ঈশ্বর গীতা – কূর্ম পুরাণ – পৃথ্বীরাজ সেন

ঈশ্বর গীতাঃ ঋষিরা বললেন–সুত তুমি আমাদের কাছে স্বায়ম্ভুব সৃষ্টির কথা বলেছ, এই ব্রহ্মাণ্ডের বিস্তার আর বিভিন্ন মনুর অধিকার কালের কথাও ব্যক্ত করেছ।

তাতে যে ঈশ্বরস্বরূপ দেবকেই ধর্মনিষ্ঠা জ্ঞানযোগী ঋষিগণের আরাধনা করা উচিত সে কথাও বলা হয়ে গিয়েছে, আবার সমস্ত সংসারের অতিনাশক পরম তত্ত্বসমূহের কথাও তুমি বলেছ।

এর সাহায্যে আমরা সেই ব্রহ্মবিষয়ক পরম জ্ঞান লাভ করতে পারি তার ফলে তুমি স্বাক্ষাৎ নারায়ণের স্বরূপ প্রাপ্ত হয়েছ।

পুরাণতত্ত্বজ্ঞ সূত মুনিদের এই কথা শুনে প্রভু কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণকে স্মরণ করে বলবার উপক্রম করলেন, এমন সময়ে ভগবান কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ ব্যাস স্বয়ং মুনিদের যজ্ঞস্থলীতে উপস্থিত হলেন।

পুরাকালে কূর্মরূপী বিষ্ণু মুনিদের কাছে মোক্ষদায়ক দিব্যজ্ঞানের কথা বলেছিলেন- আপনিই যোগ্য তাই এঁদের কাছে প্রকৃত রূপে রুদ্রদেব মুনি ব্যাস সূতের কথা সূত বলতে শুরু করলেন।

 ঈশ্বর গীতা - কূর্ম পুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

পুরাকালে সনৎ কুমারদি শ্রেষ্ঠ যোগীদের জিজ্ঞাসার উত্তরে স্বয়ং মহাদেব যা বলেছিলেন সনক সনন্দন, রুদ্র, সনন্দ, কপিল মুনিরা পরস্পর তর্ক-বিতর্ক করেও চিত্তের সংশয় নিরাময় করতে পারলেন না। ঘোর তপস্যা করলেন পুণ্যদায়ক বদরিকাশ্রমে। নারায়ণ মুনিদের মনোবাঞ্ছা জেনেও গম্ভীরবাক্যে প্রশ্ন করলেন, কেন তারা তপস্যা করছেন?

ঈশ্বর গীতা – কূর্ম পুরাণ – পৃথ্বীরাজ সেন

মুনিরা তাঁকে বললেন, ব্রহ্মবাদী হলেও অত্যন্ত সংশয় আকুল হয়ে আপনার শরণ নিয়েছি। সনৎকুমার প্রমুখ মুনিগণ ত্রিনয়ন, চন্দ্রভূষণ মহেশকে দর্শন করে স্তব করে। হে ঈশ্বর মহাদেব, আপনার জয় হোক, আপনি সকল মুনিবৃন্দের ঈশ্বর, পুণ্ডরীকাক্ষ ব্রহ্মবাদী মুনিরা বললেন– হে হর, একমাত্র আপনিই নিজের আত্মাকে বৃষধ্বজের দিকে দৃষ্টিপাত করে যোগসিদ্ধি প্রদর্শন করুন।

তারপর তিনি মুনিবরদের বললেন, শূলধারী শঙ্কর মহাদেবের দর্শন পেয়েছেন বলে আপনারা নিজেদের ধন্য মনে করুন।

সনৎকুমার প্রমুখ মুনিরা বিষ্ণুর কথা শুনে বৃষধ্বজ মহেশ্বরকে প্রণাম করে তার কাছে নিজের প্রশ্ন রাখলেন। মহেশ্বর নিজ তেজে চারদিক আলো করে বিষ্ণুর সঙ্গে সেই আসনে উপবিষ্ট হয়ে শোভা পেতে লাগলেন।

ব্রহ্মবাদী মুনিরা উজ্জ্বল আসনের উপর দেবাদিদেব শঙ্করের অপূর্ব দীপ্তি বিপুল তেজ, শান্ত শিবের থেকে প্রাণীদের উৎপত্তি হয়, প্রাণীরা বিলীন হয়ে যায়। সেই ভূতনাথ ঈশ্বরকেই মুনিরা আসনে উপবিষ্ট দেখলেন। পরম ঈশ্বর মহেশ্বরই বাসুদেবের সঙ্গে দৃষ্টিগোচর হয়েছিলেন।

মহেশ্বর সনকুমার মুনিদের প্রশ্নে পুণ্ডরীকাক্ষের দিকে দৃষ্টিপাত করে যে শ্রেষ্ঠ সামযোগের কথা মুনিদের কাছে বলেছিলেন, তাই আমি বলছি, হে মুনিগণ, আপনারা শান্ত মনে ঈশ্বরপ্রাপ্ত সেই জ্ঞানের কথা শুনুন।

দ্বিজাতিরা ব্ৰহ্মত্ব প্রাপ্ত হয়, আত্মগুহ্য জ্ঞান লাভ করলে এই জ্ঞান গুহ্য থেকে গুহ্যতম, একে অতি যত্নে পালন করে রাখতে হয়। তোমরা অত্যন্ত ভক্তিমান ও ব্রহ্মবাদী– তাই তোমাদের এ কথা বলব।

আত্মা অন্তর্যামী। ইনি পুরুষ, প্রাণ, মহেশ্বর বেদ আর শ্রুতি বিশ্বের উৎপত্তি ও লয়। এই আত্মা থেকেই বেদবিদ্বানগণ বলেন, আত্মাই সবকিছুর স্বাক্ষী, প্রকৃতির পরিস্থিত, ভোক্তা, অক্ষর চেতন আর সর্বত্র অবস্থিত। অজ্ঞান বা অন্যরকম জ্ঞান থেকেই তত্ত্বগুণীর প্রকৃতির সঙ্গে মিলন ঘটে।

যখন কেবল আত্মাকে পরমার্থ রূপে ও সকল জগৎকে মায়ামাত্র বলে উপলব্ধি করা যায় তখন আসে নিবৃত্তি। যোগ থেকে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তেমনি আবার জ্ঞান থেকেও যোগ শুরু হতে পারে। যিনি সংখ্যা আর যোগকে এক বলে জানেন তিনিই তত্ত্বদর্শন নিপুণ নির্মল আত্মার হেতু স্বরূপ যে শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্য, তাকে সৃষ্মদর্শী ঋষিরাই দেখতে পান।

প্রধান আর পরম পুরুষ অব্যক্ত থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এই সমগ্র জগৎকে যিনি জন্ম দিয়েছেন তিনিই প্রকৃতি। সকল জীবের মোহ সৃষ্টি করে প্রকৃতি। প্রকৃতির প্রথম বিস্তারকে মহান বলে।

 ঈশ্বর গীতা - কূর্ম পুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

মহানই আত্মা, মন তার সাহায্যকারী। কালকে কিন্তু কেউ বশীভূত করতে পারে না তাই কালকেই ভগবান, প্রাণ, সর্বজ্ঞ আর পুরুষোত্তম বলা হয়েছে। একমাত্র মহেশ্বরই মায়াবী ও মায়া স্বরূপ কালের সঙ্গে সঙ্গত হয়ে সর্বদা সকল জগৎ সৃষ্টি করে। এই বেদের অনুশাসন।

বেদের মাহাত্ম কীর্তন প্রসঙ্গে, ঈশ্বর বললেন, সকল রকম তপস্যা, দান, যজ্ঞের দ্বারা তাকে জানা যায় না। একমাত্র অত্যুৎকৃষ্ট ভক্তির দ্বারা আমাকে জানা যায়। ব্রাহ্মণরা নানাপ্রকার বৈদিক যজ্ঞ দ্বারা আমার যজন করে, আমি সকল দেবতার শরীর হয়ে সকলের আত্মারূপে সর্বত্র অবস্থান করি। আমিই যোগীদের অব্যয় গুরু।

আমার দ্বিতীয় বিতুল্য শক্তিই নারায়ণ, কেউ আমাকে ধ্যানে বা জ্ঞানে দর্শন করে। পণ্ডিতরা বর্ণনা করেছেন আমাকে যোগী আর মায়া বলে। এই সর্ব বেদবিনিশ্চিত গুহ্যতম জ্ঞান যাকে তাকে দান করতে নেই। পরমেশ্বর যোগীদের এই কথা বলে নৃত্য করতে আরম্ভ করলেন।

যার সহ্য মস্তক, আকার ও বাহুজটা জুটাধারী ব্যাঘ্রচর্মধারী বিশাল ভূজে ধৃত রয়েছে শূল, তিন নয়ন যাঁর তাঁকে ব্রহ্মবাদী মুনিরা নৃত্যরত দেখলেন। ব্রহ্মবাদী মুনিরা তাঁকে দেখে নিজেদের কৃতার্থ মনে করলেন।

তাঁরা ভূমিতে মস্তক স্পর্শ করে নিজ নিজ মস্তক অঞ্জলি বর্ধন করলেন, তাঁরা স্তব করে বললেন, পুরাণ পুরুষ প্রাণেশ্বর রুদ্র, অনন্তযোগ, অচেতা, ব্রহ্মময়, প্রাণ পুরুষ সকলে বলে তুমি অদ্বিতীয়, পুরাণ পুরুষ আকাশ ব্রহ্মশূন্য তুমি রুদ্র আর কপদী।

বৃষবাহন কপদী ভব প্রীতি লাভ করে পরম রূপকে সঙ্কুচিত করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন।

ঈশ্বর বললেন, পরমেষ্ঠী ঈশ্বরের মাহাত্ম্য যথাযথ বর্ণনা করবেন। তিনি সকল বস্তুর অন্তর্যামী মহেশ্বর তিনি সর্বত্র অবস্থান করেন। তিনি সকল ভাব অন্তর্বর্তী হয়ে জগৎ চালনা করেন। তার আদি ও অন্ত নেই। হিরণ্যগর্ভ মূর্তিও তাঁর দেহ থেকে উদ্ভূত। ব্রহ্মা তাঁরই নিয়োগ অনুসারে দিব্য ঐশ্বর্য সর্বদা নিজের কাছে রাখেন।

