Site icon Sanatan Gurukul [ সনাতন গুরুকুল ] GOLN

ষোড়শ সংস্কার

ষোড়শ সংস্কার

ষোড়শ সংস্কার নিয়ে আজকের আলোচনা। সংস্কার এমন কিছু কাজ যা ভবিষ্যৎ জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলে এবং একজন ব্যক্তির উপর প্রভাব বিস্তার করে। সংস্কার মানুষকে পবিত্র, দোষত্রুটি মুক্ত এবং নির্মল করে। যে আচার- অনুষ্ঠান জীবনকে ধর্মীয় পরিবেশে সুন্দরভাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে তাই সংস্কার। ষোলটি সংস্কার জীবনকে উন্নত করে, খারাপ সঙ্গ থেকে রক্ষা করে এবং তাকে একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে।

ষোড়শ সংস্কার

১. গর্ভদান :

বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রী সন্তান জন্মদানের জন্য সকলের আশীর্বাদ পান। এই সংস্কার দ্বারা তারা স্বাস্থ্যবান, মহৎ এবং উদার হৃদয়ের সন্তান প্রার্থনা করেন।টি স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহরূপ সংস্কার। গর্ভাধান সংস্কারে স্ত্রীর প্রথম রজোদর্শনের ষোলো দিনের মধ্যে স্বামী পবিত্র হয়ে সন্ধ্যায় সূর্যার্ঘ্য প্রদান করে যথাবিধি বহ্নিস্থাপনের পর পঞ্চগব্য দ্বারা স্ত্রীকে শোধন করে সন্তান উৎপাদনার্থ গ্রহণ করেন।

গার্হ্যসূত্র মতে, এই সংস্কারের সূচনায় স্ত্রী যথাবিধি সুসজ্জিত হন এবং স্বামী সৃষ্টি সংক্রান্ত বৈদিক স্তোত্র উচ্চারণ করতে করতে দেবগণকে আহ্বান জানান, যাতে তারা তার স্ত্রীকে গর্ভধারণে সহায়তা করেন। অতঃপর নারীপুরুষের যৌনক্রিয়া সংক্রান্ত স্তোত্রগুলি উচ্চারণ করতে করতে তারা আলিঙ্গন করেন। স্বামী পুরুষের উৎপাদন ক্ষমতা সংক্রান্ত স্তোত্র উচ্চারণ করতে করতে স্ত্রীর দেহে নিজ শরীর ঘর্ষণ করেন। আলিঙ্গনের পর পূষণের নিকট প্রার্থনার মাধ্যমে গর্ভস্থাপনের কাজ শুরু হয়। স্বামী স্ত্রীর দক্ষিণ স্কন্ধের উপর থেকে ঝুঁকে তার স্ত্রীর বক্ষ স্পর্শ করেন “হে সুবিন্যস্ত কেশধারী, তোমার হৃদয় বাস করে স্বর্গে, বাস করে চন্দ্রে, আমি তাহাকে জানি, তাহা আমাকে জানুক। আমি যেন শত শরৎ বাঁচিয়া থাকি।

 

২. পুংসবন :

গর্ভদানের ৩ মাস পর এই সংস্কার পালন করতে হয়। গর্ভাবস্থায় সন্তানের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয়।গর্ভিণীর ২য় বা ৩য় মাসে কর্তব্য সংস্কার বিশেষ। গর্ভের ৩য় মাসে রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবারে নন্দা ও ভদ্রা তিথিতে পূর্ব ভাদ্রপদ, উত্তর ভাদ্রপদ, পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, হস্তা, মূলা, শ্রবণা, পুনর্বসু, মৃগশিরা, পুষ্যা ও ‍আর্দ্রা নক্ষত্রে পূর্ণচন্দ্র থাকলে এবং যুতযামিত্রবেধ ও দশযোগভঙ্গ না হলে লগ্নের নবমে ও পঞ্চমে এবং লগ্ন ৪র্থ, ৭ম ও দশমে শুভগ্রহ ও ৩য়, ৬ষ্ঠ, ১০ম, একাদশে পাপগ্রহ অবস্থান করলে গর্ভিণীর চন্দ্র ও তারাশুদ্ধি হলে কুম্ভ, মিথুন, সিংহ, ধনুঃ ও মীনলগ্নে পুংসবন কর্তব্য।

