মানবজীবনের সর্বোচ্চ মহিমা নিহিত রয়েছে আত্মত্যাগে। নিজের স্বার্থ, সুখ ও জীবন বিসর্জন দিয়ে অন্যের কল্যাণে ব্রতী হওয়াই প্রকৃত মানবধর্ম। আমাদের শাস্ত্র ও পুরাণে অসংখ্য ঋষি, মুনি ও মহাপুরুষদের জীবনীতে এই আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। তাঁদের জীবনকথা শুধু ইতিহাস নয়, আজও মানুষের জন্য প্রেরণা ও দিকনির্দেশনা।
পরহিতে আত্মত্যাগের এই মহান আদর্শের অন্যতম উদাহরণ দধীচি মুনি। তাঁর আত্মোৎসর্গের উপাখ্যান আমাদের শেখায়— নশ্বর দেহের ক্ষয় যেমন অনিবার্য, তেমনি যদি সেই দেহ অন্যের মঙ্গলের জন্য বিলীন হয়, তবে তা সর্বোচ্চ ত্যাগ ও সর্বোচ্চ সাধনা। আজকের আলোচনায় আমরা দেখব দধীচি মুনির সেই অনন্য আত্মবলিদানের কাহিনি, যা যুগে যুগে মানবতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষারূপে প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
পরহিতে আত্মত্যাগ
পুরাকালে দধীচি নামে এক মুনি ছিলেন। তিনি থাকতেন নৈমিষারণ্যে। সাধক ও সাধনার জন্য আমাদের প্রাচীনকালের ইতিহাসে নৈমিষারণ্য বিখ্যাত হয়ে রয়েছে। দধীচি ছিলেন শিবের উপাসক। তিনি ছিলেন কঠোর তপস্বী। বিভিন্ন শাস্ত্র পাঠ করে তিনি
অসাধারণ জ্ঞান লাভ করেছিলেন।
বলিষ্ঠ ও সুন্দর ছিল তাঁর চেহারা। সাধনা বা আরাধনার প্রতি তাঁর বিশেষ যত্ন ছিল। সাধনার যাতে বিঘ্ন না ঘটে, সে জন্য তিনি নির্জনতা পছন্দ করতেন। তাই তিনি নির্জন স্থানে কুটীর নির্মাণ করে বাস করতেন। হিন্দু ধর্মের মূল কথা হল জগতের কল্যাণ ও মোক্ষ বা নিজের মুক্তি । দধীচি মুনি নিজের মুক্তির জন্য নির্জনে আরাধনা করতেন। অন্য দিকে জগতের কল্যাণের প্রতি, জীবের সেবার প্রতি ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি।
পরহিতে বা অপরের মঙ্গলের জন্যে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। পরহিতে তিনি চরম আত্মত্যাগ করেছিলেন নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। পরহিতে দধীচির সেই আত্মত্যাগের উপাখ্যানটি বলছি। দধীচি যেকালে সাধক হিসেবে খ্যাতিমান, সেই সময়ে বৃত্র নামে এক অসুর খুব ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল। তপস্যায় যারা সন্তুষ্ট করতে পারে, দেবতারা তাদের বর দান করেন।
দেবতাদের শত্রু হলেও শিব এই বৃত্র নামক অসুরকে তার সাধনায় তুষ্ট হয়ে বর দান করেছিলেন। বরটি হল, দেবতা বা অসুরদের কোন অস্ত্রের আঘাতে বৃত্রাসুরের মৃত্যু হবে না। প্রায় অমর বর! শিবের কাছ থেকে এমন বর পেয়ে বৃত্রাসুর দুর্দমনীয় হয়ে উঠল। নিজ বাহুবলে স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল—এই ত্রিভুবনের প্রভু হয়ে বসল। স্বর্গরাজ্য হারিয়ে দেবগণসহ দেবরাজ ইন্দ্র মর্ত্যে এসে নানা প্রকার ছদ্মবেশ ধারণ করে বাস করতে লাগলেন ।