রুদ্র, বহ্নি, অগ্নি, বরুণ সকলে তাঁর আজ্ঞায় চলেন। মানুষের সত্র জীবন রূপ সোম তাঁর আদেশ প্রেরিত হয়ে বর্তমান রয়েছে। যাবতীয় ধনের অধ্যক্ষ কুবের তাঁর আদেশে সর্বদা অবস্থিত। আদিত্য বসু রুদ্র বায়ু অশ্বিনীকুমার অন্যান্য সকল দেবতা তার শাসনে অবস্থিত।

পরম বিদ্যাও তাঁর আদেশেই অধিষ্ঠিত, সমস্ত জগৎ তাঁর শক্তি স্বরূপ, তিনিই একে সৃষ্টি করেছেন অন্তিম ওনাতেই বিলীন হয়ে যায়, তিনিই ভগবান, ঈশ্বর স্বয়ং জ্যোতি সনাতন, পরমাত্মা ও পরমব্রহ্ম।

এই পরমেষ্ঠীর প্রভাবের কথা শুনলে পুরুষ মুক্ত হয়। ব্রহ্মজ্ঞদের মধ্যে তিনি স্বয়ম্ভ আর বিশ্বতোমুখ ব্রহ্মা। যোগীদের মধ্যে শম্ভ, স্ত্রীদের মধ্যে পার্বতী, মন বুদ্ধি অহংকার, আকাশ, অগ্নি, জল, অনিল, পৃথিবী এই আট প্রকৃতি বা সবই বিকার।

পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় ইতা পদার্থ প্রকৃতি তত্ত্ব আর যে সে অব্যক্ত প্রধান গুণলক্ষণ আদি মধ্য আর অন্তহীন জগতের পরম কারণ সে চতুর্বিংশ তত্ত্ব সত্ত্বরজঃ তম–তিন গুণ, অবিদ্যা সমতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশ আত্মার বন্ধনের কারণ বলে এদের পাওয়া বলে সর্বজ্ঞ কর্মকর্তা পাবক সকলে আদ্যা ও পুরাণ পুরুষ বলে।

ঈশ্বর এরপর আদ্য একটি জ্ঞানের কথা বললেন–যা জানলে প্রাণীরা ঘোর সংসার সাগর পার হতে পারেন। ঈশ্বর বললেন। তিনি সাধন বিদ্যার ওঁঙ্কার মূর্তি ব্রহ্মা আর প্রজাপতি যে ঈশ্বরকে সকল পদার্থে সমানভাবে অবস্থিত বলে দর্শন করে। সেই প্রকৃতপক্ষে নিজে হিংসা করে না।

 ঈশ্বর গীতা - কূর্ম পুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

সে পরমেশ্বরকে গুহ্যহিত পরম প্রভু পুরাণ পুরুষ বিশ্বরূপ আর হিরণ্যময় বলে জানে। সেই বুদ্ধিমানই বুদ্ধিকে অক্রিম করে পরুম পদে প্রতিষ্ঠা করে।

পরমেশ্বর যদি নিষ্ফল, নির্মল নিত্য আর নিষ্ক্রিয় হন তবে ঈশ্বর কি করে বিশ্বরূপী হবেন? ঈশ্বর বললেন, তিনি বিশ্বনম কিন্তু বিশ্বও তাকে ছাড়া থাকতে পারে না। তত্ত্বে স্বর্গমধ্যে যে তেজ প্রকাশিত হয় ধীর তাকেই উজ্জ্বল নির্মল আকার ধাম বলে প্রত্যক্ষ করেন। তিনি একমাত্র ক্রীড়াময় ও সকল ভূতেই সূক্ষ্মভাবে অবস্থিত।

ঈশ্বর বললেন, পরমব্রহ্ম অনিষ্ঠ এক অব্যক্ত লিঙ্গ ধ্রুবই স্বয়ং জ্যোতি স্বরূপ, পরমতত্ত্ব ও পরম আকাশে অবস্থিত একমাত্র শিবই আদি, মধ্য ও অন্তশূন্য পরম বস্তু, ইনিই ঈশ্বর তিনি ক্রীড়াময় কেবলমাত্র শিবরূপে শোভিত হয়ে থাকেন।

ঈশ্বর এরপর আত্মাকে ঈশ্বর রূপে দান করার পরম দুর্লভ যোগের কথা বললেন। যে ব্যক্তির মধ্যে যোগ আর জ্ঞানের সমন্বয় তার প্রতি মহেশ্বর প্রসন্ন হন। ঈশ্বর অর্চনায় পাঁচ নিয়ম হল– তপস্যা, সন্তোষ, শৌচ, আসন তিন প্রকার স্বস্তিকাসন, পদ্মাসন ও অধাসন, সমস্ত সাধনের মধ্যে ঐ আসনই উত্তম সাধন।

উত্তম পদ্মাসন হল উরুদ্বয়ের উপর নিজের পাদদ্বয় রেখে উপবেশন করা, স্বস্তিকাসন হল নিজের জানু ও ঊরুতে রেখে উপবেশেন করা পাদ তালু উরুতে বিন্যাস করে উপবেশন করা হল অর্ধাশন– এই তিন আসন করে চক্ষু ঈষৎ উন্মীলন পূর্বক নাসাগ্রে দৃষ্টি নিবন্ধ করে নির্ভয় ও শান্ত হয়ে মায়াময় জগৎকে পরিত্যাগ করে নিজের মধ্যে অবস্থিত দেব পরমেশ্বরকে চিন্তা করবে।

ধ্যানের ক্ষেত্রে উত্তম পথকে হৃদয়ে চিন্তা করে বহ্নিতুল্য জ্যোতি বিশিষ্ঠ কাণ্ডার স্বরূপ আত্মাকে চিন্তা করবে। আমরা সকল তত্ত্বকে প্রণব দ্বারা বিশোধন করে নির্মল পরমপদ স্বরূপ আমাতে আত্মা সংস্থাপন করবে। ব্যক্তি কোন প্রাণীরই হিংসা করে না, সকল প্রাণীর প্রতি মৈত্রী প্রদর্শন করে, তাদের ওপর দয়াবান হয়, মমত্ত্বশূন্য ও অহংকার বর্জিত হয়, সেই ব্যক্তিই পরমেশ্বরের ভক্ত ও প্রিয়।

যে ব্যক্তি নিরপেক্ষ, শুচি, দক্ষ, উদাসীন, ব্যথাশূন্য সকল প্রচেষ্টাকে যে ত্যাগ করেছে। যে সকল বিষয়ে সন্তুষ্ট, যার গৃহ নেই ব্যক্তিস্থির বুদ্ধি সেই আমার ভক্ত, মরণের চেয়ে যে ব্যক্তি কাশীতে বাস করে সে ঈশ্বরের অনুগ্রহে পরমপদ লাভ করে। সেই কাশীতে মৃত্যুকালে সকল প্রাণী পরমজ্ঞান প্রাপ্ত হয়।

নারায়ণ নামে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ মূর্তি হল সকল প্রাণীর আত্মস্বরূপ যা শান্ত ও অক্ষর রূপে সংস্থিত। ঈশ্বরের ও কারণগত ব্যক্তি মূর্খই হোক আর পণ্ডিতই হোক ব্রাহ্মণই হোক বা চণ্ডালই হোক নারায়ণকে চিন্তা করলেই তার মুক্তি ঘটে।

ভগবান নারায়ণ পরম শরীর ত্যাগ করে তাপসবেশে যোগীদের বললেন, সাক্ষ্য দেবস্বরূপ পরমেষ্ঠী মহাদেবের অনুগ্রহে সংসার নাশক নির্মল জ্ঞান লাভ করেছেন। ভক্তি মান্য শান্ত, ধার্মিক অহিতাগ্নি ব্রাহ্মণকেই ঈশ্বর বিজ্ঞান সযত্নে দান করতে হয়। মহাযোগী নারায়ণ এই বলে অন্তর্হিত হলেন।

ব্যাস ঋষিগণ ব্রাহ্মণদের অত্যন্ত প্রিয় কর্মযোগের কথা বললেন। পূর্বকালে দ্বিজগণের যজ্ঞ পবিত্রের জন্যই ব্রাহ্মণ কার্পাস তৈরি করেছিলেন। ব্রাহ্মণ সর্বদাই উপবীত ধারণ করে থাকবেন এবং শিখাবন্ধন করে রাখবেন। যার উপনয়ন হয়েছে এমন ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচারী জগৎশব্দ উচ্চারণ করে ভিক্ষা আহোরণ করবে।

স্বজাতীয় গৃহ থেকেই ভিক্ষা আহোরণ করবে। সবর্ণের কাছে ভিক্ষা করা যায়। কিছু পতিত ব্যক্তির কাছে কখনোই ভিক্ষা করতে নেই। প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন লোকের গৃহে ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করবে। অন্ন প্রতিদিন গ্রহণ করবে, অত্যন্ত আদরের সঙ্গে আমি ভোজন করবে। অন্ন নিন্দা করবে না। অতি ভোজন পরিত্যাগ করবে। উত্তর মুখো হয়ে ভোজন করবে না এই সমস্ত হল সনাতন বিধি।

ভোজন, পান, নিদ্রা ও স্নানের পর পথ গমনের পর লোমহীন ওষ্ঠ স্পর্শ করলে, বস্ত্র পরিধান করলে উঠানে গমন করলে ব্রাহ্মণকে পুনর্বার আচমন করতে হয়। নিদ্রার পরও আচমন করবে। স্ত্রীলোকের দেহের স্পর্শে নীলবস্ত্র পরিধান করলে এবং নিজ দেহ থেকে স্খলিত বেশ বা অধৌত বস্ত্র স্পর্শ করলে পৃথিবী বা তৃণ স্পর্শ করবে না।

অরণ্যে জলশূন্য স্থানে, রাত্রে, পথে প্রত্যহ যদি কোন ব্যক্তি মলমূত্র ত্যাগ করে তবে দোষ হয় না। তৃণ দ্বারা ভূমি আচ্ছাদন করে মলমূত্র ত্যাগ করতে হয়। কুল থেকে মৃত্তিকা আহরণ করে মলমূত্রের স্পর্শ ও গন্ধ দূর হয়। এমনভাবে অন্যান্য ত্যাগ করে মৃত্তিকা ও বিশুদ্ধ তেল জলের দ্বারা শৌচ করবে। আর্চনাদির পর বিধান অনুযায়ী নিত্য আচমন করবে।

শৌচাগার সমন্বিত ব্রহ্মচারীকে গুরু তাকালে তার গুরুমুখ নিরীক্ষণ করে অধ্যয়ন করা উচিত। গুরু চেয়ে শিষ্যের আসল ও শায্যা সর্বদা ক্রুদ্ধ হয়ে ঝরতে নেই। মনে মনে যখন গুরু ত্যাগ করব এমন চিন্তা করবে না। গুরু পুত্র বেদের অধ্যাপক হলে তিনি গুরুর মতো মাননীয় হন।