 

৩. সীমন্তোন্নয়ন :

এটা গর্ভধারণের ষষ্ঠ বা অষ্টম মাসের শেষে করা হয় সন্তানের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য।

সীমন্তোন্নয়ন (সংস্কৃত: सीमन्तोन्नयन, আক্ষরিক অর্থে: চুল বিভক্ত করা) হল হিন্দুধর্মের প্রাচীন গ্রন্থে ষোড়শ সংস্কারের (আচার) তৃতীয়। এটি গর্ভাবস্থার শেষ ত্রৈমাসিকে নিরাপদ প্রসবের আকাঙ্ক্ষা পালন করা হয়।

কর্তৃপক্ষ একমত নয় যে এই সংস্কার প্রথম সন্তানের জন্য করা উচিত নাকি প্রতিটি সন্তানের জন্য করা উচিত।

 

৪. জাতকর্ম :

জন্মগ্রহণের দিন সন্তানকে জাতকর্মের মাধ্যমে পৃথিবীতে স্বাগতম জানান হয়।

জাতকর্ম (IAST: Jātakarman, সংস্কৃত: जातकर्मन्) (আক্ষরিক অর্থে, জন্মগত আচার) হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান সংস্কর, যা একটি শিশুর জন্ম গ্রহণে করা হয়।

নাভিচ্ছেদন ও শিশুস্নান, যখন সন্তানের জন্ম হয় তখন প্রথমে ধাত্রী আদি স্ত্রীলোক সন্তানের শরীরকে জরায়ু হইতে পৃথক করে মুখ, নাসিকা, কর্ণ ও চক্ষুরাদি হইতে শীঘ্র মালিন্য দূর করিবে এবং কোমল বস্ত্রে মুছিয়া শুদ্ধ করিয়া তাহাকে পিতার ক্রোড়ে (কোলে) দেয়। যেখানে বায়ু ও শৈত্য প্রবেশ না করে, এরূপ স্থানে বসে পিতা (সন্তানের নাভিদেশ হইতে) নাড়ীর এক বিঘৎ পরিমাণ বাদ দিয়া উর্দ্ধ দিকে সূত্রদ্বারা বন্ধন করে।

বন্ধনের উপর হইতে নাড়ী ছেদন করে ঈষদুষ্ণ জলে শিশুকে স্নান করাইয়া শুদ্ধ বস্ত্রে মুছিয়া নতুন শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করে। এরপর পিতা যব, যষ্ঠিমধু ও ঘৃত দ্বারা সন্তানের জিহ্বা স্পর্শ করে মন্ত্রোচ্চারণ করেন এ কর্ম গুলোকে জাতকর্ম বলে। এটি সাধারণত উত্তরণের একটি ব্যক্তিগত আচার যা নতুন বাবা-মা, শিশুর আত্মীয়স্বজন এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও পালন করেন।

 

৫. নামকরণ :

জন্মের এগার মাসে এই সংস্কার পালন করা হয় এবং সন্তানকে একটি নাম দেওয়া হয়।

 

৬. নিষ্ক্রমণ :

জন্মের চতুর্থ মাসে এই সংস্কার পালন করা হয়। শিশু সন্তানকে বাইরের পরিবেশে উন্মুক্ত করা হয়। যাতে সূর্যের আলো তাকে স্বাস্থ্যবান করে তোলে। দীর্ঘায়ুর জন্য প্রার্থনা করা হয়। এই সময় থেকে সন্তান প্রকৃতির কোলে প্রাকৃতিকভাবে বড় হতে থাকে।

 

৭. অন্নপ্রাসন :

সন্তানের যখন দাঁত উঠতে থাকে সাধারণত ছয় থেকে আট মাস বয়সে এই সংস্কার পালন করা হয়। তখন থেকেই তাকে শক্ত খাবার দেওয়া হয়।

 

৮. চূড়াকরণ :

প্রথম থেকে তৃতীয় বছর বয়সের মধ্যে এই সংস্কার পালন করা হয়। প্রথম বারের মতো মাথার সব চুল ফেলে দেওয়া হয়। সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য প্রার্থনা করা হয়।