রাজ্যহারা বা স্বর্গহারা হয়ে দেবতারা কদিন কাটাবেন! কত দিনই বা দুঃখ ভোগ করবেন! উপায় একটা বের করতেই হয়, যাতে করে স্বর্গরাজ্য ফিরে পাওয়া যায়। তাই প্রধান দেবগণ মিলিত হয়ে নিজেদের দুরবস্থার অবসানের জন্য প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে মন্ত্রণা করতে লাগলেন। ঠিক হল, শিবের বরেই বৃত্রাসুর দুর্জয় হয়ে উঠেছে, তাই শিবের কাছেই যাওয়া হোক। দেবতাদের সঙ্গে করে দেবরাজ ইন্দ্র তখনই শিবের কাছে গেলেন ।
শিব তখন ধ্যানস্থ ছিলেন। দেবতারা সকলে মিলে শিবের স্তব করতে লাগলেন। ধ্যানভঙ্গ হলে শিব দেখলেন, দেবতারা তাঁর স্তব করছেন। তারপর দেবতাদের আগমনের কারণ শুনে শিব বললেন- ঠিক বলেছ। আমার বরেই বৃত্র শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমি তো তাকে অধর্ম করার জন্য বর দিই নি। কিন্তু আমি নিজে তাকে বর দিয়েছি, তাই তাকে বধ করা আমার পক্ষে শোভন হবে না।
তোমরা বিষ্ণুলোকে নারায়ণের কাছে যাও। তাঁর অনুগ্রহে তোমাদের ইচ্ছা পূর্ণ হবে। দেবতারা তখন বিষ্ণুলোকের দিকে যাত্রা করলেন। বিষ্ণুলোকে পৌঁছে দেবতারা কাতরভাবে নারায়ণের কাছে শ্রীবিষ্ণুর স্তব করতে লাগলেন। দেবতাদের স্তবে তুষ্ট হলেন নারায়ণ। তিনি আবির্ভূত হলেন দেবতাদের সম্মুখে। জলদগম্ভীর অথচ মধুর কণ্ঠে নারায়ণ বললেন
–তোমাদের বর্তমান অস্ত্র দিয়ে তোমরা বৃত্রাসুরকে বধ করতে পারবে না। শিবের বরে তা ব্যর্থ হবে। তাই বলে বৃত্রাসুর অবধ্য নয়। তোমরা নৈমিষারণ্যে দধীচি মুনির কাছে যাও। তিনি পরোপকারী। তাঁর সাহায্যে তোমাদের অভীষ্ট পূর্ণ হবে। দধীচি পরহিতে আত্মত্যাগ করতেও কুণ্ঠিত নন। তোমরা তাঁর কাছে বর প্রাথনা করবে।
তিনি বর দিতে উদ্যত হলে বলবে, ত্রিলোকের হিতের জন্যে আপনি আপনার পবিত্র অস্থি আমাদের দান করুন। সেই অস্থি দিয়ে সুদৃঢ় ও প্রচণ্ড শব্দকারী বজ্র নির্মাণ করবে। সেই বজ্রের আঘাতে নিহত হবে বৃত্রাসুর ।
পুরাকালে নৈমিষারণ্যে দধীচি নামে এক মুনি ছিলেন। পরোপকার ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম ব্ৰত । একবার শিবের বরে বৃত্রাসুর দুর্জয় হয়ে উঠেছিল। শিব তাকে বর দিয়েছিলেন দেবতা ও দানবদের কোন অস্ত্রের আঘাতে তার মৃত্যু হবে না। বৃত্রাসুর ত্রিভুবনের অধীশ্বর হয় এবং দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে। দেবরাজ ইন্দ্র দেবগণসহ শিবের কাছে যান।
শিব তাদের বিষ্ণুলোকে নারায়ণের কাছে যেতে বলেন। নারায়ণ দেবতাদের পরামর্শ দেন দধীচি মুনির কাছে যেতে। বর হিসেবে দধীচির মুনির কাছ থেকে তাঁর অস্থি চেয়ে নিতে বলেন। দধীচির মুনির অস্ত্র দিয়ে নির্মিত হবে বজ্র। সেই বজ্রের আঘাতে নিহত হবে বৃত্রাসুর।