সে দ্বিজাতি বেদ অধ্যয়ন না করে অন্য শাস্ত্রাধ্যয়নে যত্ন করে সে অতিশয় সূচ ও বেদবহিষ্কৃত হয় সে বিধি পূর্বক বেদাধ্যয়ন করে ও বেদার্থ বিচার করে না, সে সর্বাঙ্গে শুদ্ধতুল্য হয় ও দান প্রভৃতির পত্ররূপে পরিণিত হয় না।

দ্বিজারি নিজ শামা অধ্যয়নের পর একবেদ দুই বেদ অধ্যয়ন করবে। গুরুকে ধন দ্বারা পরিতুষ্ট করে তার অঙ্গ গ্রহণপূর্বক সমাবর্তন স্নান করবেন। প্রত্যহ আলিস হয়ে বেদান্ত স্বকীয় কার্য করবে, না করলে শীঘ্রই পতিত হতে হয় ও দেহাবসানে ভীষণ নরকে বাস করতে হয়।

নিজের দুঃখের মতো পরের দুঃখে সুহৃদভাবে করুণা করার নাম দয়া। তপস্যা প্রভৃতি দ্বারা শরীর ক্ষয়ের নাম ধন দেহ ভিন্ন মহাদেবকে লাভ করা যায় না। সকল প্রাণীর গতি হল দেবরূপী ভগবান। দেবতার নিন্দা করে তার সঙ্গে আলাপ করবে না। যে ব্ৰহ্ম সুচি হয়ে সর্বদা ধর্মাধ্যয় পর্ব করেন বা অন্যকে শ্রবণ করান, তিনি দেহান্তে ব্রাহ্মণকে তামা করে সমহিত হয়ে ব্রহ্মলোকে থাকেন।

কোনো প্রাণীদের হিংসা করবে না, মিথ্যা কথা বলবে না, চুরি করবেন। মুনিরা সর্পাদির মুখনিঃসৃত বিষকে বিষ বলেনি। কিন্তু ব্রহ্মত্ব ও দেবশ্বরকেই বিষ বলেছেন।

উদীয়মান বা অস্তগামী চন্দ্র বা সূর্যকে বিনা কারণে দর্শন করবে না। আকাশ মধ্যস্থ জলবিম্বে প্রতিগত বা রাহুগ্রস্থ চন্দ্র ও সূর্যকে আহরণে দর্শন করবে না। ভার্য্যা যখন প্রস্রাব করছে, হাঁচছে বা হাই তুলছে বা নিজের ইচ্ছামতো বসে আছে তখন তাকে দর্শন করবে না।

জ্ঞানী ব্যক্তি পদ দ্বারা পদ প্রক্ষালন করবেন না। অগ্নিতে নাদদ্বয় তপ্ত করিবেন না। প্রবণঞ্চন করবে না দেবতা গুরু, বিপ্র গো বায়ু, অগ্নি চন্দ্র ও সূর্যকে বাম হাতে জল তুলে পান করাবেন। উষ্ণু হয়ে পশুদের মতো মুখ দিয়ে জল পান করবে না। বিদ্বান ব্যক্তি অগ্নি লঙ্ঘন করবে না। জলে থাকবে না বেশিক্ষণ, সম্ভাষণ করবে না পরস্ত্রীর সঙ্গে।

অগ্নি গো ও ব্রহ্মর মধ্যে দিয়ে কখনো গমন করবে না। তাদের ছায়া লঙ্ঘন করবে না। সম্পর্ক নায় ধুলা গায়ে লাগতে দেবেনা এবং জলের ছিটা গায়ে লাগতে দেবে না। শূদ্রের অন্ন ভোজ করবে না। যে শূদ্ৰান্ন ভোজন করে সে গ্রোযোনি প্রাপ্ত হবে। রাজার অন্ন, নর্তকের অন্ন, গত্রবিবের অন্ন, চর্মকারের অন্ন আনীত জন জন সমূহের অন্ন আর বেস্যার অন্ন সর্বদা পরিত্যাগ করবে।

রুরু হরিণের মাংস ব্রাহ্মণদের নিবেদন করে ভক্ষণ করবে না। পুল নন যজ্ঞে আহুতি দেওয়ার পর আবিষ্ট থাকলে সেই সব প্রাণীর মাংস ভক্ষণ করা যায়। কেউ অভক্ষ্য ভক্ষণ করলে বা অপেয় পান করলে প্রায়শ্চিত্ত করে যে যত দিন না পাপ মুক্ত হয় ততদিন তার কর্মে অধিকার থাকবে না। এর অন্যথা হলে নরকভোগী হবে।

ব্রাহ্মণরা প্রতিদিন নিদ্রা থেকে উঠে মনে মনে ঈশ্বরের চিন্তা করবে, কি করে ঈশ্বরের সেবা করা যায় তার চিন্তা করবে, সূর্যোদয়ের সময় হলে পণ্ডিত ব্যক্তি শাস্ত্রানুসারে শৌচ প্রভৃতি ক্রিয়া সম্পন্ন করে পবিত্র নদীতে স্নান করবে। বিধানজ্ঞ ব্যক্তি নিন্দিব দন্তকাষ্ঠ সমূহ পরিত্যাগ করে শাস্ত্ৰক্ত দন্তকাষ্ঠ গ্রহণ করে অনিষিদ্ধ দিনে তারা দন্ত মার্জনা করবে।

ওঁ খঘোল্কায় গন্ডায়
কারণ এত হেতবে
নিবেদয়ানি আত্মানা;
নমস্তে বিশ্বরূপিনে

প্রাতঃকালে ও মধ্যাহ্নে সর্বশ্রেষ্ঠ সূর্যহৃদয়স্তব পাঠ করে সূর্য প্রণাম করবে। গৃহে আগমন করে বিধি অনুসারে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে যথাবিধি অগ্নিতে হোম করবে। ওঙ্কার উচ্চারণ করে সূর্য দর্শন করবে, জলসহ ডুব দেবে ‘হংস্য শুচিস্য’ এই ঋক মন্ত্র দ্বারা সূর্য দর্শন করবে। গৃহে গিয়ে যজ্ঞ করবে।

দেব, পিতৃ, ভূত, মনু আর ব্রহ্ম হল পঞ্চযজ্ঞ তর্পণে পূর্বে ব্রহ্মযজ্ঞ করা না হলে অতিথি সেবারূপে মনুষ্য যজ্ঞ সমাপন করে বেদ অধ্যয়ন বা ব্রহ্মযজ্ঞ করবে। অগ্নির পশ্চিম দিকে পশুপক্ষী প্রভৃতিকে অম্মাদি দানরূপ ভূতযজ্ঞ সমাধা করবে। পঞ্চযজ্ঞ মহুজ্ঞ করতে না পারলে প্রত্যহ দেব পূজা করবে।

ভূমিতে পদ সংলগ্ন করে শুদ্ধাসনে উপবেশ পূর্বক পূর্বমুখ হয়ে তবে ভোজন করতে হয়। তবু কামাধারী ব্যক্তি পূর্বমুখ করে ভোজন করবে। সত্যকাল কামাকারী ব্যক্তি উত্তরমুখ হয়ে ভোজন করে। উপবাসের অবসানে ভোজন হলে পাঁচ অঙ্গ প্রক্ষালন করে অন্নপাত্র ভূমিতে রেখে ভোজন করা।

 ঈশ্বর গীতা - কূর্ম পুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

দুষ্টু বুদ্ধি ব্যক্তি আর ভোজন দেখছে এমন ক্ষুধার্ত মানুষকে না দিয়ে ভোজন করবে না। অর্ধরাত্র বা মধ্যাহ্নে ভোজন করবে না। অজীর্ণ হলে ভোজন করবে না। ভগ্নপাত্রে ভোজন করবে না। ভোজন করার সময় বেদ পাঠ করবেনা। শয়ন করে ভোজন করবেনা। বিলাপ করতে করতে ভোজন করবেনা।

উত্তর বা পশ্চিম দিকে মুখ করে শয়ন করবে না। বিবস্ত্র ও অসূচি হয়ে শয়ন করা উচিত নয়। ফাঁকা মাঠে শয়ন করবে না। জনশূন্য গৃহে শয়ন করবে না। ব্রাহ্মণদের প্রতিদিন কর্তব্য শেষকাল দান কর্মের কথা বলা হয়েছে সেই কারণে সে ব্রাহ্মণ এইসব বিধি পালন করে না, সে দেহাবসানে ঘোরতর নরকে যায় ও তার কাক যোনিতে জন্ম হয়।

নিজ আশ্রম বিধি ছাড়া অন্য কোন মুক্তির উপায় নেই। তাই পরমেষ্ঠী সন্তোষের জন্য যেসব কর্মের কথা বলা হয়েছে সেগুলি সযত্নে সম্পাদন করবে।

.

ব্রাহ্মণরা অমাবস্যা তিথিতে ভোগ মোক্ষ প্রদায়ক পিণ্ডান্থা কর্তৃক নামে শ্রাদ্ধ করবে। কৃষ্ণপক্ষের সকল তিথিতেই শ্রাদ্ধ করা যায়। কেবল চতুর্দশী ছাড়া চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ ও আত্মীয়দের মৃত্যুর জন্য যে শ্রাদ্ধ হয় তা নৈমিত্তিক শ্রাদ্ধ সংক্রান্তি ও জন্মদিনে কৃত শ্রাদ্ধ অব্যয়কাল দান করে।

রবিবারে শ্রাদ্ধ করলে আরোগ্য প্রাপ্তি হয়। সোমবারে সৌভাগ্য, মঙ্গল করে সর্বত্র বিজয়, বুধে সকল অভীষ্ঠ দ্রব্য লাভ হয়, বৃহস্পতিবারে বিদ্যা ও অভীষ্ট সিদ্ধ হয়। শুক্রে করলে ধনলাভ হয়। শনিতে দীর্ঘ পরমায়ু লাভ হয়।

প্রতিদিন কর্তব্য ও নিত্যশ্রাদ্ধ, কাম্যশ্রাদ্ধ, নৈমিত্তিক শ্রাদ্ধ, বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ, পার্বণশ্রাদ্ধ–এই পাঁচ প্রকার শ্রাদ্ধের কথা মনু বলেছেন। ষষ্ঠ শ্রাদ্ধ হল তীর্থযাত্রার সপ্তম শ্রাদ্ধ। প্রায়শ্চিত্ত কালে কর্তব্য দৈবিক শ্রাদ্ধ অষ্টম শ্রাদ্ধ। সন্ধ্যা ও রাত্রিকালে শ্রাদ্ধ করবে না।

বরাহ বা মহিষ মাংস দ্বারা শ্রাদ্ধ করলে দশমাস আত্মা পরিতৃপ্ত থাকে না। কেঁদোদানের চাল, পালংশাক ও মরিচ শ্রাদ্ধে দান করবে না।

.

