেবীর বাম হাতে থাকে।
অর্থ: লক্ষ্য স্থির রাখার প্রতীক।
প্রতীক: জীবনের সংগ্রামে দৃঢ়তা ও সঠিক সিদ্ধান্ত।
ব্যাখ্যা: প্রতিটি যুদ্ধে বা পরীক্ষায় সফলতার জন্য লক্ষ্যভেদের শক্তি অপরিহার্য।
ঘণ্টা
দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর বাহন ঐরাবতের ঘণ্টা দেবীকে দেন।
অর্থ: যুদ্ধ ঘোষণার প্রতীক।
প্রতীক: অশুভ শক্তি দুর্বল করা।
ব্যাখ্যা: ঘণ্টাধ্বনি অসুরদের ভীত করে, ভক্তদের পাপ নাশ করে। চণ্ডীতে উল্লেখ আছে—শাঁখ ও ঘণ্টাধ্বনির মিলনে যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল।
বজ্র
দেবরাজ ইন্দ্র দেবীকে বজ্র প্রদান করেন।
অর্থ: দৃঢ়তা ও শক্তির প্রতীক।
প্রতীক: সমাজে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা।
ব্যাখ্যা: মানবজীবনে কঠোরতা ও দৃঢ় চরিত্র বজায় রাখতে বজ্র অপরিহার্য প্রতীক।
সর্প বা নাগপাশ
নাগরাজ দেবীকে নাগপাশ প্রদান করেন।
অর্থ: বিশুদ্ধ চেতনার প্রতীক।
প্রতীক: আসুরিক প্রবৃত্তি দমন।
ব্যাখ্যা: সর্প শক্তি জাগ্রত চেতনার রূপক, যা মনকে পরিশুদ্ধ করে।
ত্রিশূল
মহাদেব শিব দেবীকে ত্রিশূল প্রদান করেন।
অর্থ: তিন গুণ — সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ।
প্রতীক: জগতের সৃষ্টিশীল, স্থিতি ও বিনাশক শক্তির একত্র রূপ।
ব্যাখ্যা: ত্রিশূল মানবজীবনের মুক্তির পথ নির্দেশ করে। এর মধ্য ফলাটি সত্ত্ব, বাকি দুটি রজঃ ও তমঃ। সত্ত্বের বিকাশই মুক্তি লাভের উপায়।
দেবী দুর্গার অলঙ্কার ও বাহন — শাস্ত্রীয় বর্ণনা
অস্ত্র প্রদান ছাড়াও দেবতারা দেবী দুর্গাকে অলঙ্কার ও সৌন্দর্যে ভূষিত করেন। এতে দেবী কেবল শক্তির প্রতীকই নন, হয়ে ওঠেন অপার রূপ ও মহিমার আধার।
কুবের — দেবীকে মূল্যবান রত্ন ও অলঙ্কারে সজ্জিত করেন।
সূর্যদেব — দেবীকে দেন কাঞ্চনবর্ণ দীপ্তি, যা তাঁর সৌন্দর্য ও দ্যুতিকে অনন্ত করে তোলে।
বিশ্বকর্মা — প্রদান করেন দুর্ভেদ্য কবচ-কুণ্ডল ও অক্ষয় বস্ত্র, যাতে দেবী অজেয় হয়ে ওঠেন।
হিমালয় — উপহার দেন সিংহ বাহন, যা শক্তি, সাহস ও বীরত্বের প্রতীক।
সব দেবতার মিলিত তেজ, শক্তি ও দানে দেবী হয়ে ওঠেন বলীয়ান মহাশক্তি। সেই রূপেই তিনি মহিষাসুরকে বধ করে লাভ করেন মহিষাসুরমর্দিনী রূপ।
আধুনিক প্রেক্ষাপটে দেবী রূপ
সময়ের পরিক্রমায় দেবী দুর্গার রূপায়ণেও এসেছে নানা পরিবর্তন। বর্তমান সময়ে কেউ কেউ নিজেদের মতো করে দেবীর সাজসজ্জায় যোগ করেছেন আধুনিক কিংবা অনাধুনিক বেশভূষা ও সরঞ্জাম। এতে ভক্তরা হয়তো দেবীকে নিজেদের মতো করে পাওয়ার বাসনা প্রকাশ করেন। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়— এভাবে সাজানো দেবী কি সত্যিই শাস্ত্রসম্মত সন্তুষ্টি লাভ করেন?
শাস্ত্রপাঠে দেখা যায়, দেবী দুর্গা অপার মহিমাময়ী ও মাতৃসুলভ গুণসম্পন্না। ভক্তদের এই আবেগমিশ্রিত ভক্তিকে তিনি সহজভাবেই গ্রহণ করেন। তাঁর মহিমা ভক্তির ঊর্ধ্বে— তাই তিনি সকল ভক্তকে মায়ের স্নেহে আলিঙ্গন করেন।
আরও পড়ুন: