শ্রীরামচন্দ্র হিন্দুধর্মের আধ্যাত্মিক ইতিহাস ও ভারতীয় মহাকাব্যিক সাহিত্যের এক অনন্য নায়ক। তিনি শুধু অযোধ্যার রাজপুত্রই নন, মানবধর্ম, ন্যায়নীতি ও আদর্শ জীবনের এক চিরন্তন প্রতীক। তাঁর জীবনচরিত মহাকাব্য ‘রামায়ণ’-এর মাধ্যমে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় উপমহাদেশ ও বিশ্বের নানা প্রান্তে মানুষকে ন্যায়, সত্য, সাহস ও ভক্তির শিক্ষা দিয়ে আসছে।
এই নিবন্ধে আমরা শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম, শৈশব, বনবাস, রাক্ষসরাজ রাবণের সঙ্গে সংঘর্ষ, অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন এবং পরবর্তী জীবনের ঘটনাবলী বিস্তারিতভাবে আলোচনার পাশাপাশি তাঁর চরিত্রগুণ, নীতিবোধ ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব নিয়েও আলোকপাত করব। শ্রীরামের জীবন কেবল ধর্মীয় আখ্যান নয়, বরং মানব সমাজে আদর্শ পুরুষ ও ন্যায়ের শাশ্বত প্রতীক হিসেবে স্থায়ী হয়ে আছে।
Table of Contents
শ্রীরামচন্দ্র জীবনচরিত
শ্রীরামচন্দ্র জীবনচরিত
ত্রেতাযুগের কথা। বিষ্ণুর অবতাররূপে শ্রীরামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর চরিত্র যেমন বিশাল তেমনি বিস্ময়কর। রামচন্দ্র দশ-অবতারের অন্যতমরূপে পূজিত হয়ে থাকেন। রাম-নাম জপ করলে পাপ নষ্ট হয় । অযোধ্যার রাজা দশরথ। বিশাল সাম্রাজ্য আর অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী তিনি। কিন্তু সন্তানহীন অবস্থায় তাঁর মনে শান্তি ছিল না। মন্ত্রীদের পরামর্শে অশ্বমেধ যজ্ঞ শেষে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করতে মনস্থ করলেন তিনি।
স্থির হল যজ্ঞ করবেন মুনি ঋষ্যশৃঙ্গ। যজ্ঞে আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত হয়েছেন দেবতাগণ। ব্রহ্মার বরে লঙ্কাধিপতি রাবণ অত্যাচারী হয়ে উঠায় দেবতারাও ভীত। সেই যজ্ঞস্থলে উপস্থিত ব্রহ্মার নিকট দেবগণ রাবণের অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করেন এবং তার বিনাশ যাতে হয় তাঁর উপায় জানতে চান। উত্তরে ব্রহ্মা বলেন ‘আমার বরে গন্ধর্ব, যক্ষ, দেবতা ও রাক্ষসগণ রাবণকে বধ করতে পারবে না।
তবে মানুষের হাতেই তাকে মরতে হবে। এ ব্যাপারে তোমরা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হও।’ এই সময় শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী জগদীশ্বর বিষ্ণু সভায় উপস্থিত হলেন। দেবতারা তাঁর স্তব করে অত্যাচারী রাবণের বিনাশের আশু ব্যবস্থা করতে প্রার্থনা জানালেন। বিষ্ণু দেবতাদেরকে অভয় দিয়ে বললেন, তিনি শীঘ্রই রাজা দশরথের ঘরে জন্মগ্রহণ করে রাবণকে বধ করবেন।