অমাবস্যা তিথিতে স্নান করে পিতৃগণের তর্পণ সমাধা করে ও শুচি হয়ে ব্রাহ্মণ সিদ্ধান্তকরণে পিণ্ডাৰাতাবক শ্রাদ্ধ করবে। যোনী শান্ত ও তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তিকেই শ্রাদ্ধ ভোজন করাবে। এদের কাউকে না পেলে সঠিক গৃহস্থকে ভোজন করাবে। তাদের না পেলে ব্রাহ্মণকে ভোজন করাবে। সাধুগণের দ্বারা অনুষ্ঠিত নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের তনুকল্প বলে জানবে।

শ্রাদ্ধে মিত্রকে ভোজন করাবে না। মিত্ৰতা সম্পাদন করবে। ধন দ্বারা মূর্খ ব্রাহ্মণ তৃণাগ্নির দ্বারা নিস্তেজ হয়ে পড়ে অতএব তাকে হব্যাদি দান করবেন না। এদের হব্যাদি দান করলে হব্যাদিদাতা ফল পায় না।

যেসব ব্যক্তি বিহিত কর্মের অনুষ্ঠান না করে এবার নিন্দিত কর্মের অনুষ্ঠান করে তারা সকলেই শ্রাদ্ধ ভোজনের অযোগ্য।

.

গোময় জল দ্বারা সমাহিত চিত্তে ভূমি শোধন করে শ্রাদ্ধের পূর্বদিন ‘আগামি কাল আমি শ্রাদ্ধ করব। বলে পূর্বোক্ত লক্ষণ যুক্ত নিমন্ত্রণ যোগ্য ব্রাহ্মণদের পূজা করে সাধুলোকের দ্বারা নিমন্ত্রণ করবে।

শ্রাদ্ধের দিনেও নিমন্ত্রণ করা যেতে পারে। যে ব্রাহ্মণ নিমন্ত্রিত হয়ে কলহ করে, তার পিতৃগণ সেই মাসে মল ভোজন করে। মোহবশত ভূমিতে শ্রাদ্ধ করলে ভূস্বামী শ্রাদ্ধের অন্ন প্রভৃতি দূষিত করে থাকেন।

 ঈশ্বর গীতা - কূর্ম পুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

শ্রাদ্ধকালে মৃত্তিকা নির্মিত পাত্রে ব্রাহ্মণদের ভোজন করালে দাতা, পুরোহিত ও ভোজনকারী তিন জনের ঘোর নরকপ্রাপ্তি হয়। শ্রাদ্ধে নিযুক্ত ব্রাহ্মণ কিছু পরিত্যাগ করবেনা।

ব্রাহ্মণের সযত্নে শ্রাদ্ধ করবে সনাতন মহাদেবও সম্যকরূপে আরাধিত হবেন। মৃত তিথিতে বিধানানুসারে একোদিষ্ট শ্রাদ্ধ করবে, বিচিত্র সলিলে প্রতিমার বা ব্রাহ্মণে ভক্তি সহকারে প্রথমে গণেশ আর ষোড়শ মৃত্তিকার পূজা করবে।

.

ব্রাহ্মণের দশদিন অশৌচ হয়। সপিন্ড করণে ব্রাহ্মণেরা শুষ্ক অন্ন বা ফল দ্বারা যজ্ঞীয় অগ্নিতে হোম করবে। জাতাশৌচ সপিণ্ড প্রভৃতির স্পর্শ দোষ নেই। শিশু ও প্রসূতিকে স্পর্শ করতে পারবে না।

দু’মাসের মধ্যে স্ত্রীদের গর্ভস্রাব হলে যত মাসের গর্ভ, ততদিনের অশৌচ হবে। স্ত্রীর দশ রাত্রি অশৌচ হবে। সুপণ্ডিতের সদ্য শৌচ হবে। যদি সপ্তম বা অষ্টম মাসে বালক জন্মে মারা যায়, তবে গর্ভ শ্রাবাশৌচের মতোই অশৌচ হবে।

মাতামহের মৃত্যু হলে দৌহিত্রের তিন রাত্রি অশৌচ হয়। সমালোচকের মৃত্যুতে ও জন্মে তিন রাত অশৌচ হয়। দত্তক কন্যার পিতৃগৃহে মৃত্যু হলে পিতার তিন রাত্রি অশৌচ হবে। শূদ্র সপিণ্ডের জন্ম বা মৃত্যুতে বৈশ্যের ছয় রাত্রি ক্ষত্রিয়ের তিন রাত্রি ও ব্রাহ্মণের এক রাত্রি অশৌচ।

ব্রাহ্মণ সপিণ্ডের জন্ম বা মৃত্যুতে শূদ্র, বৈশ্য ও ক্ষত্রিয়ের শুদ্ধি দশ দিনে হবে। অশৌচ ব্যক্তির সঙ্গে যে ব্যক্তি উপবেশন, শয়ন বা ভোজন ঘনিষ্ঠ ভাবে করবে সে বান্ধবই হোক বা পরই হোক দশ দিন অশৌচ পালনে করে শুদ্ধ হতে হবে।

পতিত ব্যক্তির মৃত্যুতে দাহ, অস্থিসঞ্চার বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কিছুই নেই। অশ্রুপাত, পিণ্ডদান বা শ্রাদ্ধ কিছুই করতে নেই। প্রতিদিন গৃহের বহির্ভাগে ও প্রাতঃকালে প্রেতের উদ্দেশে পিণ্ডদান করতে হবে।

স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর শুশ্রূষা ছাড়া অন্য কোন ধর্ম নেই। স্বধর্ম পরায়ণ ও সর্বদা ঈশ্বরে অর্পিত চিত্ত ব্যক্তিরাই বেদবাদীদের দ্বারা পোক্ত সেই উৎকৃষ্ট স্থান প্রাপ্ত হয়।

.

অগ্নিহোত্র হোম করবে স্বয়ংকালে ও প্রাতঃকালে, ঋতুর অন্তে চাতুর্মাল্য যজ্ঞ করবে। ব্রাহ্মণদের অগ্নিহোত্রের চেয়ে অন্য শ্রেষ্ঠ ধর্ম আর কিছুই নেই। সোমলোকস্থিত মহেশ্বরকে সোমবোগ দ্বারা আরাধনা করবে। সোমযোগের চেয়ে শ্রেষ্ঠ যোগ আর নেই। তার সমান কোন যোগও নেই। তার শ্ৰেতি ও শ্রেয় দুই প্রকার ধর্মই বেদ নিঃসৃত তাই ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণকে শ্রদ্ধা করা পণ্ডিতদের কর্তব্য।

.

আশ্রমবাসী গৃহস্থ দ্বিজজাতিগণের এই পরম ধর্মের কথা বললেন–ব্যাস। এখন বৃত্তির কথা বলবেন। সাধক ও অসাধক দু প্রকার। সাধক অবলম্বন করে অধ্যাপনা পতিগ্রহ আর যাজন কুসীদ। কৃষিকর্ম ও বাণিজ্য করতে পারে, কুষীদ অতি পাপজনক জীবিকা তা পরিত্যাগ করাই ভালো। ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি কর্ষন।

এ বিষয়ে সংশয় নেই, বাণিজ্য কর্মে কৃষির চেয়ে দ্বিগুণ করে দেবেন ও কুসীদ কর্মে তিন গুণ। দেবেন। তবে এই সব কর্মে কোন দোষ হবে না।

গৃহস্থের বৃত্তি শিল ও উদ্ধৃত গৃহস্থের পোষণ করতে হয় বহু আত্মীয়। ঋত, অযাচিত ভেঘ্য কৃষি, বাণিজ্য এবং কুসীদ এই ছয় প্রকার ধর্ম দ্বারা তার জীবিকা নির্বাহ হয়। ধর্ম বিরুদ্ধ কাজ অবাঞ্ছনীয়। যজ্ঞ ও সৎ পাত্রের অর্থ দান করবে ব্রাহ্মণ সঞ্চয় করে।

ফলপ্রসূ দান হয় শ্রদ্ধার সঙ্গে সৎপাত্রে অর্থ প্রদান করলে, নিত্য নৈমিত্তিক ও কাম্য তিন প্রকার দান। বিমল হল চতুর্থ দান। নিত্য দান হল প্রত্যহ দেয় দান। গৃহস্থকে অল্প দান করলে মানুষের ফল হয় না। বৈশাখ মাসে পূর্ণিমায় জলপূর্ণ কুম্ভ ধর্ম রামের উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণদের দান করলে ভয় মুক্তি হয়।

জন্ম থেকে কৃত সকল পাপ থেকে নিস্তার পাওয়া যায় সাত বা পাঁচ সাত পাত্রে ব্রাহ্মণকে দান করলে। যে স্নান করে মহাদেবের আরাধনা করে, কৃষ্ণ চর্তুদশীতে ব্রাহ্মণ ভোজন করায়, সে আর জন্মায়। না।

অল্প দান করলে অব্যয় দান লাভ হয়। নরক ও পাপ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, হাতা ও পদ্ধেবন দান করলে। অক্ষয় ফলদান করে দেবালয়, নদ-নদীতে সৎ পাত্রে দান করলে। দান ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ধর্ম জীবের আর নেই।

 ঈশ্বর গীতা - কূর্ম পুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

তার পাপের বংশের সাত পুরুষ ধ্বংস হয় যে সম্মিহিত শ্রোত্রিয়কে অতিক্রম করে। তারা স্বর্গে যায় যারা অর্চি দান করে ও গ্রহণ করে ব্রাহ্মণ চাইতে পারেন বৃত্তি সঙ্কোচ কিন্তু চাইবেন না। সম্পদের আধিক্য যেন ব্যক্তি গৃহধর্মানুসারে অর্চনা করে, সে পুনর্জন্ম পায় না।

.

