মানবসভ্যতার ইতিহাসে কিছু মানুষ কেবল রাজসিংহাসনের মহিমায় নয়, বরং তাঁদের নৈতিক দৃঢ়তায় অমর হয়ে আছেন। তেমনই একজন মহামানব ছিলেন চন্দ্রবংশীয় রাজা উশীনর। তাঁর খ্যাতি ছিল অসাধারণ ধর্মবলে—যে শক্তি তাঁকে ন্যায়পথে চলতে, আর্তের রক্ষা করতে এবং সত্যের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত করেছিল।
রাজা উশীনরের জীবন ছিল ধর্মের প্রতীক। দেবলোকেও তাঁর ধর্মপালনের গুণগান হতো। দেবতারা উদাহরণ হিসেবে মানুষের মাঝে তাঁর নাম উল্লেখ করতেন। একসময় দেবতাদের মধ্যেই কৌতূহল জাগল—উশীনরের ধর্মবল সত্যিই কি এত প্রবল? নাকি মানুষের প্রশংসা কেবল অতিরঞ্জন?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই দেবরাজ ইন্দ্র ও অগ্নিদেব এক অভিনব পরিকল্পনায় নেমে এলেন মর্ত্যে। আর সেখান থেকেই শুরু হলো এক অনন্য পরীক্ষার কাহিনি—যেখানে রাজা উশীনরের ধর্মবল অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হয়।
Table of Contents
ধর্মবল
ধর্মবল ১
অনেক কাল আগের কথা। সে-কালে রাজবংশ হিসেবে চন্দ্রবংশের ছিল খুবই খ্যাতি। এই চন্দ্রবংশে উশীনর নামে এক রাজা ছিলেন। অসাধারণ ছিল তাঁর ধর্মবল। ধর্মরক্ষার জন্য তিনি নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। তিনি ধর্মপথে চলতেন। আর ধর্মরক্ষা করতেন বলে ধর্মও তাঁকে রক্ষা করত । শুধু পৃথিবীতেই নয়, স্বর্গেও প্রশংসিত হতেন রাজা উশীনর।
স্বর্গের দেবতারা মর্ত্যের কারও ধর্ম-কর্ম সম্পর্কে কথা উঠলে উশীনরের নাম দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করতেন। একদিন দেবতাদের এক সভায় ঠিক হল, উশীনরের ধর্মবলের পরীক্ষা নিতে হবে। তাহলে বোঝা যাবে উশীনবের ধর্মবল প্রকৃতপক্ষে কতটুকু। নাকি যা শোনা যাচ্ছে তা অতিরঞ্জিত! উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এলেন দেবরাজ ইন্দ্র এবং দেবতা অগ্নি। দুই দেবতা পরামর্শ করে পক্ষীরূপ ধারণ করলেন।
দেবরাজ ইন্দ্র ধরলেন শ্যেন মানে বাজপাখির রূপ। আর অগ্নি ধারণ করলেন কপোত মানে পায়রার রূপ। মহারাজ উশীনর তখন যজ্ঞে ব্যস্ত রয়েছেন। এমন সময়ে দেখেন, একটি শ্যেন পাখি একটি কপোতকে ধরার জন্য তাড়া করছে। ধরা পড়লে আর রক্ষা নেই। শ্যেন কপোতকে মেরে খেয়ে ফেলবে। কপোতটি প্রাণভয়ে কাঁপতে কাঁপতে রাজা উশীনরের কোলের ওপর এসে পড়ল।
ভয়ার্ত কণ্ঠে কপোতটি বলল,
– হে মহারাজ, আপনি ধর্মপরায়ণ, আপনি দানশীল। আপনি আর্তের সহায়, দুঃখীর ত্রাণকর্তা, শরণাগতের আশ্রয়। আমি আপনার শরণাগত। আমাকে রক্ষা করুন।
তখন শ্যেন বলল,
– আমার কথাটাও শুনুন, মহারাজ। কপোত আমার খাদ্য। আমি খুব ক্ষুধার্ত, আমার খাদ্য আমাকে গ্রহণ করতে দিন।
উশীনর ধীর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
– শরণাগতকে রক্ষা করা ধর্মের বিধান। এই কপোত আমার শরণাগত। তাকে রক্ষা না করলে আমার অধর্ম হবে। তাই আমি কপোতকে তোমার হাতে তুলে দিতে পারি নে। শ্যেন বলল,
– সে কথা ঠিক। কিন্তু আমি ক্ষুধার্ত। আমি খাদ্য না পেলে মরে যাব। আর আপনি হবেন আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী। বলতে গেলে, আপনি বিবেচিত হবেন আমার হত্যকারীরূপে। অন্যদিকে আমি মরে গেলে আমার স্ত্রী-পুত্র আমার অভাবে কষ্ট পাবে। তারাও প্রাণ হারাতে পারে। একটি প্রাণীকে বাঁচাতে গিয়ে আপনি বাধা দিয়ে রাজা উশীনর বললেন,
– শোন শ্যেন, কপোতের পরিবর্তে তুমি যা চাইবে তা-ই দেব। আমার সর্বস্ব তুমি নাও। তবু শরণাগত কপোতকে যে রক্ষা করতেই হবে, শ্যেন ।
সারাংশ
বিখ্যাত চন্দ্রবংশে উশীনর নামে এক পরম ধার্মিক রাজা ছিলেন। উশীনরের ধর্মবল পরীক্ষা করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্র শ্যেন পক্ষীর এবং অগ্নিদেব কপোতের রূপ ধরে উশীনরের কাছে এলেন। | কাপোত হল শরণাগত । শ্যেন আক্রমণকারী । রাজা উশীনর শরণাগতকে রক্ষা করার জন্য দৃঢ়তা প্রকাশ করলেন ।
ধর্মবল ২
রাজা উশীনরের কথা শুনে শ্যেন বলল,
– আমি প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। আমার প্রয়োজন খাদ্য। এখন ধন সম্পদ দিয়ে আমি কি করব? আপনি তো জানেন জীবজন্তু সবকিছু ত্যাগ করতে পারে, কিন্তু আহার ছাড়া বাঁচতে পারে না। আপনি আমার শিকার আটকে রাখবেন না। কপোতটিকে ছেড়ে দিন। আমি আহার করে আমার জীবন বাঁচাই । রাজা উশীনর বললেন,
– আমি তো বলেইছি, শরণাগতকে আমি ত্যাগ করতে পারব না। যে রাজা ভীত ও শরণাগতকে রক্ষা করেন না, তাঁর রাজ্যে অমঙ্গল দেখা দেয়। তাঁর রাজ্যে বর্ষাকালে বৃষ্টি হয় না। ঠিক সময়ে বীজ বপন করলেও, তা অঙ্কুরিত হয় না। তিনি নিজের বিপদের সময় শরণাগত হলে, কেউ তাকে রক্ষা করে না, আশ্রয় দেয় না। তোমার ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য আমি অন্য মাংস এনে দিচ্ছি। তুমি খেয়ে নিজের জীবন রক্ষা কর। বল কি খাবে?
শ্যেন তখন বলল,
– ঠিক আছে আপনি তুলাদণ্ডে ওজন করে কপোতের সমপরিমাণ মাংস আপনার নিজ শরীর থেকে কেটে দিন। আমি ভক্ষণ করে তৃপ্ত হই।
সানন্দে রাজি হলেন রাজা উশীনর। তিনি কপোতকে তুলাদণ্ডের একদিকে উঠিয়ে অন্যপাশে নিজের শরীর থেকে মাংস কেটে দিলেন। কিন্তু একি! এতটুকু কপোতের ওজন এত বেশি! রাজা উশীনর নিজের শরীর থেকে বারবার মাংস কেটে দিলেও কপোতের সমপরিমাণ মাংস হল না। কপোতের ওজন বেশিই থেকে গেল। তখন ধর্মপরায়ণ রাজা উশীনর নিজেই পাল্লায় উঠে বসলেন।
এ দৃশ্য দেখে শ্যেনরূপী ইন্দ্র উড়ে স্বর্গে চলে গেলেন। কপোতরূপী অগ্নি তখন নিজরূপ ধারণ করে বলতে লাগলেন, মহারাজ, আমি অগ্নি। আর দেবরাজ ইন্দ্র শ্যেন পক্ষীর রূপ ধরে এসেছিলেন। আপনার ধর্মবল কতটুকু তা পরীক্ষার জন্য আমরা ছদ্মবেশে এসেছি। আপনার ধর্মবল দেখে দেবগণ আনন্দিত। আমরা সন্তুষ্ট। রাজা উশীনর স্তম্ভিত হয়ে শুনছেন । অগ্নিদেব বলে চলেছেন, –
– নিজের জীবনের বিনিময়ে শরণাগতকে রক্ষা করার যে দৃষ্টান্ত আপনি স্থাপন করলেন, তা চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। অক্ষয় হয়ে থাকবে আপনার মহিমা । এ-কথা বলে অগ্নিদেব অন্তর্হিত হলেন । মহারাজ উশীনরও পরমসুন্দর মূর্তি ধারণ করলেন। তারপর দেবতাদের প্রেরিত দিব্য রথে আরোহন করে স্বর্গে গেলেন ।
মহারাজ উশীনরের ধর্মবলের কথা শুনে সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল। অর্থবল, জনবল ও ধনবলের চেয়ে ধর্মবল অনেক বড়। ধর্ম রক্ষা করা কর্তব্য। ধর্ম রক্ষিত হলে ধার্মিককে রক্ষা করে। ধর্মবলের এমনই মাহাত্ম্য !
সারাংশ
রাজা উশীনর তখন শ্যেনকে তিনি অনুরোধ করলেন অন্য মাংস নিতে। শ্যেন কপোতের সম- পরিমাণ মাংস রাজার নিজ শরীর থেকে কেটে দিতে বলল। রাজা উশীনর রাজি হলেন। কিন্তু কপোতের ওজন এত বেশি হয়ে গেল যে রাজা শরীর থেকে বারবার মাংস কেটে দিলেও কপোতের ওজনের সমান হল না। তখন রাজা নিজেই পাল্লায় উঠে বসলেন।
এ দৃশ্য দেখে শ্যেনরূপী ইন্দ্র স্বর্গে চলে গেলেন। কপোতরূপী অগ্নি নিজ মূর্তি ধারণ করে বললেন যে রাজা উশীনরের ধর্মবল দেখে দেবগণ সন্তুষ্ট। রাজা উশীনরের এই ধর্মবলের কথা অমর হয়ে রয়েছে।
আরও দেখুন :