যথাসময়ে মুনি ঋষশৃঙ্গ পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করলেন। যজ্ঞের ফলস্বরূপ- যথাসময়ে বড় রানী কৌশল্যার গর্ভে শ্রীরামচন্দ্র, মেঝরানী কৈকেয়ীর গর্ভে ভরত এবং ছোটরানী সুমিত্রার গর্ভে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নের জন্ম হয়। রাজা দশরথসহ রাজ- পরিবারের সকলেই আনন্দিত হলেন এবং এ উপলক্ষে প্রচুর ধনরত্ন দান করা হল। রাজা দশরথের ছেলে চারজনই যেমনি সুশ্রী ও বুদ্ধিমান তেমনি তাঁদের মিষ্ট স্বভাব।
অল্পদিনের ভেতরেই তাঁরা শাস্ত্র ও অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন। ছেলেদের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে দশরথ খুবই খুশি। একদিন তিনি পুরোহিত ও মন্ত্রীদের নিয়ে ছেলেদের বিয়ে দেয়ার পরামর্শ করছেন। এমন সময় বিশ্বামিত্র মুনি এসে উপস্থিত হলেন। রাজা দশরথ মুনিকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, “আপনার সদয় আগমনে আমরা ধন্য। এবার যদি অনুগ্রহ করে আপনার আগমনের কারণ জানান, তবে ভাল হয়।”
উত্তরে বিশ্বামিত্র বললেন, মারীচ ও সুবাহু নামে দুই রাক্ষস তাঁর যজ্ঞক্রিয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। এদের বিনাশ করার জন্য রামচন্দ্রকে তিনি নিতে এসেছেন। রাজা দশরথের সম্মতি পেয়ে রাম-লক্ষ্মণকে নিয়ে বিশ্বামিত্র তাঁর আশ্রমের দিকে রওনা হলেন।
পথ চলতে চলতে রাম-লক্ষ্মণ রাক্ষসদের অত্যাচারের কাহিনী শুনলেন। বিশ্বামিত্রের নির্দেশে রামচন্দ্র তারকা রাক্ষুসী, সুবাহু প্রভৃতি রাক্ষসদের বধ করেন।
মারীচ নামক রাক্ষসটিকে রামচন্দ্র বর্ণাঘাতে সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন। মুনিদের যজ্ঞক্রিয়ার বিঘ্ন দূর হল। বিশ্বামিত্র তুষ্ট হয়ে রামচন্দ্রকে নানারূপ ভয়ঙ্কর ও আশ্চর্য অস্ত্রবিদ্যা দান করলেন। বিশ্বামিত্রের যজ্ঞ সম্পন্ন হওয়ার কয়েকদিন পর রাম ও লক্ষ্মণকে নিয়ে তিনি মিথিলায় গমন করেন। মিথিলার রাজা জনক রাম ও লক্ষ্মণকে দেখেন এবং তাঁদের পরিচয় জেনে অত্যন্ত খুশি হলেন।
বিশ্বামিত্র রাজা জনককে বললেন, “আপনার নিকট যে হরধনুটি রয়েছে সেটি রাম-লক্ষ্মণ একবার দেখতে চান।” ধনুকের কথা উঠাতেই রাজর্ষি জনক বললেন, “শিবের এই ধনুকে যিনি গুণ দিতে পারবেন তাঁর সঙ্গেই আমার মেয়ে সীতার বিয়ে দেওয়া হবে।” রামচন্দ্র ধনুকটিতে গুণ পরালেন। তারপর গুণ ধরে টান দিতেই ধনুকটি ভেঙ্গে দুখণ্ড হয়ে গেল । হরধনু ভঙ্গকারী শ্রীরামচন্দ্রের বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব পাঠান হল রাজা দশরথের নিকট।