গৃহস্থ ধর্মের পর অগ্নিও ভতার ভার্য্যা যাবে বাণপ্রস্থে। আহার করবে পবিত্র ফলমূল। দেবতা ও অতিথির পূজা করবে রোজ, বেদ অধ্যয়ন করবে। বারবেলা প্রাণী হিংসা, কলহ, হতে হবে ভয়শূন্য। ব্রত নষ্ট হয় তার যে ব্যক্তি বনে গমন করে কামাতুর হয়ে পত্নীর সঙ্গে মিলিত হয়, তাকে মাটিতে শুতে হবে, সাবিত্রী মন্ত্র জপ করবে। গৃহশূন্য হয়ে থাকবে।

ধৈয্যশীল হয়ে গ্রীষ্ম উত্তাপে তপ্ত হবে, বর্ষায় বৃষ্টি ধারার মধ্যে দাঁড়াবে। হেমন্তে আর্দ্রবস্ত্র পরিধান করবে, সংযমী হবে ফল-মূলের অভাব হলে ভিক্ষা করবে। ভিক্ষা না পেলে গ্রাম থেকে শাল পাতায় আনা খাবার এক গ্রাস মাত্র খাবে। ব্রাহ্মময় হয়ে অনশন ব্রত কিংবা অগ্নি প্রবেশরূপ মৃত্যুর উপায় অবলম্বন করবে।

.

সন্ন্যাস অবলম্বন করবে। সকল বস্তুতে বিতৃষ্ণা জন্মালে, জ্ঞানী সন্ন্যাসী যে সকল বস্তুতে আসক্তি রহিত। বেদ সন্ন্যাসী বলা হয় বিজিতেন্দ্রিয় মুক্তিকামীকে। যে অহিংসা ব্ৰহ্মচৌর্য, ক্ষমা, দয়া ও সন্তোষ ব্রত পালন করে তবে তা যোগীর কর্তব্য হবে। প্রত্যহ বেদমন্ত্র জলরূপ বেদাধ্যায়ন করতে হয়, গায়ত্রী জপ করতে হয়, উভয় সন্ধ্যায় পরমেশ্বরের ধ্যান করতে হয়।

কমণ্ডলু ও ত্রিদণ্ড ধারণ করতে হয় এক বা দুই বস্ত্র পরিধান করে, পরম ব্রহ্ম লাভ হয় এসব করলে।

আশ্রম ধর্মে চিত্ত সমর্পণ করে সংযতাত্মা যোগীরা ভিক্ষালব্ধ বস্তু দ্বারা অথবা ফল-মূল দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করবে, সাত বাড়ি ভিক্ষা না পেলে আবার ভিক্ষা করবে। পাত্র ধুয়ে তাতে ভোজন করবে। নতুন পাত্রে প্রত্যহ ভক্ষণ করবে।

কামবশবত স্ত্রীলোকের সঙ্গে মিলিত হলে সান্তপণ প্রায়শ্চিত করতে হয়। ভিক্ষুদের ভিক্ষুর ভিক্ষা পাত্র ধরা উচিত না। শাস্ত্রে চুরির চেয়ে বড়ো অধর্ম নেই। চান্দ্রায়ন করবেন শাস্ত্রবিহিত বিধানানুসারে। পরম পদ প্রাপ্ত হবে সে যে নিজ আত্মাকে মহাদেব থেকে পৃথক দেখেন না।

.

ব্রাহ্মণ হিতের জন্য পাপ নাশের উপযোগী প্রায়শ্চিত্ত বিধি আছে। পাপ মুক্ত হয় প্রায়শ্চিত্ত করলে যে সজ্ঞানে টানা এক বছর পতিতের সঙ্গে এক যানে আরোহণ করে, শয্যায় উপবেশন করে সেও পতিত হয়, ব্রহ্ম হত্যাকারী যদি ব্রহ্মহত্যা পাপ থেকে নিষ্কৃতির জন্য, ব্রাহ্মণ বন্ধ, গোরুর কারণে প্রাণ ত্যাগ করে বা রোগগ্রস্থ ব্রাহ্মণকে রোগমুক্ত করে তবে ব্রহ্মহত্যা পাপ মুক্তি হয়। ব্রহ্মহত্যাকারী স্নান পূর্বক দেবতা ও পিতৃলোকের অর্চনা করলে পাপ মুক্ত হয়। এই পাপ থেকে মুক্তি হয় পিতৃলোকের তর্পণ করলে।

.

পাপবিনাশী পুণ্যকথা বলতে শুরু করলেন ব্রহ্মহত্যা প্রাণ নাশের জন্য পৃথিবীতে ব্রত প্রদর্শন করে সর্বদা ভিক্ষা করা ও দেব ব্রাহ্মণদের প্রতিষ্ঠা হয়।

কপর্দী বিশ্বেশ্বর বারাণসীতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মহত্যা হা হা শব্দে আর্তনাদ করে। ক্লিষ্ট হয়ে পাতালে প্রবেশ করে, যে জগৎকে অনিত্য বলে জেনে তীর্থে বাস করে সে পরমপদ লাভ করে।

অগ্নিবর্ণের সুরার দ্বারা শরীর দগ্ধ হলে পাপ মুক্ত হবে, কামাতুর হয়ে গুরুপত্নী গমন করলে লৌহস্ত্রী মূর্তি উত্তপ্ত করে আলিঙ্গন করবে। গুরুপত্নীগামী ব্যক্তি তিন বছর সর্বদা ব্ৰতী ও ব্রহ্মচারী হবে। অসতী স্ত্রী গমন করলে তিন রাত উপবাস করে শুদ্ধ হবে। ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র হত্যা করলে আট, ছয় ও তিন বছর ব্রহ্মহত্যা ব্রত করবে।

ব্রাহ্মণকে যা তোক কিছু দান করবে, অস্থি যুক্ত প্রাণী বধ করলে চন্দ্রায়ন করবে বা পরাব্রত করবে গোহত্যা করলে।

 ঈশ্বর গীতা - কূর্ম পুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

.

চন্দ্রায়ন করলে শুদ্ধ হবে স্ত্রী হরণ, পুরুষ হরণ বা কৃপে জল হরণ করলে, প্রজাপত্য করবে বিষ্ঠা, মূত্র, ও বীর্য ভক্ষণ করলেও, মহা সন্তাপন ব্রত করবে যে বাচ্চা মাংস খায়, ব্রাহ্মণ সুরা স্পর্শ করলে তিনবার প্রাণায়ম করে শুচি হবে। পেঁয়াজ ও রসুন ছুঁলে ঘৃত প্রাশন করলে শুচি হওয়া যায়। মানুষের অস্থি স্পর্শ করলে স্নান করে শুদ্ধ হবে।

পতিব্রতা স্ত্রীদের মাহাত্ম্য স্বরূপ রামায়ণ কাহিনি শ্রেয়। মহাদেব রাবণ বধের জন্যই সীতাকে সৃষ্টি করেন। সীতাকে রাম লক্ষণ রাবণের হাত থেকে উদ্ধার করার পরও তাকে অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয় এবং অগ্নিতে দ্বগ্ধ হয়ে যখন সে ফিরে এলেন তখন রামকে অগ্নি বললেন–সীতা যে দেবীর প্রিয়া পতিব্রতা, সুশীলা, সে সেবাপরায়ণা, ইনি পাপ শূন্য।

পাপকারী মানুষ যদি পুণ্যতীর্থে নিজ দেহ পরিত্যাগ করে তবে সকল পাপ মুক্ত হয়। যে ঈশ্বরতত্ত্ব জ্ঞানরূপ পরধর্ম স্থাপন করে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ লোক ইহজগতে নেই।

.

রোমহর্ষণ বললেন, ব্রহ্মা প্রমুখ মুনিরা পুরাণে বিবিধ তীর্থের কথা বলেছন পঞ্চযোজন বিস্তীর্ণ তীর্থের নাম প্রয়াগ। যা সকল পাপ নাশক এখানে স্নান করে বিষ্ণু পূজা করলে ও তার পর ব্রাহ্মণদের পূজা করলে বিষ্ণু লোকপ্রাপ্ত হয়। ব্রহ্মা প্রমুখ দেবতারা যার সেবা করে সেই তীর্থের নাম হল সপ্ত গোদাবর।

এখানে মহাদেবের পূজা করলে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়। উৎপত্তি, বিনাশ রহিত তিন তত্ত্বই পরব্রহ্মে অবস্থিত, মার্কণ্ডেয় মুনি এই তীর্থেই ভক্তি সহ রুদ্রের আরধনা করেছিলেন। এখানে জ্ঞানবান ব্রাহ্মণকে সেবা করলে সকল পাপ মুক্ত হয়।

.

রুদ্রকোটি হল পরমেষ্ঠী রুদ্রের ত্রিভুবন বিখ্যাত ও পবিত্র তীর্থ। মহেশ একসময় কালকে হত্যা করেছিলেন। তাকে হত্যা করায় ব্রহ্মা রুদ্রের কাছে গিয়ে কালকে বাঁচাবার বর চাইলেন, ব্রহ্মা জানলেন : যে দেবই তাকে পাপ কাজে নিযুক্ত করেছিলেন তাই তার কোন দোষ নেই। মহেশ তখন কালকে বাঁচিয়ে দিলেন।

.

মহালয় তীর্থে ত্রিপুরারি রুদ্র নাস্তিকদের নিদর্শন রূপে শিলা তলে নাশ করেছিলেন। সেখানে স্নান করে মহাদেবের পূজা করলে গণপতি পদ লাভ করা যায়। মগধারণ্য তীর্থ স্বর্গলোক প্রাপ্তি ঘটায়। শ্রীপর্বত হল তীর্থ সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র তীর্থ। আর এক শ্রেষ্ঠ তীর্থ ব্ৰহ্মতীর্থ। উমাতুঙ্গ তীর্থ ও ভঙ্গতুঙ্গ তীর্থ আছে। যেসব নদী সমুদ্রে পড়েছে তারা আর সকল সমুদ্র বিশেষভাবে পুণ্যজনক যেখানে মহাতীর্থ আর দেবালয় সর্বদা উপস্থিত।

.

