যজ্ঞের বদলে তীর্থ নিয়ে ড: আর এম দেবনাথ তার সিন্ধু থেকে হিন্দু বইএ লিখেছেন : যজ্ঞ দিয়ে মানুষের শুরু, মৃত্যুতে তার পরিণতি। কিন্তু এ পরিণতিই শেষ কথা নয়, কারণ মানুষ বিশ্বাস করে মৃত্যুর পরেও আর এক জগত আছে। এ জগত সম্বন্ধে তার কোনো ধারণা নেই। ধারণাতীত জগত তাই তার কাছে এক কল্পলোক। এখানে সে বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল, যুক্তি নয়। মানুষ মনে করে মৃত্যুর মাধ্যমে সে প্রকৃতপক্ষে ইহলোক থেকে পরলোকে যায়। এটা তার কাছে ‘দেহান্তর’। কৃতকর্মের বলে সে আবার জগতে ফিরে আসে। হিন্দু ও বৌদ্ধরা একেই বলে ‘জন্মান্তরবাদ’। অন্যরা অবশ্য বিশ্বাস করে শেষবিচারে (ফাইন্যাল জাজমেন্ট)। এর জন্য মৃত্যুর পর অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু লক্ষণীয় উভয়ক্ষেত্রেই মানুষের কামনা চূড়ান্ত মুক্তি, ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ বা স্বর্গলাভ।

স্বর্গবাস বা ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের ব্যবস্থা হিসেবে ধর্মীয় অনেক বিধান আছে। এর মধ্যে তীর্থ একটি। তীর্থে মুক্তি অথবা তীর্থে স্বর্গপ্রাপ্তি, এই হচ্ছে মানুষের বিশ্বাস। তাই সকল ধর্মের ক্ষেত্রেই তীর্থ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তীর্থ আবার যুক্ত একটি স্থানের সাথে। তাই তীর্থ ও তীর্থস্থান অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ বৌদ্ধধর্মালম্বীদের কাছে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী ও তাঁর স্মৃতি বিজড়িত ‘বুদ্ধগয়া’ পবিত্র তীর্থস্থান। খ্রিস্টানদের কাছে জেরুজালেম পবিত্র নগরী। একইভাবে মুসলমানদের কাছে মক্কা ও মদীনা পবিত্রতম নগরী ও তীর্থস্থান। এর বিপরীতে হিন্দুদের তীর্থস্থান অসংখ্য। সারা ভারত ও এই উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে তাদের তীর্থস্থান। একটির গুরুত্ব আর একটি থেকে কম নয়। এখন প্রশ্ন : ধর্মীয় ঐতিহ্য হিসেবে এই গুরুত্বপূর্ণ তীর্থের ব্যবস্থা কি হিন্দুদের মধ্যে অনাদি কাল থেকে প্রচলিত?
হিন্দুর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এই তীর্থের ধারণাটি অনাদি কাল থেকে চালু নয় । ড. সুকুমারী ভট্টাচার্য্যের মতে (দি ইণ্ডিয়ান থিয়গনি : ব্রহ্মা, বিষ্ণু এ্যাগু শিব: পেঙ্গুইন বুকস : ২০০০) আর্যদের মধ্যে চালু যজ্ঞের পরিবর্তেই তীর্থের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা জানি পুরাকালে আর্যরা যজ্ঞ করত। একসময় এই যজ্ঞ এক বীভৎস রূপ নেয়। নানা ধরনের যজ্ঞের মাধ্যমে আর্যরা নির্বিচারে পশু হত্যা শুরু করে। পুরাণ কাহিনীগুলোতে বর্ণিত এসব যজ্ঞের বিবরণ পড়লে গা শিউড়ে ওঠে। যজ্ঞের বলি পশুর রক্ত ও চামড়া থেকে নির্গত রসে দেশ ভেসে যায়। কথিত আছে যে, উত্তরভারতের বর্তমান অভিশপ্ত চম্বল নদী (পূর্বতন চর্মগতি নদী) পরীক্ষিত নামে এক রাজা কর্তৃক সম্পাদিত যজ্ঞের পশু রক্তেই সৃষ্ট হয়েছে।

