আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় শ্রীচৈতন্য কৃষ্ণ, সন্ন্যাসগ্রহণ ও লীলাবসান
Table of Contents
শ্রীচৈতন্য কৃষ্ণ, সন্ন্যাসগ্রহণ ও লীলাবসান
কৃষ্ণভক্ত নিমাই
পরলোকগত পিতার পিণ্ডদান করার উদ্দেশ্যে নিমাই গয়াধামে গেলেন। সেখানে পৌঁছবার পর নিমাইয়ের জীবনে এক পরিবর্তন দেখা দিল। ভক্তিসিদ্ধ মহাবৈষ্ণব ঈশ্বরপুরীর নিকট বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়ে নিমাই এক নতুন মানুষ হয়ে গেলেন। তিনি কৃষ্ণভক্ত হয়ে পড়লেন। গয়াধাম থেকে নবদ্বীপে ফিরে এলেন নিমাই। এখন তিনি পূর্বের গৃহী, অহংকারী নিমাই পণ্ডিত নন।
তিনি কৃষ্ণবিরহে কাতর এক নতুন মানুষ, মহাপ্রেমিক সাধক। কৃষ্ণনাম উচ্চারণ করেন আর নয়ন থেকে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে। কৃষ্ণ বিরহের জ্বালায় তিনি অধীর হয়ে উঠলেন। মুখে শুধু এক কথা, আমার কৃষ্ণ কই? ছাত্ররা পড়তে আসে, পড়ানো হয় না। ছাত্রদের নিয়ে তিনি নামকীর্তন শুরু করে দেন।
এই সময় নবদ্বীপের কয়েকজন বৈষ্ণব নিমাইয়ের মধ্যে খুঁজে পেলেন তাঁদের নতুন নেতাকে। শ্রীবাস, গদাধর, মুকুন্দ, হরিদাস, শ্রীঅদ্বৈত আচার্য প্রভৃতি বৈষ্ণবগণ নিমাইয়ের সঙ্গে মিলিত হয়ে নামকীর্তন করেন। ভক্তদের কাছে নিমাই হলেন গৌরাঙ্গ, গৌরসুন্দর। শ্রীবাসের আঙ্গিনায় কীর্তন হচ্ছে। কীর্তন বিরতি দিয়ে ভক্তদের নিয়ে গৌরাঙ্গ সোজা ননন্দাচার্যের গৃহে যান।
সম্মান থেকে আত্মগোপনকারী মহাপুরুষ নিত্যানন্দকে নিয়ে আসেন তিনি। এই নিত্যানন্দই পরবর্তী সময়ে হলেন গৌরাঙ্গের প্রধান পার্ষদ। গৌরের নামের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়ে গেলেন এক অবিচ্ছেদ্য নাম । “গৌর নিতাই” ভক্তমুখে গৌরাঙ্গ স্থির করলেন, তাঁর প্রেম-ভক্তির ধর্মকে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করবেন। এই কাজে নিয়োগ করলেন দুই শ্রেষ্ঠ পার্ষদ নিত্যানন্দ ও হরিদাসকে।
অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে তাঁদের ধর্ম প্রচার চলতে থাকে। জগাই-মাধাইসহ নবদ্বীপের কাজী শ্রীচৈতন্য ও নিত্যানন্দের প্রেমপূর্ণ ক্ষমায় নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন এবং শ্রীচৈতন্যের প্রেম-ভক্তির ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। এভাবে ক্রমেই ভক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে ।
সন্ন্যাস গ্রহণ ও লীলাবসান
গৌরাঙ্গ ভাবছেন তাঁর প্রেম-ভক্তির ধর্ম কি করে বিশ্বমানব কল্যাণে লাগাতে পারেন। প্রেমধর্মের বাণী দেশে দেশে জনে জনে প্রচার করবেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন সংসারধর্ম ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করবেন। অনেক কষ্টে মা ও স্ত্রীকে বুঝিয়ে তিনি সংসার ছেড়ে চলে গেলেন। কাটোয়ায় কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হলেন। তাঁর নাম হলো শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য সংক্ষেপে শ্রীচৈতন্য।
মায়ের অনুরোধে তিনি উড়িষ্যায় নীলাচলে থেকে মায়ের খবরাখবর নিতে সম্মত হলেন । শ্রীচৈতন্য জীবনের শেষ অবধি মায়ের খবরাখবর নিয়েছিলেন। এরপর তিনি প্রেমভক্তি প্রচারের জন্য পুরী হয়ে দাক্ষিণাত্যে এবং পরে বৃন্দাবনে যান। সেখানে লুপ্ত তীর্থগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করেন। এ সময় শ্রীরূপ, সনাতন, রঘুনাথ ভট্ট, রঘুনাথ দাস, শ্রীজীব, গোপাল ভট্ট প্রমুখ বিশিষ্ট পণ্ডিত ভক্তগণ তাঁর সাথে মিলিত হন।