দেবদারু বনে দেবতা ও সিদ্ধরা বাস করেন। সেখানে পূর্বে হাজার হাজার মুনি স্ত্রী-পুত্রদের সঙ্গে তপস্যা করেছিলেন।

ভগবান মহেশ নিজ মায়ায় জগৎ সৃষ্টি করে স্ত্রীবেশধারী হরির সাথে দেবদারু বনে বিচরণ করলেন, যে সব নারীরা মহাদেবের প্রতি মোহিত হল তারা পতিব্রতা বলে জ্ঞাত হল।

রুদ্রনারী ও কেশব পুত্রদের সেবিত করার জন্য মুনিরা ক্রুদ্ধ হল। তারা দণ্ড যষ্ঠি হাতে তাদের তাড়না করতে লাগলেন। মহাদেব তার লিঙ্গ স্থলন করলেন। পবিত্র অত্রি মুনির পত্নী অনুসয়া স্বপ্নে দেখলেন মহেশ নিজ তেজে বনকে উদ্দীপ্ত করছে। তখন মুনিরা ব্রহ্মাকে বললেন–এক সর্বাঙ্গ সুন্দরী ভার্যাকে নিয়ে এক উলঙ্গ পুরুষ দেবদারু বনে এসেছিল, তাদের তাঁরা বহু শাপ দেয় ও লিঙ্গ উৎপাটিত করেছেন।

ব্রহ্মা তখন তাদের মহাদেবের পরিচয় দিলেন। তখন মুনিরা ব্রহ্মার কাছে জানতে চাইলেন কিভাবে তারা আবার দেবের দর্শন পাবেন। ব্রহ্মা তাদের বললেন–কৃতঞ্জলি পুটে শূলপানির শরণাপন্ন হতে।

তারা কঠোর তপস্যা করলে ভগবান তাদের অনুগ্রহ করার জন্য জ্ঞান দান করলেন। এই রুদ্র মাহাত্ম্য পাঠ করে যে পরমা গতি প্রাপ্ত হয়।

.

যুধিষ্ঠির মার্কণ্ডেয় মুনির কাছে নর্মদার মাহাত্ম্য কথা শুনতে চাইলেন। মুনি বললেন–নর্মদা রুদ্রের দেহ থেকে নির্গত হয়েছে।

কমল তীর্থে গঙ্গা অতি পবিত্রা, কুরক্ষেত্রে সরস্বতী অতি পবিত্রা। এবং অরণ্য সর্বত্রই পবিত্রা। নর্মদার জল দর্শন করলেই পবিত্র হওয়া যায় রাজন, নিয়মানুসারে জিতেন্দ্রিয় হয়ে নর্মদায় স্নান ও একরাত্রি উপোস করলে শত কুল উদ্ধার হয়। শুদ্ধাচারী হয়ে যারা নর্মদায় প্রাণত্যাগ করে তাদের পুণ্যফলের কথা মুনি বললেন।

যে অপ্সরা আর দিব্যাঙ্গনাদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে এক লক্ষ বছর স্বর্গলোক সুখ ভোগ করে সে বিশেষ গন্ধে অনুলিপ্ত হয়ে সুখ ভোগ করে। যে ব্যক্তিকে সকল স্ত্রী লোক কামনা করে সে রাজরাজেশ্বর হয় ও সকল লোগ তার আয়ত্তে আসে।

নর্মদার দক্ষিণ কুলে অল্প দূরে অশ্বত্থ ও অর্জুন বৃক্ষে আচ্ছাদিত কপিলা মহানদ আছে। যা পবিত্র ও ত্রিলোক বিখ্যাত সেখানে একশো কোটির বেশি তীর্থ অবস্থিত নর্মদার জলের স্পর্শ পেয়ে পাপী পরম গতি লাভ করে।

যে অমর কণ্টক পর্বতে প্রাণ ত্যাগ করে সে শতকোটি বর্ষের কিছু বেশি কাল রুদ্রলোকে বাস করে। কাবেরী নামে পাপনাশিনী বিখ্যাত নদী আছে তাতে স্নান করে মহাদেব বৃষকেতনের অর্চনা করবে। কাবেরী ও নর্মদার সঙ্গমে স্নান করলে রুদ্রলোক লাভ হয়।

.

শ্রেষ্ঠা ও সর্ব পাপ নাশিনী হল নর্মদা। নর্মদা উত্তরকুলে ভদ্রেশ্বর নামে শুভদায়ক পুণ্যতীর্থ আছে। সেখানে স্নান করলে মানুষ দেবসুখ প্রাপ্ত হয়। নর্মদায় শুক্লতীর্থের সমান আর কোন তীর্থ নেই। এই তীর্থক্ষেত্রে স্থিত বৃক্ষের অগ্রভাগ দর্শন করলে ব্রহ্মহত্যার পাপ নাশ হয়।

মানুষ প্রথম বয়সে পাপ করে এই তীর্থে অহোরাত্র উপবাস করলে সকল পাপ নষ্ট হয়। এরপর ইল উত্তম সমতীর্থ। তারপর কেশ্বর তীর্থ ও তারপর নন্দী তীর্থ।

এরপর আলবচ নামে শুভ তীর্থ। এখানে যে নিজ অস্থি নিক্ষেপ করে সে ইহলোকে ধনভোগ করে আর রূপবান হয়। এরপর গঙ্গেশ্বর তীর্থ। এখানে মানুষ কামনা নিয়ে স্নান করলে আজন্মকৃত পাপ মুক্ত হয়।

. ঈশ্বর গীতা - কূর্ম পুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

এরপরের শ্রেষ্ঠ তীর্থ হল ভৃগুতীর্থ, এই ক্ষেত্রে সকল পাপ নাশ করে। মানুষ উপবাস করে এই তীর্থে স্নান করলে কাঞ্চন বিমানে আরোহণ করে ব্রহ্মলোকে যায় ও পূজা পায়।

এরপর হংস তীর্থ বরাহতীর্থ, পিতামহ তীর্থ, সবিত্রী তীর্থ, মনোহর তীর্থ, কল্প তীর্থ, স্বর্গ সঙ্গম তীর্থ। এরপর নর্মদা সাগরের সঙ্গম রূপে তীর্থে স্নান করলে মানুষ অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ করে। এরপর উত্তম অলকা তীর্থ। এখানে নিয়ম পালন করে ও পরিমিতাহারী হয়ে অহোরাত্র উপবাস করলে ব্রহ্মহত্যা পাপ মুক্ত হওয়া যায়।

তীর্থের সংখ্যা বিস্তৃত ভাবে বলা যায় না। পবিত্রা, বিপুল, ত্রিলোক বিখ্যাত ও মহাদেব প্রিয়া শ্রেষ্ঠা নদী নর্মদা এই বিষয়ে সংশয় নেই। নর্মদাকে মনে মনে স্মরণ করলে শত চান্দ্রায়নের বেশি ফল পাওয়া যায়। ঘোর নাস্তিক মানুষ ভয়ানক নরকে পতিত হয়। মহেশ্বর নর্মদাকে স্বয়ং নিত্য সেবা করে থাকেন।

.

ত্রিলোক বিখ্যাত নৈমিষ তীর্থ মহাদেবের খুবই প্রিয় এবং মহাপাতক নাশকারী। মহাদেবের দর্শনকারী মুনিরা এই তীর্থে তপস্যা করেছেন, মরিচী, অত্রি, বশিষ্ঠ, ক্রেতু, ভৃগু আর অঙ্গিরার বংশোদ্ভূত মহর্ষিরা

সূর্যাকালে সর্ব বরদাতা বিশ্বকর্তা চতুর্মুতি চতুর্মুখ কমলযোনি অব্যয় ব্রহ্মার কাছে গিয়ে তাকে প্রণাম করেন। অসংখ্য সিদ্ধ ও চারণগণ এখানে বাস করেন। এই নৈমিষ ক্ষেত্রে ভগবান শম্ভুর স্থান। এখানে পূর্বে সত্ৰ উপাসনারত মহর্ষিদের কাছে ভগবান ব্রহ্মভাবিত ব্রহ্মাণ্ড পুরাণটি বলেন। এখানে নর্মদা নদীর রুদ্রমন্ত্র জপ করেছিলেন ধর্মজ্ঞ ঋষি শিলাদ্ধ।

.

জাপেশ্বর তীর্থের কাছে সব পাপ নাশক অতি পবিত্র পঞ্চনদ নামক শ্রেষ্ঠ তীর্থ আছে। রুদ্রালোকে সম্মানিত হওয়া যায় এখানে ত্রিরাত্র উপবাস করে মহেশ্বরের পূজা করলে মহাপাপ নাশক নামক এক শ্রেষ্ঠ তীর্থ আছে অমিত তেজা শুক্রের মহাভৈরব নামে মানুষ ব্রহ্মলোকে সম্মানিত হয়। সেখানে দেহত্যাগ করলে রুদ্রলোকে যায় প্রাণ ত্যাগকারী ব্যক্তি।

অতি গোপনীয় নকুলেশ্বর নামে বিখ্যাত একটি শ্রেষ্ঠ তীর্থ আছে, সেখানে শ্রীমান ভগবান বাস করেন। এখানে দেবীর সাথে মহাদেব সর্বদা বিরাজ করেন। এখানে পূজা করলে ব্রহ্মহত্যা পাপ মুক্ত হওয়া যায়। চন্দ্রভাগা নদীর সঙ্গমস্থলে পাপ নাশ হয়। কোটি অযুত তীর্থেরও বেশি ফলদায়ক।

বারাণসী নামে দিব্যধাম এই সব প্রধান প্রধান তীর্থ মানুষের পাপহরা যে তীর্থ সেবা করে না, নিজ ধর্ম ত্যাগ করে, সে ইহলোক বা পরলোকে তীর্থ ফল লাভ করতে পারে না। ঋণ থেকে মুক্ত হয়ে, পুত্রদের জীবন ঠিক করে দিয়ে, পুত্রদের ওপর স্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে তীর্থ সেবা করতে হয়। যে ব্যক্তি এই পাঠ ও শ্রবণ করে সে সব পাপ মুক্ত হয়।

.