 

৯. কর্ণভেদ :

তিন বছর বয়সে কান ফোরানো হয় এবং শারীরিক সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করা হয়।

 

১০. উপনয়ন :

বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী, প্রথমবার ব্যক্তির জন্ম হয় মাতৃগর্ভ থেকে; এবং দ্বিতীয়বার জন্ম হয় ব্যক্তির সৎসংস্কার ধারণ করে। প্রাচীনকালে উপনয়ন সংস্কার পশ্চাৎ কুলগুরু ও আচার্য ব্রহ্মচারী বালকদের গুরুকুলে নিয়ে যেতেন এবং পরিবারের পরম্পরা অনুযায়ী বালকদের কে কোন এক বেদের কোন এক নির্দিষ্ট শাখার সহস্বর শিক্ষা দেওয়া হত । তাহার সাথে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় শিক্ষা দেওয়া হত।

ভারতের বিভিন্ন বহির্গত আক্রান্ত দের শাসন কালে গুরুকুল ও গুরুশিষ্য পরম্পরা বিনষ্ট হয়ে যায়। ফলস্বরূপ বহু জ্ঞান লুপ্তপ্রায় হয়ে যায় যার কারণে সমাজে বহু ভুল ধারণাদি ঘর করে। ৫ থেকে ৮ বছর বয়সে উপনয়নের মাধ্যমে একটি শিশু গুরু/শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসে। গুরুর নিকট জ্ঞান, কর্ম, ভক্তিসহ বিভিন্ন নিয়মানুবর্তিতা অর্থাৎ শাস্ত্রে জীবন যাপনের যে পদ্ধতি উল্লেখ আছে তার অনুশীলন করে। ব্রহ্মচর্য জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সব রকম খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার অভ্যাস ছাত্র জীবনেই করতে হয়।

নিয়মিত পড়ালেখা এই সংস্কারের পরেই শুরু হয়।উপনয়নকালে বালকদের বৈদিক মন্ত্রোপদেশ শিক্ষা দেওয়া হয়। মনুস্মৃতি অনুযায়ী, এরপর তারা ব্রহ্মচারী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। বাঙালি হিন্দু সমাজে উপনয়ন সংস্কার ব্রাহ্মণদের ছাড়া ক্ষত্রিয়, বৈশ্য দের লুপ্তপ্রায়ঃ কিন্তু কিছু অঞ্চল ও পরিবারে এখন প্রাচীন বৈদিক রীতি মেনে ক্ষত্রিয় বৈশ্য দের উপনয়ন সংস্কার প্রচলিত।

উপনয়ন অণুষ্ঠানে শরীরে যজ্ঞোপবীত বা উপবীত (চলিত বাংলায় পৈতে) ধারণ করা হয়। উপবীত প্রকৃতপক্ষে তিনটি পবিত্র সূতো যা দেবী সরস্বতী, গায়ত্রী ও সাবিত্রীর প্রতীক। উপবীত ধারণের সময় উপবীতধারী গায়ত্রী মন্ত্র শিক্ষা করে। উপনয়নের পর ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের দ্বিজ বলা হয়। দ্বিজ শব্দের অর্থ দ্বিতীয় বার জন্ম। বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী, প্রথমবার ব্যক্তির জন্ম হয় মাতৃগর্ভ থেকে; এবং দ্বিতীয়বার জন্ম হয় ব্যক্তির সৎসংস্কার ধারণ করে।

 

১১. বেদারম্ভ :

উপনয়ন এর পরেই এই সংস্কার পালন করা হয়। এই সময় বেদ এবং বিভিন্ন শাস্ত্র অনুসারে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন শুরু হয়। জ্ঞানের সকল শাখায় তাকে বিচরণ করতে হয় এবং এর মাধ্যমে সে জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে আধাত্মিক বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে।

 

১২. সমাবর্তন :

২১ থেকে ২৫ বছর বয়সের মধ্যে যখন শিক্ষা গ্রহণ শেষ হয়, তখন এটি পালন করা হয়। গুরু ছাত্রকে যোগ্যতা অনুযায়ী ডিগ্রি প্রদান করেন। এরপর একজন ছাত্র আত্মনির্ভর এবং স্বাধীন জীবন যাপন করে।