তাঁদের মাধ্যমে শ্রীচৈতন্য তাঁর প্রেমভক্তির ধর্ম বা বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। এঁরা বৈষ্ণব ধর্মের বহু গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। বৃন্দাবন থেকে একবার শ্রীচৈতন্য কাশীধামে এসে উপস্থিত হন। কাশীধামে তখন মায়াবাদী সন্ন্যাসী ও পণ্ডিতগণের প্রবল প্রতাপ। শ্রীচৈতন্য সেখানে উপস্থিত হলে তাঁদের সঙ্গে ধর্মের নানা বিষয়ে বিচার হয়।
স্বামী প্রকাশানন্দ শ্রীচৈতন্যকে সম্বোধন করে বলেন, ‘হে সন্ন্যাসী তুমি সন্ন্যাসীর ধর্ম পরিত্যাগ করে উন্মাদের মত করছ কেন?’ উত্তরে শ্রীচৈতন্য বললেন, “আমার গুরুদেব আমাকে বলেছিলেন, তোমার বেদান্তে অধিকার নেই। কলিকালে নাম জপই সার। তুমি কেবল কৃষ্ণনাম জপ কর । কৃষ্ণনাম ও কৃষ্ণভক্তিই শ্রেষ্ঠ সাধনা।” বৃহন্নারদীয় পুরাণ থেকে তিনি উদ্ধৃতি দিলেন –
হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম্।
কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা।।
“আমি গুরুর সেই উপদেশ পালনে পাগল হয়েছি।” এ কথা বলে শ্রীচৈতন্য হরিনামের মহিমাসূচক বিচার শুরু করলেন। বিচারে পরাজিত হয়ে স্বামী প্রকাশনান্দসহ আরও অনেক মায়াবাদী সন্ন্যাসী শ্রীচৈতন্যের প্রেমধর্ম গ্রহণ করলেন। এভাবে কাশীধামে হরিনামের ধ্বজা তুলে শ্রীচৈতন্য পুনরায় নীলাচলে গমন করেন। জীবনের শেষ আঠার বছর শ্রীচৈতন্য নীলাচলেই অতিবাহিত করেন।
এ সময় তিনি প্রায়ই দিব্যভাবে বিভোর থাকতেন। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে (১৪৫৫ বঙ্গাব্দে) আষাঢ় মাসে একদিন শ্রীচৈতন্য দিব্যভাবাবেশে জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশ করলেন। মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। সবাই বাইরে; ভিতরে রইলেন প্রভু আর জগন্নাথ। যখন কপাট খুলল তখন প্রভুকে আর দেখা গেল না। অনেকের ধারণা, শ্রীচৈতন্য জগন্নাথদেবের বিগ্রহে লীন হয়ে গেছেন।
শ্রীচৈতন্যের উপদেশ :
১। উত্তম হওয়া বৈষ্ণব হবে নিরভিমান। জীবে সম্মান দিবে জানি কৃষ্ণ অধিষ্ঠান।।
২। কিবা বিপ্ৰ, কিবা ন্যাসী, শূদ্র কেনে নয় । যেই কৃষ্ণতত্ত্ববেত্তা সেই গুরু হয়।।
৩। নীচ জাতি নহে কৃষ্ণ ভজনে অযোগ্য। সৎকুলে বিপ্র নহে ভজনের যোগ্য।। যেই ভজে, সেই বড়, অভক্ত হীন ছার। কৃষ্ণ ভজনে নাহি জাতি কুলাদি বিচার।।
8। কি ভোজনে কি শয়নে কি বা জাগরণে । অহর্নিশি চিন্ত কৃষ্ণ বলহ বদনে।। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে । হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
সারাংশ
গয়াধামে গিয়ে কৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে নিমাই কৃষ্ণভক্ত হন। গৃহে ফিরে তিনি কৃষ্ণ কীর্তনে মেতে ওঠেন। নবদ্বীপের বৈষ্ণবগণ তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। প্রেমভক্তি ধর্ম দিয়ে জগতের কল্যাণ করার উদ্দেশ্যে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। পুরীধাম হয়ে দাক্ষিণাত্য, বৃন্দাবন এবং কাশীধামে তাঁর ধর্মমত প্রচার করেন। অবশেষে শ্রীচৈতন্য নীলাচলে জগন্নাথ মন্দিরের বিগ্রহের সঙ্গে লীন হয়ে যান।
শ্রীচৈতন্যের মতে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান। কৃষ্ণভক্ত সম্মানের পাত্র।
আরও দেখুন :