বর্বরোচিত এ ধরনের পশু হত্যার ফলে ভূমিপুত্রদের কৃষি কাজের অশেষ ক্ষতি হয়। কারণ আমরা জানি কৃষি কাজের জন্য পশু অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। একটি গরু হারালে বা চুরি হলে কৃষক পাগল প্রায় হয়ে গরুর খোঁজে বের হয়। এর থেকেই একটি শব্দ অর্থাৎ গবেষণা (গো + এষণা) শব্দের উৎপত্তি। এ প্রেক্ষাপটে কৃষক গরুকেও পূজা করে। এমন একটি প্রয়োজনীয় পশু যখন নির্বিচারে হত্যা করা হয় তখন সমাজের প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। বলা বাহুল্য আর্যদের এই বর্বরতায় সমাজে সেই তীব্র প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি হয়
যজ্ঞের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল হিসেবেই আমরা গৌতম বুদ্ধকে পাই। তিনি যজ্ঞ বিরোধী অবস্থান নেন। তিনি সকল প্রাণীর মঙ্গলের কথা প্রচার করতে গিয়ে বললেন : অহিংসা পরম ধর্ম। বুদ্ধের যজ্ঞ বিরোধী এই আন্দোলন ধর্মে রূপ নেয়। যজ্ঞ পড়ে যায় পেছনে। গুপ্ত যুগে (মোটামুটি ৩০০-৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) অবশ্য আবার তার প্রাদুর্ভাব ঘটে। কালিদাসের সাহিত্যে যজ্ঞের প্রচুর উল্লেখ পাওয়া যায় (সুকুমারী ভট্টাচার্য : প্রাচীন ভারত-সমাজ ও সাহিত্য: আনন্দ পাবলিশার্স তৃতীয় সংস্করণ: ১৪০১)। কিন্তু লক্ষণীয় যজ্ঞ জনপ্রিয় হয় না। আর্যরা তখন বেসামাল হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত পৌরাণিক আমলেই যজ্ঞের বিকল্প হিসেবে তীর্থের ব্যবস্থা করা হয়। এ লক্ষ্যে পুরাণগুলোকে পুনর্বিন্যাসিত করা হয়। তীর্থের সাথে যুক্ত করা হয় উপবাস, তর্পন ও দান ইত্যাদি কর্ম।
Table of Contents
[ যজ্ঞের বদলে তীর্থ ]
তর্পনাদির ব্যবস্থা করতে গিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্যরা অবশ্য একটি কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। তারা দান ও তর্পনে ব্রাহ্মণদেরকে যুক্ত করে। তীর্থস্থান দর্শনকালে ব্রাহ্মণদের দান-দক্ষিণা করলে আত্মার মুক্তি ঘটে বলে ব্রাহ্মণরা নানাভাবে প্রচার চালায়। পুরাণ কাহিনীগুলোতে বলা হয়। যজ্ঞে যে পুণ্য, তীর্থেও একই পুণ্য। ড. ভট্টাচার্যের মতে এই প্রেক্ষাপটেই হিন্দুদের মধ্যে তীর্থের ধারণা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। পাশাপাশি অবশ্য কালক্রমে তীর্থস্থানগুলোতে দান ও তর্পনের বদৌলতে গড়ে ওঠে এক পরজীবী শ্রেণি। এদের নাম ‘পাণ্ডা’। বর্তমানকালে ধর্মের নামে এদের উৎপাত অসহনীয়। বলা বাহুল্য এটাই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মহিমা!