 

১৩. বিবাহ :

ব্রহ্মচর্য শেষে একজন বিয়ে করে পরবর্তী গৃহস্থ জীবনে পদার্পণ করে। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা যারা এতদিন স্বাধীন জীবন যাপন করেছে এখন একসঙ্গে জীবনভর চলার সপথ গ্রহণ করে। বিয়ের পর সন্তান হয় এবং পরিবারের ধারা চলতে থাকে।

 

১৪. বানপ্রস্থ :

৫০ বছর বয়সে গৃহস্থ আশ্রম শেষে বানপ্রস্থ আশ্রম শুরু হয়। নিজের সুবিধার জন্য তিনি যে সব কাজ করতেন তার সবকিছু পরিত্যাগ করেন। পরিবারের সব দায়িত্ব সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে পূজর্চনা, ধ্যান এবং মানবসেবায় নিয়োজিত হন।

 

১৫. সন্ন্যাস :

যদিও ৭৫ বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করার কথা বলা আছে তারপরেও আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আধ্যাত্মিকতা দ্বারা যিনি জাগতিক সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন তিনিই সন্ন্যাস গ্রহণ করবেন। এ সময় তিনি ধনসম্পদ, সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন এবং সকল ইচ্ছা আকাক্সক্ষা পরিত্যাগ করবেন । গাঢ় হলুদ রঙের ঢিলেঢালা পোশাক এই কঠোর জীবনের প্রতীক। তার কোনো নির্দিষ্ট পরিবার সমাজ অথবা গৃহ নেই।

 

১৬. অন্ত্যেষ্টী :

মৃত্যুর পর শবদাহ করা হয়। কিন্তু আত্মা অমর। যখন দেহ অগ্নিতে দাহ করা হয় তখন শরীর যে পাঁচটি উপাদান দিয়ে তৈরি, যেমন মাটি, জল, আগুন, বাতাস এবং আকাশ প্রকৃতিতে মিশে যায়। মৃতের আত্মার শান্তিতে প্রার্থনা করা হয়। শবদাহ হচ্ছে মৃতদেহ সৎকারের সবচেয়ে ভালো উপায়।

অন্তোষ্টিক্রিয়াতে অংশগ্রহণ করা বৈদিক কর্তব্য বৃহদারন্যক উপনিষদ এ বলা হয়েছেঃ—

এতদ বৈ পরমং তপো যত্
প্রেতমপ্লবভ্যা দধতি।।

“মৃতদেহ বহন করে দাহস্থলে নিয়ে যাওয়া এবং দাহ করা পরম তপস্যা।
(বৃহদারন্যক উপনিষদ ৫.১১.১)

 

তথ্যসূত্র
সুবলচন্দ্র মিত্র, সরল বাঙ্গালা অভিধান, নিউ বেঙ্গল প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা, ১৯৮৪।

১।গর্ভাধান(অথর্ববেদ ৬/৮১/২)
২।পুংসবন (অথর্ববেদ ৩/২৩/৬)
৩। সীমান্তোয়ন(ঋগ্বেদ২/৩২/৪)
৪।জাতকর্ম্ম(ঋগ্বেদ৫/৭৮/৯)
৫।নামকরণ (যজুর্বেদ ৭/২৯)
৬।নিষ্ক্রমণ(অথর্ববেদ ৮/২/১৪)
৭।অন্নপ্রাশন(অথর্ববেদ ৮/২/১৯)
৮।মুন্ডন(অথর্ববেদ৬/৬৮/৩)
৯।কর্ণবেধ(অথর্ববেদ৬/১৪/২)
১০।উপনয়ন(অথর্ববেদ১১/৫/৩)
১১। বেদারম্ভ(অথর্ববেদ১১/৫/২৪)
১২।সমাবর্ত্তন(ঋগ্বেদ৩/৮/৪)
১৩।বিবাহ(অথর্ববেদ১১/৫/১৮)
১৪।বানপ্রস্থ(ঋগ্বেদ১০/১৪১/৫)
১৫।সন্ন্যাস(ঋগ্বেদ৯/১১৩/৪)
১৬।অন্তেষ্টি(যজুর্বেদ ৪০/১৫)

Exit mobile version