হিন্দু ধর্মে পূজা শুধু আচার বা প্রথা নয়, এটি ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতার এক মহান প্রকাশ। পূজা মানে ঈশ্বরকে সম্মান, ভক্তি ও নিবেদনের মাধ্যমে আহ্বান করা। ফুল, পত্র, চন্দন, ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য দিয়ে দেব-দেবীর আরাধনা করার মধ্যেই নিহিত থাকে ভক্তের অন্তরের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। বৈদিক যুগে যেখানে উপাসনা ছিল যজ্ঞকেন্দ্রিক, সেখানে পৌরাণিক যুগে দেব-দেবীর প্রতিমা, চিত্র বা ঘটে পূজা করার প্রথা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
পূজার রয়েছে কিছু সাধারণ নিয়ম, যা সকল দেবতার ক্ষেত্রেই পালনীয়। এর মধ্যে থাকে পূজার উপকরণ, বাদ্যযন্ত্র, শুদ্ধি, মন্ত্রপাঠ ও নির্দিষ্ট ক্রমে আরাধনা। একই সঙ্গে প্রতিটি দেবতা বিশেষ কিছু উপচার, ফুল বা পত্র পছন্দ করেন, যার প্রতি ভক্তকে সচেতন থাকতে হয়।
আজকের আলোচনায় আমরা জানব পূজার সাধারণ নিয়ম, উপাচার বা উপকরণের ব্যবহার, বাদ্যযন্ত্রের ভূমিকা এবং পূজা সম্পাদনের ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া। এটি শুধু ভক্তির বিষয় নয়, বরং ভক্ত ও ঈশ্বরের মধ্যে আধ্যাত্মিক যোগসূত্র স্থাপনের এক মাধ্যম।
Table of Contents
পূজার সাধারণ নিয়ম
পূজা বলতে কি বোঝায়?
‘পূজা’ শব্দটির মানে হচ্ছে ‘পুষ্পকর্ম’। পুষ্প, বিল্বপত্র, তুলসীপত্র, চন্দন, দূর্বা, আতপচাল প্রভৃতি দিয়ে দেব-দেবীর অর্চনা করাকে পূজা বলে।
বৈদিক যুগে উপাসনা ছিল যজ্ঞ ভিত্তিক। কিন্তু পৌরাণিক যুগে ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তি ও গুণ-এর সাকার রূপ হিসেবে দেব-দেবীর পূজার প্রচলন ঘটে। ঋষিরা ধ্যানে দেবতার রূপ প্রত্যক্ষ করে মন্ত্রে সেই রূপ বর্ণনা করেছেন। মন্ত্রে বর্ণিত সেই রূপকে বিভিন্ন আধারে পূজা করা হয়।
এই আধারগুলো হচ্ছে-ঘট, বিগ্রহ বা প্রতিমা, যজ্ঞের বেদী, অগ্নি, জল, যন্ত্র (কোনো পাত্রে অঙ্কিত বিশেষ প্রতীকী চিহ্ন), চিত্র, দর্পণ, মণ্ডল এবং হৃদয়। বর্তমানে প্রতিমা, চিত্র, ঘট প্রভৃতি আধারে পূজা করার রীতিই সমধিক প্রচলিত । প্রতিমা মানে ‘সাদৃশ্য’। হিন্দু ধর্মে তাই প্রতিমা বলা হয়, পুতুল বলা হয় না। দেবতারা চেতনসত্তা। সকল দেবতাই পাপ নাশক ও মঙ্গলকারক।
মন্ত্র, শ্লোক, স্তব ও স্তোত্রে যে দেবতার যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাকেই প্রতিমার আকারে প্রত্যক্ষ রূপ দিয়ে পূজা করা হয়। মৃত্তিকা, দারু (কাঠ) বা ধাতু নির্মিত প্রতিমার মধ্য দিয়ে চৈতন্যের পূজা করা হয়। পূজা ও সাকার উপাসনার এটাই বিশেষত্ব। আবার হিন্দুধর্মে বহু দেবতার পূজার প্রচলন থাকলেও হিন্দুধর্ম বহু-ঈশ্বরবাদী নয়। দেবতারা ঈশ্বর নন। দেবতারা হলেন এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন গুণ ও ক্ষমতার সাকার রূপ।
পূজার সাধারণ নিয়ম
প্রত্যেক দেব বা দেবীর পূজার বিশেষ বিশেষ এবং সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে। তবে সকল দেবতার পূজার ক্ষেত্রে কতকগুলো সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করতে হয়।
পূজার উপচার বা উপকরণ