লক্ষণীয় তীর্থ ব্যবস্থার সাথে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য বজায় রাখার ব্যবস্থা করা গেলেও, তীর্থস্থানগুলো চিহ্নিত করতে গিয়ে তাদের হার মানতে হয় ভূমিপুত্রদের কাছে। এ ক্ষেত্রে তাদের বিশ্বাসই হয়ে ওঠে প্রবল। ফলে ‘হিন্দু’ নাম ও এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত শিব ও তার পরিবারকে ঘিরেই গড়ে ওঠে অধিকাংশ তীর্থস্থান। বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। আমরা জানি ‘সিন্ধু’ থেকে ‘হিন্দু’। তাই হিন্দুর কাছে নদ-নদী খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই নদ-নদীর সাথেই আবার জড়িত পর্বতমালা। কারণ নদ-নদীগুলোর উৎসস্থল পর্বত।
নদ-নদী ও পাহাড়-পর্বতের সাথেই আবার জড়িত হিন্দুর প্রধান প্রধান দেব-দেবী। হিমালয় হিন্দুর (আলোকপর্ব: অনুবাদ সন্ধ্যা চৌধুরী সাহিত্য একাদেমি ১৯৯৪) হিমালয় হিন্দুদের প্রহরী, দেবভূমি, রত্নখনি, ইতিহাস বিধাতা এবং সংস্কৃতির মেরুদণ্ড। হিমালয় শিব-পার্বতীর বিহারভূমি, নরনারায়ণের এবং যক্ষ-কিন্নর-গন্ধর্ব বিদ্যাধরগণের নিবাসস্থল। দ্বিবেদী বলছেন: হিমালয় ঋষিমুনিদের গঙ্গা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র-সিন্ধু-সরস্বতীর উদ্গমভূমি। এই হিমালয়ের দুই কন্যা পার্বতী গঙ্গা। গঙ্গার সাতটি ধারা। এর মধ্যে তিনটি ধারা পশ্চিমাংশে, তিনটি পূর্বাংশে এবং একটি মধ্যদেশ দিয়ে প্রবাহিত।
মধ্যদেশের নেমে রাজার তপস্যার ফলে। নদী অর্থাৎ গঙ্গা বাদে হিন্দুর দেবীদের মধ্যে আছেন পার্বতী অথবা উমা। পার্বতী মানে পর্বত কন্যা। অর্থাৎ হিমালয়কন্যা। অপর দিকে দেবী উমার ‘উমা’ শব্দও এসেছে হিমালয়বাসী ‘খস্’ জাতির ভাষা থেকে। আমরা জানি বর্তমান আসামের কামরূপ থেকে ফগানিস্তানের গান্ধার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রয়েছে দেবী পার্বতীর উপাসনা কেন্দ্র। এগুলো হিন্দুর তীর্থস্থান। অপরদিকে গঙ্গা হিমালয় কন্যা সতীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে অনেক তীর্থস্থান।
আবার বিদেহরাজের দুহিতা হিন্দুর আর এক দেবী সীতাও হিমালয়ের সাথে সম্পর্কিত। কারণ ইতিহাস বলে বিদেহ রাজ্যটিও হিমালয়ের আশেপাশে অবস্থিত ছিল। বলা বাহুল্য হিমালয়ের সাথেই আবার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক শিবের।
আমরা জানি নদ-নদীর উৎসস্থল হিসেবে হিমালয় এবং হিমালয় দুহিতা (কন্যা) হিসেবে গঙ্গা হিন্দুর কাছে পূজ্য। গঙ্গা হিন্দুর জীবন-মরণের সাথে একাত্ম। গঙ্গা বিধৌত কৃষি জমিই ফসল দানের মাধ্যমে হিন্দুকে রাখে জীবিত। মৃত্যুকালে হিন্দুর কাছে তাই গঙ্গাজল পবিত্রতম। গঙ্গার পারে মৃত্যু হিন্দুকে স্বর্গবাসী করে। এহেন গঙ্গাকে হিন্দু মহাদেব অর্থাৎ শিবের সাথে সম্পর্কিত করে নিয়েছে। গঙ্গাকে কল্পনা করা হয়েছে শিবের স্ত্রী হিসেবে। এই সূত্রে হিমালয় হচ্ছে শিবের শ্বশুর। কৈলাস (হিমালয়) আবার শিবের বসতবাটিও বটে।