পুরাণ শাস্ত্রে বলা আছে নিত্য, নৈমিত্তিক, প্রাকৃত ও অত্যন্তিক–এই চার রকম প্রলয়ের কথা। নিত্য প্রলয় হল ভূতের লয়। নৈমিত্তিক প্রলয় হল তিনলোকের প্রলয়। প্রাকৃত প্রলয় হল এটি তত্ত্বজ্ঞান উৎপন্ন হওয়ার জন্য, যোগীরা যখন পরমাত্মায় লয় পান তখন হয় আত্যন্তিক প্রলয়। এ কথা কালচিন্তাপরায়ণ দ্বিজগণ বলেন।

প্রলয় কাল উপস্থিত হয় চার হাজার যুগ কেটে গেলে। প্রজাপতি তখন সকল প্রজাকে আত্মগত করতে চান। তারপর সকল ভূতের ক্ষয়কারী ও সকল জীবের ভয় উৎপাদক প্রবল অনাবৃষ্টি হয় একশো বছর ধরে। এরপর সূর্য ওঠেন, সাত রশ্মিকে পূর্ণভাবে প্রকাশ করে সমস্ত রশ্মি চারা জল পান করেন। এই সময় তার তেজ কেউ সহ্য করতে পারে না।

জল পান দ্বারা প্রদীপ্ত হয়ে সাত কিরণ সাত সূর্যের আকার পায়। তখন সাত কিরণ চারদিকের জল শুষে নিয়ে বহ্নির মতো চার লোককে দগ্ধ করতে থাকে। সমস্ত জগৎ সূর্যরশ্মির মালায় পূর্ণ হওয়ার জন্য অম্বরীয় অর্থাৎ ভাজবার খেলার মতো দেখায়। মাটিতে মিশে যায়। পাতাল আর মহাসমুদ্রে যে প্রাণীরা থাকে তারাও তখন সূর্যের আগুনে প্রনীল হয়।

সমুদ্র, নদীতে ও পাতাল থেকে সব জল শুষে নিয়ে প্রদীপ্ত হয়ে অগ্নি পৃথিবীকে আশ্রয় করে জ্বলতে থাকে। পৃথিবীর আধোভাগ দগ্ধ করে তা ঊর্ধ্বদিকে আকাশ মণ্ডলকে দগ্ধ করতে প্রবৃত হয়। এই মহাবহ্নির শিখা অযুত যোজন উত্থিত হয়। ঘোর সংবর্তক মেঘসমূহ এই সময়ে বিদ্যুৎপুজ্ঞেও অলকৃত হয়ে বিশাল হস্তীদের মতো গর্জন করতে করতে আকাশে আবির্ভূত হয়।

এই মেঘগুলি সপ্ত সূর্যের অগ্নিকে শান্ত করে। অতিরিক্ত বর্ষণে অগ্নির বিনাশ হলে স্বয়ম্ভু প্রেরিত প্রলয়কালীন মেঘেরা বারি ধারায় জগৎকে পূর্ণ করে, সেই উপছে পয়ড়া জলে সমুদ্রের বেলাভূমির প্লাবিত হওয়ার মতো বিপুল বর্ষণে সকল জগৎ প্লাবিত হয়ে যায়। নিজেদের বেলাভূমিতে অতিক্রম করতে থাকে।

তাতে সমগ্র পর্বত ও পৃথিবী জলমগ্ন হয়। স্থাবর জঙ্গম বিনষ্ট হলে ভগবান জগৎপতি যোগনিদ্রা আশ্রয় করে ঘোরতর অর্ণবে শয়ন করেন। চার হাজার যুগ ব্যাপ্ত করে যে সময় তাকেই পণ্ডিতেরা কল্প বলেছেন।

এমন চলেছে বরাহ কল্প বেদবিদ মুনিরা পুরাণে বলেছেন যে কল্প অসংখ্য এবং সে সবই ব্ৰহ্ম বিষ্ণু শিবাত্মক। সাত্ত্বিক কল্প আছে সে সবেতেই বিষ্ণু মাহাত্ম্যই প্রধান। জগৎ একটি মাত্র সমুদ্রে পরিণত হলে একমাত্র মায়াময় তত্ত্ব অবলম্বন করে যোগনিদ্রায় মগ্ন হয়। মহেশ্বর নিদ্রার সময়ে সাত মহর্ষি জনলোকে বিদ্যমান থেকে যোগনেত্রে আমাকে দেখেন।

তিনি আদিত্যবর্ণ ভুবনের রক্ষিভুক ও যোগমূর্তি, পুরুষ নারায়ণ যোগিরা যোগনিষ্ঠ হলে তবেই দেখতে পান, আত্মজ্ঞান উৎপন্ন হলে তবেই তারা আমার এই রকম তত্ত্ব জানতে পারেন।

কূর্মদেবতা এবার প্রাকৃত প্রলয়ের কথা বললেন। ব্রহ্মার পরমায়ুর পূবাধ ও পরার্ধ কেটে গেলে সকল লোকের লয়কারী কালাগ্নি জগৎকে ভস্মসাৎ করতে প্রবৃত্ত হন। ভগবান সৌরমণ্ডলে প্রবেশ করে তাকে নানা রূপ ধারণ করেন এক সূর্য রূপ ধারণ করে লোক দগ্ধ করেন।

বেদজ্ঞরা বলেছেন, সকল দেবতা দগ্ধ হয়ে গেলে কেবল দেবী পার্বতী সাক্ষী রূপে শম্ভুর কাছে বর্তমান থাকে। দেবী পতির পরম সঙ্গময় নৃত্যের অমৃত পান করে যোগ অবলম্বন পূর্বক দেব ত্রিশূলীর দেহে প্রবেশ করেন। ভগবান স্বেচ্ছায় নৃত্য পরিত্যাগ করে নিজ ভাবে ফিরে আসেন।

এভাবে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর বিনষ্ট হলে পৃথিবী সকল গুণের সঙ্গে জলে বিলয় প্রাপ্ত হয়। জল নিজের গুণ নিয়ে অগ্নিতে লয় প্রাপ্ত হয়, অগ্নির কাছে বর্ণনা করা হয় কূর্মপুরাণ বলেছেন স্বয়ং কূর্মরূপী গদাধর। প্রজাপতিদের সৃষ্টি বর্ণ, ধর্ম, বর্ণের জীবিকা ধর্ম অর্থ, কাম মোক্ষের যথাবিধি লক্ষণ বলা হয়েছে।

বর্ণিত হয়েছে ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বরের একত্ব, পৃথকত্ব, তাদের বৈশিষ্ট ভক্তের লক্ষণ ও অনুষ্ঠান যোগ্য আচারের কথা বলা হয়েছে এবং বর্ণাশ্রমের লক্ষণের কথা বলা হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে আদি সৃষ্টি, তারপর অন্তের মহৎ তত্ত্ব প্রভৃতি সাত আচরণের কথা ও হিরণ্যগর্ভের সৃষ্টির কথা।

কাল সংখ্যা, ঈশ্বর মাহাত্ম ব্রহ্মার জলে শয়ান ভগবানের নাম নির্বাচন, বিষ্ণু, বরাহমূর্তি ধারণ করে পৃথিবীর উদ্ধার সাধন, প্রথমে মুখ্য প্রভৃতি স্বর্গ তারপর মুনিস্বর্গ রুদ্রস্বর্গ, তাপস ঋষি, স্বর্গ এবং তামস স্বর্গের আগে ধর্মের প্রজা সৃষ্টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

পরস্পরের দেহ মধ্যে প্রবেশ ও ব্রহ্মা বিষ্ণুর বিবাহ পদ্ম থেকে ব্রহ্মর উৎপত্তি, ধীমান ব্রহ্মার মোহ ও মহেশ্বর দর্শন মহেশ্বরের কীর্তি ও মহাত্ম। বিষ্ণুর দ্বারা দিব্য দৃষ্টি প্রদান পরমেষ্ঠী ব্রহ্মাকে তার কৃত দেবদেবের স্তব মহাদেবের প্রসাদ ও বরদান, বিষ্ণুর সঙ্গে শঙ্করের কথোপকথন, পিনাকীর বরদান ও অন্তর্ধান বর্ণিত হয়েছে।

দেব মহেশ্বরের অন্তর্ধান, অন্ত থেকে জাত ব্রহ্মার তপস্যা, ও দেবদেবের দর্শন, মহাদেবের অর্ধনারীশ্বর রূপ, দেবীর সঙ্গে পিনাকীর বিভাগ ও দেবীর দক্ষকন্যারূপে উৎপত্তি বর্ণিত হয়েছে।

মুনিরা দেবীর হিমালয় কন্যারূপে জন্মগ্রহণ ও দেবী মাহাত্ম্য, মাতা ও পিতার দ্বারা দেবীর দিব্য ও বিশ্বরূপ দর্শন, দেবীর সহস্ৰনামে কথন, পিতা হিমালয়ের দ্বারা দেবীর উপদেশ ও বরদান বর্ণিত হয়েছে। হিমালয়ের প্রতি ভৃগু প্রভৃতির প্রজাসৃষ্টি ও রাজবংশ বিস্তার, প্রচেতাদের পুত্র রূপে দক্ষের জন্ম, দক্ষ যজ্ঞ নাশ, দধীচী ও দক্ষের শাপ সবকিছুর কথা বলা হয়েছে।

রুদ্রের আগমন দক্ষের গৃহে প্রসন্নতা পিনাকীর অন্তর্ধান, এবং রক্ষণের জন্য দক্ষের প্রতি পিতামহের উপদেশ বর্ণিত হয়েছে। এরপর বলা হয়েছে অনন্তর দক্ষের প্রজাসৃষ্টি, হিরণ্যকশিপু ও হিরণ্যাক্ষের নিধন, দেবদারু বনে বাসকারী মুনিদের প্রতি গৌতম ঋষির অভিশাপ।

 ঈশ্বর গীতা - কূর্ম পুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

এরপর কথিত হয়েছে কালাগ্নি রুদ্রের দ্বারা অন্ধকের নিগ্রহ ও তাকে শ্রেষ্ঠ দানপত্য পদে নিয়োগ। বিষ্ণুর দ্বারা প্রহ্লাদের নিগ্রহ, বলিবন্ধন, বামনের দ্বারা বানাসুরের নিগ্রহ, মহাদেবের দ্বারা শিবের প্রসন্নতা বর্ণিত হয়েছে তার প্রতি।

তার পরে ঋষি বংশবিস্তার, রাজবংশ বিস্তার, বসুদেব থেকে ভগবান বিষ্ণুর স্বেচ্ছায় উৎপত্তি, কীর্তিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা উপমন্যুর দর্শন, তার উপদেশ, তপশ্চরণ, ত্রিলোচন মহাদেবের সাক্ষাৎ লাভ, জগদম্বার সঙ্গে বর লাভ।

তাদের কাছে শাঙ্গধন্বা কৃষ্ণের কৈলাসে গমন, কৈলাসে বাস, দ্বারবতী নিবাসীদের ভয়, দ্বারবতীর রক্ষণ, মহাবল শত্রু দেব পরাজিত করে গরুড়ের দ্বারা–এসব কথাও বলা হয়েছে।

নারদের দ্বারকায় আগমন। গরুড়ের কৈলাস যাত্রা, কৃষ্ণের দ্বারকায় আগমন, মুনিদের আগমন, বাসুদেবের নৈতিক বর্ণ ও শিবলিঙ্গের পূজা এবং মার্কণ্ডেয়র প্রশ্ন বর্ণিত হয়েছে।