পুষ্প, দুর্বা, বিল্বপত্র, তুলসীপত্র, চন্দন, আতপ চাল, ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য – পূজার প্রধান উপচার বা উপকণ। পঞ্চোপচার, দশোপচার বা ষোড়শ উপচারে পূজা করা হয়। সাধারণত পঞ্চ বা দশ উপচারে দেবতার পূজা করা হয়। তবে বিশেষ পূজায় দেবতাকে ষোড়শ উপচারে পূজা করা হয় ।
পঞ্চ উপচার:
ধূপ, দীপ, গন্ধ, পুষ্প ও নৈবেদ্য এই পাঁচটি হচ্ছে পঞ্চোপচার।
দশোপচার:
পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, স্নানীয়, পুনরাচমনীয়, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য – এই দশটি হচ্ছে দশোপচার।
ষোড়শোপচার:
রজতাসন (রূপার আসন), স্বাগত, পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক, স্নানীয়, বস্ত্র, আভরণ, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, পুনরাচমনীয় ও তাম্বুল— এই ষোলটি উপচার নিয়ে হল ষোড়শ উপচারের পূজা। ষোড়শ উপচারের অন্যতম উপচার হচ্ছে মধুপর্ক। এই মধুপর্ক দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, মধু ও চিনি এবং কিঞ্চিৎ জলের সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়।
একেক দেবতা একেক প্রকার পুষ্প বা পত্র বেশি ভালবাসেন। আবার কোন কোন পুষ্প বা পত্র পছন্দ করেন না। শিব পূজায় ধুতুরা ও আকন্দ, নারায়ণ পূজায় শ্বেত পুষ্প, দুর্গাপূজায় রক্তবর্ণ পুষ্প প্রশস্ত। বিষ্ণু বা নারায়ণকে অবশ্যই তুলসীপত্র দিয়ে পূজা করতে হবে। শিব বিল্বপত্র পছন্দ করেন। আবার নারায়ণ পূজা ও সূর্য পূজায় বিল্বপত্র নিষিদ্ধ ৷
পূজায় বাদ্যযন্ত্ৰ
দেব-দেবীদের পূজায় বাদ্যের প্রয়োজন হয়। পূজায় ঘণ্টা, কাঁসর, শঙ্খ, ঢাক, ঢোল, সানাই প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়। ঘণ্টাকে বলা হয় ‘সকল বাদ্যময়ী’। অন্য বাদ্যের অভাবে শুধু ঘণ্টা বাজিয়েই পূজা করা যায়। তবে একেক দেবতার পূজায় একেক বাদ্য নিষিদ্ধ। যেমন, লক্ষ্মীপূজায় ঘণ্টা বাজানো নিষেধ। শিব পূজায় করতাল, দুর্গা পূজায় বাঁশি, ব্রহ্মাপূজায় ঢাক এবং সূর্য পূজায় শঙ্খ বাজানো নিষিদ্ধ ।
পূজা পদ্ধতি
প্রতিমা, পট বা চিত্রে পূজা করতে হলে দেবতার চক্ষুদান ও প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হয়। সাধারণ বা নিত্যপূজায় সংক্ষেপে এবং বিশেষ পূজায় বিশেষ মন্ত্রে ঘটস্থাপন করার বিধান আছে। পূজা করার সময় নিম্নলিখিত কাজগুলো ক্রমানুসারে করে যেতে হয়।
আচমন :
প্রথমে আচমন করতে হয়। ওঁ মন্ত্র উচ্চারণ করে ঠোঁটে তিনবার জল স্পর্শ করলে সংক্ষেপে আচমন হয় ।
বিষ্ণু স্মরণ :
আচমনের পর বিষ্ণুকে স্মরণ করতে হয়।
সরলার্থ
দ্যুলোকের চক্ষুর মত বিস্তৃত সেই বিষ্ণুর পরম পদ মেধাবীগণ সর্বদা প্রত্যক্ষ করে থাকেন।
সূর্যার্ঘ্য ও সূর্যপ্রণাম :
তারপর সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য দিয়ে সূর্যকে প্রণাম করতে হয়।
স্বস্তিবাচন :
এরপর স্বস্তিবাচন মন্ত্র পাঠ করতে হয়। ‘স্বস্তি’ শব্দের অর্থ হচ্ছে মঙ্গল। স্বস্তি বাচনের সময় বাদ্য বাজাতে এবং উলুধ্বনি দিতে হয়। স্বস্তিবাচনের পর যথাক্রমে সংকল্প, ঘট স্থাপন, সামান্যার্ঘ্য, দ্বারদেবতার পূজা, বিঘ্ন অপসারণ ভূতাপসারণ (অমঙ্গল দূর করা), আসন শুদ্ধি, পুষ্পশুদ্ধি, করশুদ্ধি প্রভৃতি করতে হয়। অতঃপর গণেশ, শিব, সূর্য, অগ্নি, বিষ্ণু বা নারায়ণ ও জয় দুর্গা– এই দেবতাদের পূজা পঞ্চ উপচারে করণীয়।