দশরথ তুষ্ট হয়ে সকলকে নিয়ে মিথিলায় চলে এলেন। আলাপ-আলোচনায় স্থির হল, রাজা জনকের দুই মেয়ে এবং তাঁর ভাই কুশধ্বজের মেয়ে দু’টিকে রাজা দশরথের চার পুত্রের সঙ্গে একত্রে বিয়ে দেওয়া হবে। মহা ধুমধামের মধ্যদিয়ে শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে সীতার, লক্ষ্মণের সাথে ঊর্মিলার, ভরতের সাথে মাণ্ডবীর এবং শত্রুঘ্নের সাথে শ্রুতকীর্তির বিয়ে হয়ে গেল ।
বিয়ের পর রাজা দশরথ সকলকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরলেন। রাজ-পরিবার আনন্দে মুখরিত হয়ে উঠল। রাম-সীতার বিয়ের পর বার বছর চলে গেল। রাম এখন পঁচিশ বছরের যুবক। মহারাজ দশরথ রামচন্দ্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে চাচ্ছেন। অভিষেকের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। পরের দিন ভোরেই অভিষেক। দাসী মন্থরার কু-পরামর্শে রানী কৈকেয়ী রাজার প্রতিশ্রুত দু’টি বর চেয়ে বসলেন।
“এক বরে ভরতেরে দেহ সিংহাসন।
আর বরে রামেরে পাঠাও কানন।।”
কৈকেয়ীর প্রার্থনায় দশরথের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল। অনেক চেষ্টা করেও কৈকেয়ীর মত পরিবর্তন করা গেল না। ভোর বেলায় অভিষেকের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন রামচন্দ্র। রাজা দশরথ রামচন্দ্রকে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু তিনি কিছুই বলতে পারছেন না; মুহুর্মুহু মূর্ছা যাচ্ছেন। তখন রানী কৈকেয়ী রামচন্দ্রকে সব খুলে বললেন। রামচন্দ্র ধীর-স্থিরভাবে পিতাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “পিতা, আপনি দুঃখ করবেন না।
আপনি সত্য রক্ষা করুন। আমি ভরতকে আশীর্বাদ করছি। সে অযোধ্যার সিংহাসনে বসুক, আমি বনে যাচ্ছি।” দেখতে দেখতে রামচন্দ্রের বনগমনের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। রাজ-পরিবারসহ সমস্ত অযোধ্যায় দুঃখের ছায়া নেমে এল। পিতৃসত্য পালনের নিমিত্ত রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষ্মণসহ চৌদ্দ বছরের জন্য বনে গমন করছেন। এদিকে রাম বনগমনের পর পুত্রশোকে দশরথ প্রাণ ত্যাগ করেন।
ভরত মাতুলালয় থেকে ফিরে এসে সমস্ত ঘটনা জেনে দুঃখিত হন। তিনি রামচন্দ্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য কুলগুরু বশিষ্ট ও মায়েদের নিয়ে চিত্রকূট পর্বতে এসে উপস্থিত হন। সকলেই রামচন্দ্রকে বনবাস থেকে ফিরে আসার অনুরোধ করেন। কিন্তু রামচন্দ্র কিছুতেই রাজি হলেন না। তখন ভরত শ্রীরামচন্দ্রের পাদুকা নিয়ে এসে সিংহাসনে স্থাপন করেন এবং নিজে রামের প্রতিনিধি হয়ে নন্দী গ্রামে বাস করে রাজ্য-শাসন করতে থাকেন।
সারাংশ