তারপর মার্কণ্ডেয়র প্রতি শ্রীকৃষ্ণের লিঙ্গার্চানার জন্য লিঙ্গী ও লিঙ্গের মাহাত্ম্য বর্ণনা, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর লিঙ্গ থেকে ভয় ও মোহ লিঙ্গের সীমা জানাবার জন্য ব্রহ্মার ঊর্ধ্ব গমন ও বিষ্ণুর নিম্নভাগে গমন,

ব্রহ্মাণ্ড বিষ্ণুর দ্বারা মহাদেবের স্তব ও তাদের প্রতি ভগবানের প্রশ্ন এবং লিঙ্গের অন্তর্ধানের কথা বলা হয়েছে। ব্রাহ্মণগণ, তারপর সম্বর উৎপত্তি অনিরুদ্ধর উৎপত্তি, কৃষ্ণের নিজ স্থানে গমনের ইচ্ছা, ঋষিদের দ্বারকায় আগমন ও তাদের প্রতি কৃষ্ণের অনুশাসন এবং মহাত্মদের প্রতি বরদান কীর্তিত হয়েছে। কৃষ্ণের পরম স্থানে গমন অর্জুনের কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ দর্শন, তার দ্বারা কথিত সনাতন যুগ ধর্মগুলির কথা এবং পার্থের প্রতি ব্যাসের অনুগ্রহের কথা বলা হয়েছে।

বারাণসীতে পরাশর তনয়, অদ্ভুত কালরূপী ব্যাসের গমন, বারাণসী মাহাত্ম্য ও তীর্থ বর্ণনা, ব্যাসের তীর্থ যাত্রা, দেবী দর্শন, দেবীর দ্বারা বারাণসী থেকে ব্যাসের বাসস্থানের উচ্ছেদ, ব্যাসের প্রতি দেবীর বরদান এ কথাও বলা হয়েছে।

যুধিষ্ঠিরের কাছে মার্কণ্ডেয় সেখানে স্থিত পুণ্যক্ষেত্রের বর্ণনা, তীর্থফল বর্ণনা এবং বলা হয়েছে। মার্কণ্ডেয় প্রস্থানের কথা।

তারপর ভূবন স্বরূপ, গ্রহসন্নিবেশ, বর্ষ ও নদীর নির্ণয়। পর্বত সংস্থান, দেব বাসস্থান, দ্বীপ সমূহের বিভাগ শ্বেত দ্বীপের বর্ণনা, কেশবের শয়ন। অনন্ত শয্যার ভগবানের মাহাত্ম্য মনুদেব অধিকার, বিষ্ণুর মাহাত্ম্য এ সবও বলা হয়েছে।

শ্রেষ্ঠ মুনিগণ বেদশাখা প্রণয়ন বৈবস্বত মনুর অধিকারে আটাশটি যুগে আটাশজন ব্যাসের বৃত্তান্ত কথিত হয়েছে ঈশ্বরের নানা গোপনীয় গীতা কীর্তিত হয়েছে, তারপর বর্ণাশ্রমের আচার প্রায়শ্চিত্য বিধি সেই প্রসঙ্গে রুদরের কাঁপালী হওয়ার বৃত্তান্ত ও তার ভিক্ষাচরণ পতিব্রতার কথা।

তীর্থের নির্ণয় ও মহাদেবের দ্বারা মঙ্কনক মুনির নিগ্রহ কথিত হয়েছে সংক্ষেপে বলা হয়েছে শম্ভুর দ্বারা কালের নিধনের কথা তারপর যথাক্রমে বলা হয়েছে নৈমিত্তিক প্রলয় প্রাকৃত প্রলয় ও সবীজ যোগের বিষয় বস্তু এভাবে সংক্ষেপে জেনে যে ব্যক্তি পাঠ করে সে সব পাপ মুক্ত হয়ে ব্রহ্মলোকে বাস করে।

নৈমিত্তিক প্রলয়, প্রাকৃত প্রলয় ও সবীজ যোগের কথা বলা হয়েছে। কূর্ম পুরাণের বিষয়বস্তু এভাবে সংক্ষেপে জেনে যে ব্যক্তি এটি পাঠ করে সে সর্বপাপামুক্ত হয়ে ব্রহ্মলোকে বাস করে।

ভগবান পুরুষোত্তম কৃর্মরূপ ত্যাগ করে দেবী কমলাকে নিয়ে স্বস্থানে প্রস্থান করলেন। সকল দেবতা আর মুনিরা পুরুষোত্তম দেবকে প্রণাম করে অমৃত গ্রহণ পূর্বক নিজ নিজ স্থানে ফিরলেন।

ভগবান বিষ্ণু নিজে বলছেন, এই শ্রেষ্ঠ পুরাণ দেবদিদেব বিষ্ণুর উৎপত্তি স্থান, যে নিয়ম যুক্ত হয়ে ভক্তি সহকারে নিয়মিত পুরাণ পাঠ করে সে সকল পাপ মুক্ত হয়ে ব্রহ্মলোকে বাস করে। এই পুরাণ যে ব্যক্তি বৈশাখ বা কার্তিক মাসে লিপিবদ্ধ করে বেদবিদ ব্রাহ্মণকে দান করে তার পুণ্য কাহিনি হল– সেইসকল মানুষ পাপ মুক্ত ও সকল ঐশ্বর্য মণ্ডিত হয়ে মানুষ স্বর্গে মনোরম বিপুল সুখ অনুভব করে থাকে।

তারপর স্বর্গভোগ শেষ হয়ে গেলে ঐ ব্যক্তি ব্রাহ্মণকুলে জন্ম গ্রহণ করে ও পূর্বের সংস্কার বশতঃ জ্ঞান লাভ করে সকল পাপ মুক্ত হয়। এই পুরাণের এক অধ্যায় পাঠ করলে তার পরম পাদলাভ করে, যে সম্যক ভাবে এর অর্থ বিচার করতে পারে যে ব্রাহ্মণগণ, মহাপাতকনাশী এই পবিত্র পুরাণ প্রতি পর্বদিকে ব্রাহ্মণদের পাঠ করা ও শ্রবণ করা উচিত।

একদিকে সমস্ত পুরাণ আর ইতিহাস এবং অন্যদিকে কেবল এই কূর্মপুরাণ রাখলে এই কূর্মপূরাণের দিকটিই বেশি ভারী হয়। পুরাণ ছাড়া অন্য সাধন নেই। ধর্মনৈপুণ্যকামী এবং জ্ঞানা নৈপুণ্যকামী এই দু’প্রকার ব্যক্তির পক্ষে অন্য কোন পুরাণে ভগবান নারায়ণ বিষ্ণুর কথা সেভাবে কীর্তন করা হয়েছে।

এই পৌরাণিক ব্রাহ্মী সংহিতা সর্বপাপনাশিনী কারণ এই সংহিতায় পর ব্রহ্মের কথা যথার্থ ভাবে বলা হয়েছে। এই ব্রাহ্মী সংহিতা তীর্থের মধ্যে পরম তীর্থ, তপস্যার মধ্যে পরম তপস্যা, জ্ঞানের মধ্যে পরম জ্ঞান ও ব্রতের মধ্যে পরমব্রত, এই শাস্ত্র পাঠ করা উচিত নয়। শূদ্রের সে বাহুকে নরকে গমন যে এইটি মোহগ্রস্থ হয়ে পাঠ করে।

এটি শ্রবণ করবেন শ্রাদ্ধে বা দেবকার্যে দ্বিজগণ নিমন্ত্রিত ও ব্রাহ্মণদের যজ্ঞশেষেও এই সর্বদোষ নাশক শাস্ত্র শ্রবণ করানো উচিত। এই শাস্ত্র জেনে ব্যক্তি ভক্তিমান ব্রাহ্মণদের বিধানানুসারে শ্রবণ করান সে সকল পাপ মুক্ত হয়ে ব্রহ্ম সাযুজ্য লাভ করেন।

যে ব্যক্তি শ্ৰাদ্ধারহিত বা অধার্মিক পুরুষকে এই শাস্ত্র শ্রবণ করায়, সে পরলোকে নরকে যায়, তারপর পৃথিবীতে কুকুর হয়ে জন্মগ্রহণ করে। জগৎযোনি সনাতন বিষ্ণু, হলি ও কৃষ্ণদ্বৈপায়নকে নমস্কার করে এই পুরাণ শাস্ত্র অধ্যায়ন করতে হয়। এ হল অমিততেজি দেবদেব বিষ্ণুর আদেশ। পরাশর তনয় মহাত্মা ব্যাসেরও এই আদেশ।

ভগবান নারদ ঋষি নারায়ণের মুখে এই পুরাণ শ্রবণ করে গৌতমকে দান করেছিলেন। গৌতমের কাছ থেকে এটি পরাশর পেয়েছিলেন। মুনিগণ, ভগবান পরাশর ধর্ম-অর্থ-কাম-ও মোক্ষ প্রদায়ক এই পুরাণ গঙ্গাদ্বারে মুনিদের কাছে বলেছিলেন।

ব্রহ্মা আপনি, সনক ও সনৎকুমারের কাছে বলেছিলেন সর্ব পাপনাশক পুরাণ সনকের কাছ থেকে শ্রেষ্ঠ যোগবিদ ভগবান দেবল মুনি আর দেবল মুনির কাছ থেকে এই শ্রেষ্ঠ পুরাণ পঞ্চাশতম মুনি জেনেছিলেন।

 ঈশ্বর গীতা - কূর্ম পুরাণ - পৃথ্বীরাজ সেন

সনৎকুমারের কাছ থেকে সত্যবতী পুত্র ভগবান বেদব্যাস মুনি ও সবার্থ সংগ্রহরূপ পরম পুরাণ লাভ করেছিলেন পরে বেদব্যাসর কাছে শ্রবণ করে এই পাপনাশক পুরাণ কীর্তন করলাম এই পুরান ধার্মিক বাক্তির কাছে প্রকাশ করবেন।

নারায়ণাত্মা সমগুণের আস্পদ পরাশরনন্দন, সর্বজ্ঞ, মহর্ষি গুরু বেদব্যাসকে প্রণাম, যার থেকে সমগ্র জগতের উৎপত্তি যার মধ্যে সকল জগৎ বিলীন হয়ে যায়, সেই কূর্মরূপী পরমেশ্বর বিষ্ণুকেও প্রণাম।

আরও পড়ুনঃ

আর্যদের ভারত জয়ের কাহিনী : রামায়ণ | ড: এম আর দেবনাথ

 

Leave a Comment