Site icon Sanatan Gurukul [ সনাতন গুরুকুল ] GOLN

মৈত্রেয়ীর অমরত্ব লাভ

মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন কিছু চরিত্র আছেন, যাদের নাম যুগে যুগে আলো ছড়িয়েছে। তাঁরা কেবল নির্দিষ্ট সময় বা সমাজের সীমানায় আবদ্ধ থাকেননি, বরং তাঁদের ভাবনা, বোধ ও ত্যাগ চিরকালীন সত্যে রূপ নিয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্যে এমন এক বিরল নারী মৈত্রেয়ী। যজ্ঞবল্ক্যের সহধর্মিণী মৈত্রেয়ী কেবল একজন স্ত্রী বা ঋষিপত্নী হিসেবেই নয়, বরং জ্ঞানতৃষ্ণা ও মুক্তির সাধনায় আত্মনিবেদিত এক অনন্য মানবী রূপে আবির্ভূত হয়েছেন।

“অমরত্ব লাভ” শব্দবন্ধ এখানে কেবল শারীরিক জীবনের সীমা অতিক্রম নয়; বরং জ্ঞান, সাধনা ও আত্মিক উপলব্ধির মাধ্যমে কালোত্তীর্ণ হওয়া। মৈত্রেয়ীর প্রশ্ন, তাঁর নির্ভীক অনুসন্ধিৎসা এবং আত্মজিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে যে দর্শনধারা বিকশিত হয়েছে, তা আজও মানবমনের জিজ্ঞাসু স্রোতকে আলোড়িত করে। এই প্রবন্ধে আমরা অনুসন্ধান করব—কিভাবে মৈত্রেয়ী তাঁর প্রখর বুদ্ধি ও জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষার মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে অমরত্ব লাভ করেছেন।

মৈত্রেয়ীর অমরত্ব লাভ

 

 

মৈত্রেয়ী।

প্রাচীন কালের এক মহিয়সী নারী।

যাজ্ঞবন্ধ্য নামক একজন বিখ্যাত ঋষির স্ত্রী ছিলেন তিনি।

যাজ্ঞবন্ধ্যের আর একজন স্ত্রী ছিলেন। তাঁর নাম কাত্যায়নী ।

মৈত্রেয়ী ছিলেন ধর্মচর্চা ও ধর্মানুষ্ঠানে আগ্রহী। স্বামী যাজ্ঞবন্ধ্যের মত তিনিও ধর্মচিন্তায় ও ধর্মানুষ্ঠানে অনেকটা সময় ব্যয় করতেন। স্বামীর সঙ্গে তিনি ব্রহ্মবিদ্যা আলোচনা করে খুব আনন্দ পেতেন । অন্যদিকে যাজ্ঞবন্ধ্যের অপর স্ত্রী কাত্যায়নী ছিলেন গৃহকর্মে আগ্রহী। তিনি সংসারের প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতেন। স্বামী সেবাকেই তিনি নিজের পরম কর্তব্য বলে ধর্ম বলে মনে করতেন।

এভাবে দুই স্ত্রী নিয়ে গার্হস্থ্য আশ্রমেই যাজ্ঞবন্ধ্যের দিন কেটে যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে যাজ্ঞবন্ধ্যের বাণপ্রস্থ গ্রহণ করার বয়স হল। তখন তিনি সংসারের মায়া ছিন্ন করে বাণপ্রস্থ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন ।

একদিন যাজ্ঞবল্ক্য দুই স্ত্রীকে ডেকে বললেন-

শোন তোমরা, শাস্ত্রানুসারে আমার বাণপ্রস্থ গ্রহণ করার বয়স হয়েছে। তাই তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে অনুমতি দাও। তোমরা দুজনে সহোদরার মত মিলেমিশে এই আশ্রমেই থাকবে। স্বামীর ধর্মাচরণে বাধা দেওয়া কোন স্ত্রীর পক্ষে উচিত নয়। একথা চিন্তা করে মৈত্রেয়ী ও কাত্যায়নী চুপ করে রইলেন। যাজ্ঞবন্ধ্য খুশি হয়ে বললেন,

 

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

– তোমাদের সম্মতি পেয়ে আমি আশ্বস্ত হলাম। এখন আমি আশ্রমের সমস্ত সম্পত্তি তোমাদের দুজনের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে যাব। কোন কারণে আমার অনুপস্থিতিকালে তোমাদের দুজনের মধ্যে মনের বা মতের অমিল দেখা দিতে পারে। সম্পত্তি নিয়ে তোমাদের মধ্যে বিরোধের সূত্রপাতও ঘটতে পারে। তাই আগে থেকে আমি আমার সম্পত্তি তোমাদের দুজনের মধ্যে বণ্টন করে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বাণপ্রস্থে যেতে চাই। মৈত্রেয়ী তখন শান্ত কণ্ঠে বললেন,

– আপনি যে ধনসম্পত্তির কথা বলছেন তা নিয়ে আমার একটা কথা আছে। শুধু আশ্রমের ধনসম্পত্তি নয়, সসাগরা পৃথিবী যদি ধনসম্পদে ভরে যায়, তা হলে তা দিয়ে আমি কি অমৃতত্ব লাভ করতে পারব? এই ধন-সম্পদ দিয়ে নানারকম যজ্ঞ করলেই কি মানুষ অমর হয়ে থাকতে পারবে? মৈত্রেয়ীর এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন যাজ্ঞবল্ক্য।

বললেন,তা কি কখনও হয়? ধনসম্পদের দ্বারা কখনো অমৃতত্ব লাভ করা যায় না। বরং অনেক সময় ধনসম্পদ অমৃতত্ত্ব লাভের সাধনায় বাধার সৃষ্টি করে। অনেকে আবার ধনসম্পদের দ্বারা অভাব- অনটন থেকে মুক্ত হয়ে সুখ-শান্তিতে বসবাস করতে পারে। তুমিও তা পারবে।

যাজ্ঞবল্ক্য একজন ব্রহ্মজ্ঞ ঋষি ছিলেন। তাঁর দুই স্ত্রী ছিল। একজন হলেন মৈত্রেয়ী আর দ্বিতীয়জন কাত্যায়নী। মৈত্রেয়ী ছিলেন ধর্মশীলা। কাত্যায়নী ছিলেন গৃহকর্মে আগ্রহী। যাজ্ঞবন্ধ্যের বাণপ্রস্থে গমনের বয়স হলে তিনি দুই স্ত্রীর মধ্যে আশ্রমের সকল সম্পত্তি ভাগ করে দিতে চাইলেন।

কিন্তু ধর্মশীলা মৈত্রেয়ী বললেন যে, ধনসম্পদের দ্বারা তিনি অমৃতত্ব লাভ করতে পারবেন কিনা। তখন যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, ধনসম্পদ দ্বারা অমৃতত্ব লাভ করা যায় না । বরং অনেক সময় তা ধর্মের ক্ষেত্রে বিঘ্নের সৃষ্টি করে। তবে অনেকে ধনসম্পদের দ্বারা অভাব থেকে মুক্ত হয়ে সুখ-শান্তিতে বসবাস করতে পারে। মৈত্রেয়ীও পারবে।

 

 

মৈত্রেয়ী বিমর্ষ হয়ে বললেন,

– ‘যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাম্‌’– যার দ্বারা আমি অমৃতত্ব লাভ করতে পারব না তা দিয়ে আমি কি করব? ধনসম্পদের মধ্য দিয়ে যে সুখ পাওয়া যায় তা অসার। ভোগে প্রকৃত সুখ নেই। প্রকৃত সুখ ত্যাগে। ভগবান, আপনি যে ধনলাভ করে এই বিষয় সম্পত্তি পরিত্যাগ করতে চাইছেন, আপনি যে জ্ঞানে জ্ঞানী হয়েছেন, সেই জ্ঞান আমাকে দিন।

আমাকে অমৃতত্ত্ব লাভের সন্ধান দিন । ধন-সম্পদ ও ভোগের প্রতি মৈত্রেয়ীর অনাগ্রহ এবং অমৃতত্বলাভে উৎসাহ দেখে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য খুবই আনন্দিত হলেন । তিনি প্রীতিস্মিন্ধ কণ্ঠে মৈত্রেয়ীকে বললেন,

– শোন মৈত্রেয়ী, আমি তোমাকে অমৃতের সন্ধান দিচ্ছি। ধনসম্পদ শুধু ধনসম্পদ বলেই মানুষের প্রিয় নয়। নিজের প্রয়োজন মেটায় বলেই ধনসম্পদ মানুষের প্রিয়। ছেলেমেয়ের প্রতি পিতা- মাতার স্নেহ, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালবাসা প্রভৃতি নিজেকে তৃপ্ত করে বলেই আনন্দময় হয়ে ওঠে। পতি, পুত্র, পত্নী, বিত্ত এমন কি স্বর্গ বা দেবতা যার কথাই বলি না কেন, নিজের আত্মার প্রীতির জন্যেই এসব মানুষের প্রিয় হয়।

 

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

আত্মাই মানুষের প্রধান প্রীতির বস্তু। পরমাত্মার অংশ হিসেবে এই আত্মাই সর্বত্র বিস্তৃত হয়ে আছে। সৃষ্টির মূলেই রয়েছে এই আত্মা। আত্মাই ব্ৰহ্ম । আত্মা বা ব্ৰহ্মই বিশ্বের সাথে একত্র হয়ে অবস্থান করছেন। এই আত্মা বা ব্ৰহ্ম সর্বত্র আছেন— ‘সর্বং খল্বিদং ব্ৰহ্ম’। ভোগবিমুখ হয়ে আত্মাকে প্রিয় থেকে প্রিয়তর, ধনসম্পদ থেকে প্রিয়তর, অন্য সব কিছু থেকে প্রিয়তর মনে করবে।

আত্মাকে প্রিয় বলে উপাসনা করবে। আত্মাই পরম অমৃত। ঋষি যাজ্ঞবন্ধ্যের এই ব্রহ্মজ্ঞান তৃপ্ত করল মৈত্রেয়ীকে। তিনি জানলেন, অমৃতের জন্য দূরে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই, অমৃত আছে তাঁর অন্তরে— আত্মারূপে। মৈত্রেয়ী আত্মার তত্ত্ব জানলেন। লাভ করলেন অমৃতত্ব।

যাজ্ঞবন্ধ্যের কথা শুনে বিমর্ষ হয়ে মৈত্রেয়ী জানালেন, ‘যার দ্বারা আমি অমৃতত্ব লাভ করতে পারব না, তা দিয়ে আমি কি করব?’ তিনি ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে অমৃতত্বলাভের সন্ধান দিতে বললেন। যাজ্ঞবল্ক্য বললেন যে, আত্মাই পরমাত্মার অংশ হিসেবে সর্বত্র বিস্তৃত হয়ে আছে। আত্মাই ব্ৰহ্ম। আত্মা বা ব্ৰহ্ম সর্বত্র আছেন ‘সর্বং ঋল্বিদং ব্রহ্ম’।

আত্মাকে লাভ করাই অমৃতত্ব লাভ করা। | মৈত্রেয়ী বুঝলেন, অমৃতের অবস্থান অন্তরে। আত্মরূপে। আত্মাকে জানলে অমৃতত্ব লাভ করা যায়।

Exit mobile version