মজার ঘটনা আর্যদের দেবতার স্থান হিমালয়ে মর্ত্যে হয় নি। আর্যদের দেবতারা বাস করেন দেবলোক বা বৈকুণ্ঠে। শিবের বাসস্থান কৈলাস। আর সাধারণ দেব-দেবীর স্থান মর্ত্যলোক। দেবতাদের স্তর বিন্যাসে দেখা যায় কৈলাসের শিবের সাথে সম্পর্ক টানা হয়েছে মর্ত্যলোকের দেব-দেবীর। দেবলোকের আর্য দেবতার সঙ্গে মর্ত্যের দেব-দেবীর সম্পর্ক টানা হয় নি।
এ প্রেক্ষাপটেই দেখা যায় হিন্দুর প্রায় সব প্রধান প্রধান তীর্থস্থান গঙ্গা, গঙ্গাকল্প নদ-নদী, হিমালয় পর্বত এবং শিব শিব-সংশিষ্ট দেবতাদেরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে। অবশ্য আর্যদেবতারা তীর্থস্থানের তালিকা থেকে বাদ যায় নি। তাদেরকেও পাশে স্থান দেওয়া হয়েছে। হিন্দুর প্রধান প্রধান তীর্থস্থানগুলোর দিকে লক্ষ করলেই ধারণাটির সত্যতা প্রমাণিত হয়।
হিন্দুর প্রধান প্রধান তীর্থস্থানগুলো (ভ্রমণে ভারত ও বিশ্ব ভ্রমণ: সম্পাদক: তুষার কান্তি পাণ্ডে: গ্রন্থনা : কলকাতা, ২০০১) নিচে দেওয়া হল:
প্রধান প্রধান তীর্থস্থান
ক্রমিক মন্দির
১. পরশুরাম কুণ্ড:
পরশুরাম কুণ্ড হিন্দু তীর্থক্ষেত্রগুলির মধ্যে অন্যতম যা লোহিত নদীর নিম্নবর্তী অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র মালভূমি ও ভারতের অরুণাচল প্রদেশের লোহিত জেলার তেজুর ২১ কিমি উত্তরে অবস্থিত।
২. কামাক্ষ্যা মন্দির:
কামাখ্যা মন্দির (অসমীয়া : কামাখ্যা মন্দিৰ) হল ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের পশ্চিমাংশে নীলাচল পর্বতে অবস্থিত হিন্দু দেবী কামাখ্যার একটি মন্দির। এটি ৫১ সতীপীঠের অন্যতম।
৩. শিব সাগর:
গর আহোম রাজাগণ কর্তৃক নির্মিত বিশাল পুখুরী, দেবীর মন্দির, জাদুঘর, সংগ্রহালয় ইত্যাদি দিয়ে ভরপুর ঐতিহাসিক নগর। ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে রানী অম্বিকা কলুঞ্চপারে ভগবান শিবকে উৎসর্গ করে একটি পুকুর খনন করান। শিবকে উৎসর্গ করা এই পুকুরের নাম রাখা হয় শিবসাগর। অন্যমতে রাজা শিবসিংহের নামে পুকুরটি নামাঙ্কিত করা হয়।
৪. দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির:
দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি কলকাতার অদূরে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত একটি কালীমন্দির। এটি উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কামারহাটি শহরের অন্তঃপাতী দক্ষিণেশ্বরে অবস্থিত। ১৮৫৫ সালে প্রসিদ্ধ মানব দরদি জমিদার রানি রাসমণি এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরে দেবী কালীকে “ভবতারিণী” নামে পূজা করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট যোগী রামকৃষ্ণ পরমহংস এই মন্দিরে কালীসাধনা করতেন।
৫. জগন্নাথ মন্দির:
পুরীর জগন্নাথ মন্দির একটি বিখ্যাত হিন্দু মন্দির। এই মন্দিরটি ওড়িশার পুরী পূর্ব সমুদ্র সৈকতে অবস্থিত। এই মন্দিরটি একটি বিখ্যাত হিন্দু তীর্থক্ষেত্র বিশেষ করে বিষ্ণু ও কৃষ্ণ উপাসকদের নিকট। এটি চারধামের অন্যতম যেখানে সকল ধার্মিক হিন্দুদের জীবনে অন্তত একবার যেতে চান।
