অজ্ঞানতাবশতঃ শিবরাত্রি ব্রতের ফলে পাপী বেদনিধির মুক্তি – শিব মহাপুরাণ – পৃথ্বীরাজ সেন

অজ্ঞানতাবশতঃ শিবরাত্রি ব্রতের ফলে পাপী বেদনিধির মুক্তিঃ অবন্তীনগরে সদাচারী এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত, নানান শুভকর্মে রত তিনি। পতিধর্মপরায়ণা তার স্ত্রী।

তাদের ছিল দুই-পুত্র সুনিধি ও বেদনিধি, জ্যেষ্ঠ সুনিধি ছিল পিতা-মাতার মতই শাস্ত্রজ্ঞানী, সদাচারী পিতা-মাতার বশবর্তী। কিন্তু কনিষ্ঠ বেদনিধি শাস্ত্রজ্ঞ হলেও বেশ্যাসক্ত ছিল। বেশ্যাগৃহে বাস, বেশ্যার হাতে অন্ন খেত।

অজ্ঞানতাবশতঃ শিবরাত্রি ব্রতের ফলে পাপী বেদনিধির মুক্তি - শিব মহাপুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

পিতা-মাতা পুত্রের এমন ব্যবহারে খুব অসন্তুষ্ট ছিলেন। বহু বারণ সত্ত্বেও কোন লাভ হল না, বরং বাড়ির জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে সেই বেশ্যাকে দিত।

অজ্ঞানতাবশতঃ শিবরাত্রি ব্রতের ফলে পাপী বেদনিধির মুক্তি – শিব মহাপুরাণ – পৃথ্বীরাজ সেন

একবার সেই দেশের রাজা সেই ব্রাহ্মণের উপর খুশি হয়ে কিছু অলংকার দান করলেন। গরীব ব্রাহ্মণ, দামী দামী অলংকার রাখবেন কোথায়?

স্ত্রীকে দিলেন লুকিয়ে রাখার জন্য, ব্রাহ্মণ পত্নী কোথায় রাখবে ভেবে অযত্নে ফেলে রাখা ছেঁড়া কাঁথার মধ্যে সেগুলি লুকিয়ে রাখলেন।

কিন্তু বেদনিধি সব দেখে ফেলল। লুকিয়ে লুকিয়ে রাত্রিবেলা চুপিসারে সেই গয়নাগুলো নিয়ে বেশ্যাকে দিল। বেশ্যার খুব আনন্দ। সে পরে পরে দেখল।

আর বেদনিধির খুব নাম করল, সেই বেশ্যা ছিল নর্তকী, পরের দিন সে নাচ দেখাতে রাজার কাছে গেল, রাজা নর্তকীর গায়ে এই অলংকার দেখে চিনতে পারল।

তখন নর্তকীকে ডেকে রাজা জিজ্ঞেস করলেন সে এগুলো কোথায় পেয়েছে। নর্তকী মিথ্যা বললে রাজা তাকে ভর্ৎসনা করলেন। ফলে সে বলে ব্রাহ্মণপুত্র বেদনিধি তাকে সেগুলো দিয়েছে।

রাজা সব অলংকার নিয়ে নিলেন আর ব্রাহ্মণকে ডেকে পাঠালেন, জিজ্ঞাসা করলেন –গহণাগুলো কোথায়? খুব প্রয়োজন এখনই ফেরত দিতে হবে।

অজ্ঞানতাবশতঃ শিবরাত্রি ব্রতের ফলে পাপী বেদনিধির মুক্তি - শিব মহাপুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

ব্রাহ্মণ বাড়িতে গিয়ে পত্নীর কাছে গহনা চাইলেন, ব্রাহ্মণী খুঁজে পেলেন না, তারা বড়ই গরীব, ব্রাহ্মণী দুঃখিত হয়ে কাঁদতে লাগল, ব্রাহ্মণ রাজার কাছে গিয়ে সব বলে।

তারপর রাজা ব্রাহ্মণকে সকল ঘটনা বলে, তখন ঘরে ফিরে গিয়ে ব্রাহ্মণ ও তার পত্নী বেদনিধিকে ভর্ৎসনা করে বললেন–তুই আমাদের গৃহ হতে দূর হ, আমাদের কুলকে কলঙ্কিত করেছিস।

তাকে ভর্ৎসনা করে লাঠির ঘাও মারে।

অগত্যা বেদনিধি ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে বেশ্যার ঘরে গেল, কিন্তু সেখানে বেশ্যাও তাকে তিরস্কার করল। বেদনিধি রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। সেই দিনটা ছিল শিবচতুর্দশী।