এ-সকল দেবতার পূজা শেষে ভূতশুদ্ধি, মাতৃকান্যাস ও প্রাণায়াম করতে হয়। ভূত শুদ্ধি হচ্ছে পরমাত্মা বা ঈশ্বরের সঙ্গে জীবাত্মার মিলনাত্মক ধ্যান। আর প্রাণায়াম হচ্ছে শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগের বিশেষ প্রক্রিয়া। প্রাণায়াম এক ধরনের যোগব্যায়ামও বটে, এতে প্রাণশক্তি বৃদ্ধি পায়। প্রাণায়ামের পর করতে হয় করন্যাস ও অঙ্গন্যাস। ন্যসের দ্বারা শরীর দেবময় হয়। অর্থাৎ নিজের ভেতরে দেবতা অধিষ্ঠিত—এই বোধ জন্মে।
তারপর যে বিশেষ দেবতার পূজা করা হবে তাঁর ধ্যান করতে হয়। ধ্যানের জন্য নির্দিষ্ট মন্ত্র আছে। অতঃপর মানসপূজা। মানসপূজা হচ্ছে বাহা পূজার বিধি অনুসারে মনে মনে ক্রমানুসারে পূজা করা । বাক্য, মন ও হৃদয় দ্বারা মানসপূজা করণীয়। এর পর বিশেষার্ঘ্য স্থাপন করে পুনরায় করন্যাস ও অঙ্গন্যাস করতে হয় এবং আবার ধ্যান করতে হয়।
ধ্যানের জন্য সুনির্দিষ্ট মন্ত্র আছে। ধ্যান শেষে যে দেবতার পূজা বিশেষভাবে করা হচ্ছে তাঁকে নির্দিষ্ট মন্ত্রে আবাহন জানাতে হয়। উদ্দিষ্ট দেবতাকে এই বলে আবাহন জানাতে হয়, ‘ইহ আগচ্ছ, ইহ তিষ্ঠ, মম পূজাং গৃহাণ’ হে দেবতা, – তুমি এখানে এস, এখানে অবস্থান কর এবং আমার পূজা গ্রহণ কর । অতঃপর পঞ্চ বা দশোপচারে উদ্দিষ্ট দেবতার পূজা করে, পুষ্পাঞ্জলি প্রদান, বীজমন্ত্র জপ, জপ বিসর্জন ও প্রণাম মন্ত্র পাঠ করতে হয়।
পূজা শেষে দক্ষিণা দান। তারপর পূজার সফলতা প্রার্থনা করে নারায়ণকে প্রণাম করে পূজা সমাপন করতে হয়।
বিশেষ পূজার ক্ষেত্রে আরও কিছু করণীয় আছে এবং পূজা শেষে যজ্ঞ করার বিধান রয়েছে। স্বস্তি, সংকল্প, শান্তিমন্ত্র প্রভৃতি ক্ষেত্রে বেদের ভিত্তিতে ভিন্নতা রয়েছে। অর্থাৎ ঋগবেদীয়, সামবেদীয়, যজুর্বেদীয়—এই তিন বেদের ভিত্তিতে তিন রকমের মন্ত্র রয়েছে।
পূজা করা একটি বিশেষ ও ব্যবহারিক প্রক্রিয়া। অভিজ্ঞ পুরোহিতের পূজা করা দেখে এবং ‘পুরোহিত দর্পণ’ প্রভৃতি পৌরহিত্যের গ্রন্থাদি পাঠ করে পূজা পদ্ধতি ও মন্ত্রাদি আয়ত্ত করতে হয়। এখানে সংক্ষেপে শুধু পূজা পদ্ধতির একটি রূপরেখা উল্লেখ করা হল।

পুষ্প, পত্র, দুর্বা, চন্দন প্রভৃতি দিয়ে দেব-দেবীর অর্চনা করাকে পূজা বলে। বৈদিক যুগে উপাসনা ছিল যজ্ঞভিত্তিক। পৌরাণিক যুগে ধ্যানের মন্ত্রানুসারে দেবতার প্রতিমা নির্মাণ করে বা ঘটে ও প্রতীকে পূজা করার রীতি প্রচলিত হয়। বহু দেবতার পূজা করা হলেও হিন্দু ধর্ম বহু-ঈশ্বরবাদী নয়, দেবতারা আসলে একই ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তি ও গুণের সাকার রূপ মাত্র।
প্রত্যেক দেব বা দেবীর পূজার বিশেষ বিশেষ মন্ত্র এবং সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে। তবে সকল দেবতার পূজার ক্ষেত্রে কতকগুলো সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। পূজার কাজগুলো ক্রমানুসারে করতে হয় এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মন্ত্র আছে। পূজা একটি ব্যবহারিক প্রক্রিয়া। অভিজ্ঞ পুরোহিতের পূজা করা দেখে এবং ‘পুরোহিত দর্পণ’ প্রভৃতি পৌরোহিত্যের গ্রন্থাদি পাঠ করে পূজা করা শিখতে হয়।