৬. লিঙ্গরাজ মন্দির
লিঙ্গরাজ মন্দির পূর্বভারতীয় রাজ্য উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরে অবস্থিত প্রাচীন মন্দির গুলোর মধ্যে অন্যতম। মন্দিরটি লিঙ্গরাজ রূপি শিব কে উৎসর্গীকৃত। মন্দিরটি ভুবনেশ্বর শহরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূস্থাপনা ও অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান।
লিঙ্গরাজ মন্দির ভুবনেশ্বরের সব থেকে বড় মন্দির। কেন্দ্রীয় মিনারটি ১৮০ ফুট উঁচু। মন্দিরটি কলিঙ্গ স্থাপত্যকলা এবং মধ্যযুগীয় ভুবনেশ্বর স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত। ধারণা করা হয়ে থাকে মন্দিরটি সোমবংশী রাজত্বকালে নির্মিত যা পরবর্তীতে গঙ্গা শাসকদের হাতে বিকশিত হয়। মন্দিরটি দেউল শৈলীতে নির্মিত যার চারটি ভাগ আছে। সেগুলো হচ্ছে বিমান, জগমোহন, নাট্যমন্দির এবং ভোগমন্ডপ। ভাগগুলোর উচ্চতা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। মন্দির চত্ত্বরটি দেয়ালঘেরা।
ভুবনেশ্বরকে একাম্রা ক্ষেত্র বলা হয়ে থাকে। তেরো শতকে লেখা সংস্কৃত পুঁথি একাম্রা পুরাণ অনুযায়ী লিঙ্গরাজের মন্দিরটি একাম্রা (আম) গাছের নিচে অবস্থিত ছিলো। লিঙ্গরাজ মন্দিরটি মন্দির ট্রাস্ট বোর্ড এবং আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়ার অধীনে পরিচালিত হয়। প্রতিদিন গড়ে ৬০০০ দর্শনার্থী মন্দিরটি দেখতে আসে এবং উৎসব মৌসুমে লক্ষাধিক ভ্রমণার্থী আসে। এখানকার শিবরাত্রি উৎসব প্রধান অনুষ্ঠান এবং ২০১২ সালে উৎসব প্রাক্কালে দুই লক্ষ দর্শনার্থী আসে।
৭. তিরুপতি মন্দির
তিরুপতি ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের চিত্তুর জেলার একটি শহর। এটি একটি পৌর সংস্থা এবং তিরুপতি (নগর) মণ্ডলের এবং তিরুপতি রাজস্ব বিভাগের সদর দপ্তর। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী শহরটির মোট জনসংখ্যা ৩,৭৪,২৬০ জন এবং এটি অন্ধ্রপ্রদেশের নবম জনবহুল শহর। তিরুপতি ৪,৫৯,৯৮৫ জন জনসংখ্যার সাথে রাজ্যের সপ্তম বৃহত্তম শহুরে অঞ্চল। তিরুপতি অন্য ঐতিহাসিক মন্দিরগুলির পাশাপাশি তিরুমালা ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের জন্য একটি হিন্দু তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত এবং এটি “অন্ধ্রপ্রদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী” হিসাবে পরিচিত। তিরুপতি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসস্থল। ২০১২-১৩ সালে জন্য ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয় তিরুপতিকে “সেরা হেরিটেজ সিটি” হিসাবে চিহ্নিত করেছে। ভারত সরকারের স্মার্ট সিটি মিশন প্রকল্পের অধীনে তিরুপতিকে একশটি স্মার্ট সিটির মধ্যে একটি নির্বাচিত করেছে।
৮. কাঞ্চিপুরম কৈলাশনাথ মন্দির