এক ধনবান নানাবিধ পূজাদ্রব্য নিয়ে শিবমন্দিরে যাচ্ছিল। বেদনিধি তাকে দেখে মনে মনে ভাবল এত খাবার। যেভাবে হোক চুরি করে খাব। সে চলল তার পেছনে পেছনে।

শেষে শিবমন্দিরে এসে হাজির হল। সেখানে অনেক লোকের সাথে বেদনিধি পূজা দেখল, এদিকে ক্ষুধার জ্বালা। সুযোগ খুঁজছে কখন চুরি করে খাবে।

প্রতি প্রহরে শিবের পূজা হল। চতুর্থ প্রহরের পূজার পর সকল ব্রতীরা ক্লান্ত হয়ে মন্দিরেই ঘুমিয়ে পড়ল।

অজ্ঞানতাবশতঃ শিবরাত্রি ব্রতের ফলে পাপী বেদনিধির মুক্তি - শিব মহাপুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

এই সুযোগে বেদনিধি মন্দিরে ঢুকলো, কিন্তু প্রদীপের আলো উজ্জ্বল না থাকায় সব কিছু ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না, তখন বেদনিধি মাথার পাগড়ির কাপড় একটু ছিঁড়ে প্রদীপের মধ্যে দিয়ে উজ্জ্বল করলো।

আলোয় সব দেখা গেল। সে আনন্দে নৈবেদ্য নিয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু শুয়ে থাকা একজনের গায়ে বেদনিধির পা লাগায় সে জেগে উঠল, এবং ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার করতে শুরু করল।

তখন সবাই জেগে উঠল, সবাই চিৎকার শুরু করলে বেদনিধি ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল।

সেই সময় রাজার প্রহরীরা তার পিছু পিছু ছুটতে লাগল, তারপর তাকে লক্ষ্য করে বাণ ছুঁড়ল। তখন সেই বাণের আঘাতে বেদনিধির মৃত্যু হল।

এইভাবে শিবরাত্রি ব্রতের দিনে বেদনিধি সম্পূর্ণ উপবাসে রাত্রি জাগরণ করল, শিব পরম দয়ালু ঠাকুর। তাই ব্রাহ্মণের সমস্ত কাজই শুভপ্রদ হলো।

এরপর যমদূত আর শিবদূত এক সময়েই সেখানে উপস্থিত হলে বিবাদ শুরু হল।

শিবদূতরা যমদূতদের জিজ্ঞাসা করলেন–তোমরা কিজন্য এখানে দণ্ড হাতে এসেছে?

যমদূতেরা বলল–তোমরা ভগবান শিবের ভক্ত, তোমরাই বা এখানে কেন এসেছ? এই ব্রাহ্মণ জন্মের পর থেকে কেবলই পাপকর্ম করছে। সামান্যতম পুণ্যকর্মও নেই।

তখন শিবদূতগণ বললেন–এই ব্রাহ্মণের বহু পাপ ছিল, কিন্তু শিবের ব্রত ও শিবরাত্রি জাগরণের জন্য সব পাপ ধ্বংস হয়ে গেছে, যে শিবরাত্রি ব্রত ও রাত্রি জাগরণ করে, তার দেহে বিন্দুমাত্র পাপ থাকতে পারে না।

অজ্ঞানতাবশতঃ শিবরাত্রি ব্রতের ফলে পাপী বেদনিধির মুক্তি - শিব মহাপুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

যমদূতেরা ফিরে গিয়ে যমপুরীতে সব বলল যমের কাছে। ধর্মরাজ বললেন–শিবদূতেরা যা বলেছেন তা সত্য। ব্রাহ্মণের সমস্ত পাপ নষ্ট হয়েছে, তারপর তিনি নৈশবর্ণকে প্রণাম ও ব্রাহ্মণকে নমস্কার করে তাকে কলিঙ্গ দেশের অধিপতি করে দিলেন।

সেই বেদনিধি কলিঙ্গ দেশের অধিপতি হয়ে নিত্যই শিবপূজা করতে লাগলেন। আর যথাবিধি শিবরাত্রি ব্রত পালন করলেন, পরে তিনি তার রাজ্যের সকলকে শিবপূজা ও শিবের মন্দিরে দীপদান করে মুক্তিলাভ করলেন।

দুরাত্মা ব্রাহ্মণের অজ্ঞাতসারেই শিবরাত্রি ব্রত উৎ্যাপন হল এবং তাতে যদি এমন ফল হয়, তাহলে ভক্তিসহকারে কোনো ব্যক্তি এই ব্রত পালন করলে তার যে মুক্তি হবে, তাতে আশ্চর্য কী?

আরও পড়ুনঃ

জগতের অসারত্ব-কীর্তন – কালিকা পুরাণ

আর্যদের ভারত জয়ের কাহিনী : রামায়ণ – ড: এম আর দেবনাথ

Leave a Comment