শ্রীনারায়ণের পরামর্শে দেবরাজ ইন্দ্র দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে দধীচি মুনির আশ্রমে গেলেন । দেবগণসহ দেবরাজ ইন্দ্ৰকে দেখে দধীচি মুনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তিনি তাঁদের পরম আদরে অভ্যর্থনা করলেন । দেবরাজ ইন্দ্র দধীচি মুনির কাছে তাদের আগমনের কারণ জানাতে গিয়ে বললেন
–হে মুনিবর, আপনি হয়তো শুনেছেন, শিবের বরে শক্তিশালী হয়ে বৃত্র নামক এক অসুর অত্যাচারী হয়ে উঠেছে। সে স্বর্গরাজ্য অধিকার করে নিয়েছে। স্বর্গবাসী দেবতাদের সেখান থেকে সে বিতাড়িত করেছে। কিভাবে স্বর্গরাজ্য পুনরুদ্ধার করা যায়, তার পরামর্শের জন্য আমরা বিষ্ণুলোকে শ্রীনারায়ণের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাদের আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।
একমাত্র আপনি পারেন বৃত্রবধের উপায় করে দিতে একথা বলতে বলতে দেবরাজ ইন্দ্র হঠাৎ থেমে গেলেন । তিনি এমন সিদ্ধ পুরুষকে তাঁর অস্থি দান করতে কিভাবে বলবেন
– একথা ভেবে ইতস্তত করছিলেন। দধীচি মুনি তখন অত্যন্ত বিনীতভাবে দেবরাজ ইন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন,
– থামলেন কেন, দেবরাজ? বলুন, বলুন এই দীন ভক্তের প্রতি প্রভু নারায়ণের কি নির্দেশ? মাথা নত করে সসংকোচে দেবরাজ ইন্দ্র বললেন
– হে মুনিবর, শিবের বরে বৃত্র প্রচলিত কোন অস্ত্রেই বধ্য নয়। নারায়ণ বলেছেন, আপনার পবিত্র অস্থি দিয়ে যদি বজ্র নামক অস্ত্র নির্মাণ করা যায়, তবে তা দিয়ে বৃত্রাসুরকে বধ করা সম্ভব হবে। সুতরাং আমাদের পরিত্রাণের উপায় একমাত্র আপনার হাতে। পরোপকার দধীচি মুনির ব্রত। তিনি বিনা দ্বিধায় বলতে লাগলেন,
– হে দেবরাজ আমার জীবনের বিনিময়ে যদি আপনাদের কোন উপকার করতে পারি তবে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব। এই নশ্বর দেহ একদিন তো বিনষ্ট হবেই। কোন মহৎ কার্যে যদি এর বিনাশ হয় তবে তা হবে আনন্দের। আমার প্রতি প্রভু নারায়ণের অসীম অনুগ্রহ। তাই তিনি আমার কাছে আপনাদের পাঠিয়েছেন। আমি আপনাদের মঙ্গলের জন্য দেহত্যাগ করছি। আপনারা বিপদ থেকে মুক্তি লাভ করুন।
দধীচি মুনি দেবতাদের সামনে যোগবলে দেহত্যাগ করলেন, দেবগণ দধীচির আত্মত্যাগে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন । পরহিতে আত্মত্যাগ করছিলেন দধীচি মুনি। আমরাও প্রয়োজনবোধে পরহিতে আত্মত্যাগ করতে দ্বিধাবোধ করব না। দধীচি মুনির এ উপাখ্যান সে শিক্ষাই দেয়।
সারাংশ
দেবরাজ ইন্দ্র দেবগণসহ দধীচির মুনির কাছে এলেন। দেবরাজ ইন্দ্র সসংকোচে দধীচিকে নারায়ণের পরামর্শের কথা জানালেন। দধীচি সানন্দে রাজি হলেন। আত্মত্যাগ করে পরহিতে।