চেন্নাই থেকে ৭৩ km উত্তরে প্রাচীন শহর কাঞ্চীপুরম। মেগা সিটি চেন্নাই এর পাশে কাঞ্চীপুরম এর জৌলুস অনেকটাই ম্লান।কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, একসময় তামিল সঙ্গম এর মাথার মণি ছিল কাঞ্চী। পল্লব রাজা দের আমলে গৌরবের চূড়ায় ওঠে এই নগরী। পল্লব রাজাদের মধ্যে প্রথিতযশা, মহারাজ দ্বিতীয় নরসিংহ বর্মন নির্মাণ করান বিখ্যাত কৈলাসনাথ মন্দির টির। সেটা সপ্তম শতকের গোধূলি বেলা। ৫৮ টি ছোট ছোট শিব মণ্ডপ আর তাদের মাঝে কৈলাশনাথ এর গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহ কে কেন্দ্র করে পাথরের প্রদক্ষিণ পথ।তারই পাশে পাশে প্রাচীর গাত্রে ৫৮ টি শিব মন্দির। প্রতিটি তে শিব এর এক এক রূপের প্রতিফলন।
৯. চিদাম্বরম নটরাজ মন্দির
ভারতের দক্ষিণাংশে তামিলনাড়ুর চিদম্বরমে অবস্থিত নটরাজ মন্দিরটি শিবের নৃৃত্যরত নটেশরূপ স্বয়ং নটরাজকে উৎসর্গীকৃত একটি হিন্দু মন্দির, যা চিদম্বরম নটরাজ মন্দির বা তিল্লাই নটরাজ মন্দির নামেও সমান প্রসিদ্ধ৷ শুরুর দিকে এই মন্দিরে শিবমূর্তির সম্পর্কে বেশকিছু পৌরাণিক কাহিনীর প্রচলন হয় এবং সংলগ্ন শহরটির তার তিল্লাই নামটি পায়৷ পরবর্তীকালে তিল্লাই নামটি শিবের চিদম্বরম নামে পরিবর্তিত হয়ে যায়৷ চিদম্বরমনামের আক্ষরিক অর্থ “জ্ঞানের আবহ” বা ” যার চিৎ অর্থাৎ মন অম্বরে বা দিগন্তে বিস্তৃৃত”৷ মন্দিরের শিল্পকলা ও স্থাপত্য শৈলী আধ্যাত্মিকতা, সৃৃজনশীলতা এবং দৈবত্বের মিলন ঘটিয়েছে৷ মন্দিরগাত্রের কারুকার্য দ্বারা ভরত মুনির বর্ণিত নাট্যশাস্ত্রের ১০৮টি করণকেই ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে, যার দর্শিত মুদ্রাগুলি ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য ভরতনাট্যমকে সমৃৃদ্ধ করেছে৷ এই মন্দিরটি পঞ্চভূত স্থলমের অন্যতম প্রতিনিধি শিবের প্রতি উৎসর্গীকৃত।
১০. রামেশ্বরম
রামেশ্বরাম ( রামেস্বারাম , রমেশ্বরম নামেও পরিচিত) ভারতের দক্ষিণ ভাগের প্রান্তিক স্থান। ভারতের তামিলনাড়ুর রামনাথাপুরাম জেলার একটি শহর ও পৌরসভা। এটি পামবান দ্বীপে অবস্থিত পামবান চ্যানেল দ্বারা প্রধানভূমি ভারত থেকে পৃথক এবং শ্রীলংকার মান্নার দ্বীপ থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি ভারতীয় উপদ্বীপের উপরিভাগে মাননার উপসাগরে অবস্থিত। পামবান দ্বীপ, যা রামেশ্বর দ্বীপ নামে পরিচিত, পামবান সেতু দ্বারা মূলভূমি ভারতের সাথে সংযুক্ত। রামেশ্বর চেন্নাই ও মাদুরাইয়ের রেলপথের টার্মিনাস। বারাণসীর সাথে একত্রিত হয়ে এটি হিন্দুদের কাছে ভারতের পবিত্রতম স্থান এবং চার ধাম তীর্থযাত্রার অংশ বলে মনে করা হয়।
১১. কন্যাকুমারী
দেবী কন্যা কুমারী হল একটি কিশোরী কন্যা শিশু রূপে মহাদেবীর প্রকাশ। দেবী শ্রী বালা ভদ্র বা শ্রী বালা নামেও পরিচিত। তিনি “শক্তি” ( আদি পরাশক্তি ) “দেবী” নামে পরিচিত। ভগবতী কুমারী আম্মান মন্দিরটি তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীতে অবস্থিত, প্রধান ভূমি ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে, সেখানে বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগরের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। তিনি কন্যা দেবী এবং দেবী কুমারী সহ আরও কয়েকটি নামেও পরিচিত। তিনি তার ভক্তদের দ্বারা ভদ্রকালী দেবীর অবতার হিসাবেও পূজিত হন। ঋষি পরশুরাম মন্দিরের পবিত্রতা করেছিলেন বলে কথিত আছে। দেবী মনের অনমনীয়তা দূর করেন বলে বিশ্বাস করা হয়; ভক্তরা সাধারণত তাদের চোখে বা এমনকি তাদের মনের মধ্যে অশ্রু অনুভব করে যখন তারা ভক্তি ও মননে দেবীর কাছে প্রার্থনা করে।