বিষ্ণুর অবতাররূপে শ্রীরামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দশরথ, মাতা কৌশল্যা। রাজা দশরথের দ্বিতীয় পত্নী কৈকেয়ীর গর্ভে ভরত এবং তৃতীয় পত্নী সুমিত্রার গর্ভে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন জন্মগ্রহণ করেন। রামচন্দ্র জনক রাজার হরধনু ভঙ্গ করেন এবং সীতাকে বিয়ে করেন। একই সঙ্গে লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্নেরও বিয়ে হয়। শ্রীরামচন্দ্রের অভিষেক হবে।
কৈকেয়ী রাজা দশরথের প্রতিশ্রুত দুটি বর চাইলেন। এক বরে রামচন্দ্রকে চৌদ্দ বছরের জন্য বনে যেতে হবে, দ্বিতীয় বরে ভরতকে সিংহাসনে বসাতে হবে। পিতৃসত্য পালনের জন্য শ্রীরামচন্দ্র, লক্ষ্মণ ও সীতাসহ বনে গেলেন। রামচন্দ্রের পাদুকা সিংহাসনে স্থাপন করে ভরত রামচন্দ্রের প্রতিনিধিরূপে রাজ্য শাসন করতে লাগলেন।
শ্রীরামচন্দ্র আদর্শ জীবনচরিত
শ্রীরামচন্দ্রের পাদুকা নিয়ে ভরত অযোধ্যায় ফিরে গেছেন। এদিকে রামচন্দ্র চিত্রকূট ছেড়ে অগস্ত্য মুনির আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন। এরপর মহর্ষি অগস্ত্যের অনুমতিক্রমে রাম গোদাবরী তীরে পঞ্চবটী বনে যান। সেখানে কুটির নির্মাণ করে বাস করতে থাকেন। তখন ওই বনটি ছিল রাক্ষসে পরিপূর্ণ। রাবনের বিধবা বোন শূর্পণখাও ওই বনে বাস করতেন। প্রথমে শূর্পণখা রামচন্দ্র ও লক্ষ্মণের কাছে প্রণয়ন নিবেদন করে অপমানিতা হয়।
লক্ষ্মণ শূর্পণখার নাক ও কান কেটে দেন। অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য শূর্পণখা তার ভাই রাবণকে উত্তেজিত করে তোলে। এছাড়া রামের স্ত্রী সীতার রূপ-লাবণ্যের কথাও রাবণকে বলে। রাবণ একদিকে ভগ্নীর অপমানের প্রতিশোধে এবং অপরদিকে সীতার রূপ-লাবণ্যের বর্ণনায় মুগ্ধ হয়ে তারকা রাক্ষসীর পুত্র মারীচের সাথে পঞ্চবটী বনে উপস্থিত হলেন।
মারীচ ইচ্ছানুসারে রূপ ধারণ করতে পারত। সে স্বর্ণ-মৃগের রূপ ধরে সীতার সামনে ঘোরাফেরা করতে লাগল। সীতা স্বর্ণ-মৃগের জন্য বায়না ধরল। সীতার পাহারায় লক্ষ্মণকে রেখে রাম স্বর্ণ-মৃগের পিছনে ছুটলেন। শর বিদ্ধ স্বর্ণ-মৃগটি রামের কণ্ঠস্বরে “হা লক্ষ্মণ”, “হা সীতা” বলে প্রাণ ত্যাগ করল। এটি রাক্ষস মারীচের মায়াবী খেলা। রামের কণ্ঠে কাতর উক্তি শুনে সীতা মনে করলেন রাম বিপদগ্রস্ত।
তিনি লক্ষ্মণকে পাঠালেন রামকে সাহায্য করতে। এই সুযোগে রাবণ ছদ্মবেশে সেখানে উপস্থিত হয়ে সীতাকে নিজের রথে করে লঙ্কার দিকে প্রস্থান করলেন। রাম-লক্ষ্মণ কুটিরে ফিরে এসে সীতাকে দেখতে পেলেন না। সীতাকে হারিয়ে তাঁরা পাগলের মত হয়ে গেলেন। খোঁজবার পথে জটায়ুর সঙ্গে দেখা। জটায়ু বলল, “রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে গেছে।”
ঋষ্যমূক পর্বতে সুগ্রীবের সঙ্গে রাম-লক্ষ্মণের সাক্ষাৎ হয়। সুগ্রীব তাঁদেরকে সীতার সন্ধান জানালেন। রাবণের রথ থেকে ফেলে দেয়া সীতার অলঙ্কার সুগ্রীব তাঁদের দেখালেন। সুগ্রীবের সঙ্গে রামের বন্ধুত্ব হল । রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধারের জন্য সুগ্রীব তাঁর বানর সৈন্য নিয়ে এগিয়ে এলেন। বানর দলের প্রধান হনুমান রামচন্দ্রের পরম ভক্ত হয়ে পড়ে।
এই হনুমানই প্রথম লঙ্কায় উপস্থিত হয়ে অশোক বনে সীতার সন্ধান পায় । রাম-লক্ষ্মণ হনুমানের মুখে সীতার সন্ধান জানলেন। সুগ্রীবের সহায়তায় সীতা উদ্ধারের প্রস্তুতি চলল। এদিকে রাবণের ছোট ভাই বিভীষণ সীতাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এতে রাবণ ক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং বিভীষণকে অপমান করেন। ক্ষুব্ধ বিভীষণ রামচন্দ্রের পক্ষে যোগদান করেন।
বিভীষণের পরামর্শে বন্ধু সুগ্রীবের বানর সেনার সহযোগে রামচন্দ্র রাবণকে স্ববংশে সংহার করে সীতাকে উদ্ধার করলেন। তখন লঙ্কার রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করলেন বিভীষণকে। এরূপে চৌদ্দ বছর বনবাস জীবন কাটিয়ে রাম-লক্ষ্মণ ও সীতা অযোধ্যায় ফিরে আসেন। ভরত রামের হাতে রাজ্যভার তুলে দেন। রামচন্দ্রের শাসনে প্রজারা খুবই তুষ্ট।
একদিন রাম গুপ্তচরের মুখে জানতে পারলেন রাবণের ঘরে সীতার অবস্থান নিয়ে প্রজাদের মধ্যে কুৎসা রটনা হচ্ছে। সীতাকে তিনি সতীসাধ্বী বলে জানেন। কিন্তু রাজা হয়ে প্রজাদের মনস্তুষ্টি তাঁর প্রথম কাম্য। তিনি সীতাকে পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। লক্ষ্মণের মাধ্যমে সীতাকে বাল্মীকির তপোবনে নির্বাসন দিলেন। সীতা তখন গর্ভবতী। বাল্মীকির আশ্রমে পরিত্যক্তা সীতা যমজ পুত্র প্রসব করেন।
বাল্মীকি তাঁদের নাম রাখেন লব ও কুশ। মহর্ষি লব ও কুশকে যত্ন সহকারে শিক্ষা দেন ও তাদেরকে রামায়ণ গান শেখান । এদিকে রামচন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন। নিমন্ত্রিত হয়ে বাল্মীকি লব ও কুশকে নিয়ে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলেন। লব-কুশের কণ্ঠে রামায়ণ গান শুনে রামচন্দ্র মুগ্ধ। লব-কুশের চেহারা দেখে রামচন্দ্র বুঝলেন এরা তাঁরই পুত্র। বাল্মীকি এদের পরিচয় দিলেন।
তিনি সীতার নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের কথাও বললেন। সীতাকে রাজসভায় আনা হল । রাম সীতাকে সতীত্বের পরীক্ষা দেয়ার কথা পুনরায় তুললেন। এতে সীতা অত্যন্ত ব্যথিতা হলেন। সীতা মাতা বসুধার কোলে স্থান পাবার প্রার্থনা করলেন । তৎক্ষণাৎ সীতার পায়ের তলা থেকে মাটি ভেদ করে ধরিত্রী দেবীর আবির্ভাব হল । তিনি সীতাকে কোলে নিয়ে পাতালে প্রবেশ করলেন। এ ঘটনায় সভায় বিষণ্নভাব নেমে এল ।
কিছুদিন পরের ঘটনা, কালপুরুষ একদিন রামের কাছে এসে উপস্থিত। তিনি গোপনে রামের সঙ্গে কথা বলবেন। স্থির হল তাঁদের গোপন কথাবার্তার সময় কেউ সেখানে উপস্থিত হলে রাম তাঁকে বর্জন করবেন। দ্বারে প্রহরী লক্ষ্মণ। এমন সময় দুর্বাসা মুনি এসে উপস্থিত হলেন। তিনি জরুরিভাবে রামের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইলেন। লক্ষ্মণ রামের ব্যস্ততার কথা উল্লেখ করে তাঁকে অপেক্ষা করার অনুরোধ করলেন।
দুর্বাসা ক্ষিপ্ত হয়ে রামের বংশ বিনাশ করার হুমকি দিলেন। তখন লক্ষ্মণ বাধ্য হয়ে রামের নিকট উপস্থিত হলেন। পূর্বশর্ত লঙ্ঘিত হল; রামচন্দ্র লক্ষ্মণকে বর্জন করলেন। লক্ষ্মণ মনের দুঃখে সরযু নদীতে আত্মবিসর্জন করলেন। লক্ষ্মণের মৃত্যুতে রামচন্দ্র শোকে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়লেন। লব-কুশকে রাজ্যভার দিয়ে শ্রীরামচন্দ্র সরযু নদীতে প্রবেশ করে যোগবলে প্রাণত্যাগ করেন।
শ্রীরামচন্দ্রের ঘটনাবহুল জীবনে তাঁর চরিত্রের নীতিজ্ঞান, কর্তব্যবুদ্ধি, আদর্শস্থাপন ও সতেজ পৌরুষের দিকগুলো সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাঁর চরিত্রের আদর্শ কেবল মহাবিস্ময়ের বস্তুই নয়, অন্তরের পরম পূজনীয় সামগ্রী হয়ে রয়েছে।
শ্রীরামচন্দ্রের উপদেশ
১। আত্মা সদা একরূপ; আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, বৃদ্ধি নেই, ক্ষয় নেই, এই আত্মা স্ব-প্রকাশ, সর্ব ব্যাপক ও অদ্বিতীয়।
২। এই বিশ্বকে পরমাত্মস্বরূপ জ্ঞান হলেই বাহ্য ও আত্মার দৃষ্টি নষ্ট হয়ে য়ায় অর্থাৎ হৃদয়ে নিরন্তর ব্রহ্ম দর্শন হয়ে থাকে ।
৩। জ্ঞানের উদয়ে অবিদ্যা বিনষ্ট হয়। জ্ঞান ব্যতীত মুক্তিলাভ হয় না।
৪। যে ব্যক্তি মায়াময় জগৎকে পরিত্যাগ করে নির্মলচিত্তে আমাকে অর্থাৎ বিষ্ণুকে চিন্তা করেন তিনি পরম সুখ ও নিত্যানন্দ লাভ করতে পারেন।
সারাংশ
বনবাসী শ্রীরামচন্দ্র পাঞ্চবটী বনে বসবাস করতে থাকেন। সেখান থেকে রাবণ ছদ্মবেশে সীতাকে হরণ করে লঙ্কায় নিয়ে যায়। রাবণকে হত্যা করে শ্রীরামচন্দ্র সীতাকে উদ্ধার করেন। অযোধ্যায় ফিরে শ্রীরামচন্দ্র রাজা হন। প্রজাদের মধ্যে সীতার চরিত্র সম্পর্কে গুঞ্জন উঠলে শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে নির্বাসন দেন। মহর্ষি বাল্মীকি সীতা ও তার দুই যমজ পুত্র লব-কুশকে প্রতিপালন করেন।
শ্রীরামচন্দ্রের অশ্বমেধ যজ্ঞে বাল্মীকি সীতার পবিত্রতা তুলে ধরলে শ্রীরামচন্দ্র সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বলেন। সীতা মনের দুঃখে পাতালে প্রবেশ করেন। কাল-পুরুষের ষড়যন্ত্রে শ্রীরামচন্দ্র লক্ষ্মণকে বর্জন করেন। লক্ষ্মণ দেহত্যাগ করলে শ্রীরামচন্দ্রও সরযু নদীতে যোগবলে পরলোকগমন করেন। শ্রীরামচন্দ্রের আদর্শ চরিত্র যুগ যুগ ধরে প্রশংসিত হয়ে চলছে।