১২. সোমনাথ মন্দির
সোমনাথ মন্দির ভারতের একটি প্রসিদ্ধ শিব মন্দির। গুজরাত রাজ্যের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের বেরাবলের নিকটস্থ প্রভাস ক্ষেত্রে এই মন্দির অবস্থিত। এটি হিন্দু দেবতা শিবের দ্বাদশ লিঙ্গের মধ্যে পবিত্রতম। সোমনাথ শব্দটির অর্থ “চন্দ্র দেবতার রক্ষাকর্তা”। সোমনাথ মন্দিরটি ‘চিরন্তন পীঠ’ নামে পরিচিত। কারণ অতীতে ছয় বার ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও মন্দিরটি সত্বর পুনর্নিমিত হয়। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে জুনাগড়ের ভারতভুক্তির সময় এই অঞ্চল পরিদর্শন করে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মন্দিরের কাজ এগিয়ে নিয়ে যান ভারত সরকারের অপর এক মন্ত্রী কে. এম. মুন্সি।
১৩. রনথোরজী বা দ্বারকাধীশ মন্দির
দ্বারকাধীশ মন্দির, যা জগৎ মন্দির নামেও পরিচিত , এটি একটি হিন্দু মন্দির যা কৃষ্ণকে উৎসর্গ করে , যিনি এখানে দ্বারকাধীশ বা ‘দ্বারকার রাজা’ নামে পূজিত হন। মন্দিরটি ভারতের গুজরাটের দ্বারকা শহরে অবস্থিত, যেটি হিন্দু তীর্থস্থান চরধামের একটি । প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানগুলি থেকে জানা যায় যে, আদি মন্দিরটি ২০০০ বছর আগে প্রথম দিকে নির্মিত হয়েছিল। এটি ১৫ – ১৬ শতকে বর্ধিত করা হয়েছিল।
১৪. বৃন্দাবন, দ্বারকা:
দ্বারকা হলো ভারতের গুজরাত রাজ্যের দেবভূমি দ্বারকা জেলায় অবস্থিত একটি প্রাচীন শহর ও পৌরসভা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে চারধাম নামে পরিচিত চার প্রধান তীর্থস্থানের একটি হল দ্বারকা। আবার সপ্তপুরী নামে পরিচিত ভারতের সাতটি প্রাচীনতম শহরের অন্যতম হল দ্বারকা। হিন্দুশাস্ত্রে দ্বারকাকে কৃষ্ণের রাজধানী বলা হয়েছে। মনে করা হয়, এটিই ছিল গুজরাতের প্রথম রাজধানী। কৃষ্ণের অপর নাম দ্বারকাধীশ বা দ্বারকেশ্বর। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ বা সপ্তম শতাব্দীতে দ্বারকাধীশ মন্দির নির্মিত হয়। এটি ঐতিহাসিক দ্বারকা রাজ্যের সাথে চিহ্নিত, ভাগবত পুরাণে কৃষ্ণের প্রাচীন রাজ্য হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বিশ্বাস করা হয় যে এটি গুজরাটের প্রথম রাজধানী ছিল।
১৫. বিশ্বনাথ মন্দির
কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ভারতের একটি বিখ্যাত হিন্দু মন্দির। এটি উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বারাণসীতে অবস্থিত। মন্দিরটি গঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, কাশী বিশ্বনাথ মন্দির “জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির” নামে পরিচিত শিবের বারোটি পবিত্রতম মন্দিরের অন্যতম। মন্দিরের প্রধান দেবতা শিব “বিশ্বনাথ” বা “বিশ্বেশ্বর” নামে পূজিত হন। বারাণসী শহরের অপর নাম “কাশী” এই কারণে মন্দিরটি “কাশী বিশ্বনাথ মন্দির” নামে পরিচিত। মন্দিরের ১৫.৫ মিটার উঁচু চূড়াটি সোনায় মোড়া। তাই মন্দিরটিকে স্বর্ণমন্দিরও বলা হয়ে থাকে।
১৬.হরিদ্বার (হরিদ্বার):
হরিদ্বার বা হরদ্বারও বলা হয়, ভারতের উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বার জেলার একটি প্রাচীন শহর এবং পৌরসভা। কিংবদন্তি অনুযায়ী, এখানেই দেবী গঙ্গা ভগবান শিবের জটা থেকে মুক্তি পেয়ে পৃথিবীতে নেমেছিলেন। গঙ্গোত্রী হিমবাহের প্রান্তে গোমুখ থেকে উৎপন্ন হয়ে, উৎস থেকে ২৫৩ কিলোমিটার (১৫৭ মা) চলে, হরিদ্বারে প্রথমবারের জন্য সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমিতে প্রবেশ করে। যা থেকে এই শহরটির প্রাচীন নাম হয়েছে গঙ্গাদ্বার।
১৭. কুম্ভমেলা
গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী তিন নদীর সঙ্গম এই ত্রিবেণীতে। শোনা যায়, ৭০৩ বছর আগে এখানেই কুম্ভ স্নান ও কুম্ভমেলা হতো।
১৮. অমরনাথ মন্দির
অমরনাথ গুহা একটি হিন্দু তীর্থক্ষেত্র যা ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে অবস্থিত। এটি একটি শৈব তীর্থ। এই গুহাটি সমতল থেকে ৩,৮৮৮ মিটার (১২,৭৫৬ ফুট)[১] উঁচুতে অবস্থিত। জম্মু ও কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর ১৪১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই তীর্থে যেতে পহেলগাও শহর অতিক্রম করতে হয়। এই তীর্থ ক্ষেত্রটি হিন্দুদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম পবিত্র স্থান বলে বিবেচিত হয়।
ওপরের তালিকাটি খুবই সংক্ষিপ্ত। এর বাইরেও হিন্দুর তীর্থস্থানের সংখ্যা প্রচুর। এ তীর্থস্থানগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী এবং অরুণাচল থেকে গুজরাট এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের তীর্থস্থানগুলোতে এ অঞ্চলের আদি দেবতা শিব ও তাঁর গোত্রীয় দেব-দেবীরই প্রাধান্য। এই তালিকার বাইরে বাংলাদেশের চন্দ্রনাথ ও লাঙ্গল বন্দ্ (নারায়ণগঞ্জ জেলা) হিন্দুদের তীর্থস্থান। লাঙ্গলবন্দের গঙ্গাকল্প নদীতে স্নান করলে পাপমুক্ত হওয়া যায় বলে বিশ্বাস। নেপালের পশুপতিনাথের (শিব) মন্দির জগৎ বিখ্যাত। পাকিস্তানের বেলুচিস্থানের মরুতীর্থ হিংলাজ প্রসিদ্ধ একটি তীর্থস্থান। এই সবগুলোর সাথেই সম্পর্ক মহাদেবের (শিব)।
পরিশেষে বলা দরকার বর্তমান কালে তীর্থস্থানগুলো শুধু ধর্মীয় স্থান নয়। এগুলো গড়ে উঠছে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা এই স্থানগুলো দর্শন করতে আসে। লক্ষ লক্ষ দেশি-বিদেশি তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের ভিড়ে এগুলো এখন পরিণত হয়েছে মহামিলন ক্ষেত্রে।
আরও পড়ুন: