আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় শ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী
শ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী
শ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী
বাংলা ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি সময়। বারদীর আশ্রমে ব্রহ্মচারী বাবা ভক্তদের নিয়ে আলাপ করছেন। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন। “তোরা যা তো নদীর ধারে; দেখবি ব্রাহ্ম সমাজের সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নৌকাযোগে যাচ্ছেন। তাঁকে এখানে ডেকে নিয়ে আয়।” ভক্তরা গিয়ে ব্রহ্মচারীবাবার কথা বলে বিজয়কৃষ্ণকে আশ্রমে নিয়ে এলেন। ব্রহ্মচারীবাবা দাঁড়িয়ে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে অভ্যর্থনা জানালেন ।
ব্রহ্মচারীবাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বিজয়কৃষ্ণ বিস্ময়াবিষ্ট হলেন। অসাধারণ দৃষ্টি। ব্রহ্মচারীজীর প্রদীপ্ত নয়নযুগল থেকে অপূর্ব জ্যোতিরাশি বহির্গত হয়ে গোস্বামী মহাশয়ের শরীরে প্রবেশ করল। বিজয়কৃষ্ণ নয়নজলে ভাসতে ভাসতে ব্রহ্মচারীবাবার চরণে পতিত হলেন। ব্রহ্মচারীবাবা পরম স্নেহে দুহাত দিয়ে তাকে তুলে বক্ষে জড়িয়ে ধরলেন। ব্রহ্মচারীজীর শক্তি বিজয়কৃষ্ণের মধ্যে সঞ্চারিত হল।
বারদীর ব্রহ্মচারীবাবার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বিজয়কৃষ্ণ বলেছেন, “আমি বহু সাধু-সন্ন্যাসীর আশ্রমে গিয়েছি। কিন্তু যা শুনে এসেছিলেম তা অপেক্ষা অনেক বেশি দেখতে পেয়েছি। আমি এ মুহূর্তে যে অনুগ্রহ লাভ করেছি তাতে আমি ধর্মজীবনে উন্নতি সাধন করতে পারব। বারদী আমার ধর্মজীবনের জন্মস্থান।”
বারদীর এই ব্রহ্মচারীই হলেন পরম সিদ্ধপুরুষ শ্রীলোকনাথ-ব্রহ্মচারী। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসত মহকুমার কচুয়া গ্রামে আনুমানিক ১১৩৭ সনে লোকনাথ বাবা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাম-কানাই ঘোষাল, মাতা কমলা দেবী। ঘোষাল মশায়ের চারপুত্রের মধ্যে লোকনাথ ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।
লোকনাথের পিতার ইচ্ছা ছিল, তাঁর পুত্রদের মধ্যে একজন সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ এবং ভগবানের নামকীর্তন করে বংশের পবিত্রতা সম্পাদন করে। কিন্তু পত্নী কমলাদেবীর বাধাদানের ফলে তাঁর এ আশা এ যাবৎ পূর্ণ হতে পারে নি। লোকনাথের বেলায় কমলাদেবীর সম্মতি পাওয়া গেল। স্থির হল লোকনাথ সন্ন্যাসী হবেন। ঐ সময় ভগবান গাঙ্গুলী নামে একজন শাস্ত্রবেত্তা আচার্য তাঁদের নিকটেই ছিলেন।
রাম কানাই ঘোষাল এই সর্বজন শ্রদ্ধেয় আচার্যের হাতেই পুত্র লোকনাথের আধ্যাত্মজীবন গঠনের ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন । লোকনাথের উপরীত গ্রহণের সময় উপস্থিত। ভগবান গাঙ্গুলী স্থির করলেন আচার্যরূপে তিনি বালকের সংস্কার সম্পন্ন করবেন। তারপরই এই দণ্ডী ব্রহ্মচারী বালককে সঙ্গে নিয়ে চিরতরে সংসার ত্যাগ করে চলে যাবেন। কথাটি চারদিকে প্রচার হয়ে পড়ে।
এ সময় লোকনাথের বাল্যসখা বেনীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায় এক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাঁদের সঙ্গে সেও গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হবে। আচার্য গাঙ্গুলী উভয় বালকের গুরুরূপে তাঁদের সংস্কার ও দীক্ষাকার্য সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি বালক ব্রহ্মচারী দুজনকে নিয়ে ধীরে ধীরে গৃহত্যাগ করে চলে গেলেন। তাঁর বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে, আর শিষ্য দুজনেরই বয়স হবে প্রায় দশ।

গৃহত্যাগ করে তাঁরা বর্তমান কলকাতার কালীঘাটে এসে কিছুদিন থাকেন। মহাজাগ্রত শক্তিপীঠ বলে তখন কালীঘাটের ছিল বিরাট খ্যাতি। জটাজুটধারী বহু সন্ন্যাসী দূর-দূরান্ত থেকে এখানে এসে জড় হতেন। এখানে সাধু-সন্ন্যাসীদের মধ্যে কিছুদিন কাটাবার পর আচার্য ভগবান গাঙ্গুলী বালক দুজনকে সঙ্গে নিয়ে বনে চলে যান। অরণ্যবাস ও কঠোর ব্রহ্মচর্যব্রত পালনের মধ্যদিয়ে তাঁদের বিশ-পঁচিশ বছর কেটে যায়।
এ সময় লোকনাথ ও বেনীমাধব উভয়েই হঠযোগ, রাজযোগ, লয়যোগ ও মন্ত্রযোগের শিক্ষা গ্রহণ করে সিদ্ধিলাভ করেন।
এরপর তারা কাশীধামে গিয়ে কিছুকাল অবস্থান করেন। সেখানে হিতলাল মিশ্র নামে এক মহাযোগীর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলী এই মহাসাধকের হাতে লোকনাথ ও তার বন্ধুকে সমর্পণ করেন এবং একদিন গঙ্গাতীরে মণিকর্ণিকার ঘাটে মহাসমাধিতে নিমগ্ন হন। লোকনাথ ও বেনীমাধবের বয়স তখন প্রায় নব্বই বছর।
যোগী হিতলাল মিশ্রের তত্ত্বাবধানে লোকনাথ ও বেনীমাধবের সাধনা চলতে থাকে। শিষ্য দুজনকে নিয়ে হিতলাল মিশ্র হিমালয়ে চলে যান এবং সেখানে কঠোর সাধনায় তাদেরকে পারঙ্গম করে তোলেন। যোগী হিতলালের কৃপায় লোকনাথ ও বেনীমাধব অপূর্ব যোগ সামর্থ্য অর্জন করেন। তারপর দীর্ঘ সাধনার মধ্য দিয়ে লোকনাথ তাঁর পরম প্রাপ্তি লাভ করেন এবং অশেষ শক্তি বিভূতির অধিকারী হন ।
এরপর তাঁরা দেশ ভ্রমণে বের হন। তিব্বত, সমগ্রভারত, মক্কা ও মদিনা পরিভ্রমণ করেন। লোকনাথ আবদুল গফুর নামে একজন মুসলমান সাধকের নিকট থেকে ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্য অবগত হন। তাঁরা চীন দেশ হয়ে হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলে ফিরে আসেন। তখন যোগী হিতলাল, তার শিষ্য দুজন লোকনাথ ও বেনীমাধবকে বলেন, “দেখো, তোমাদের নিম্নভূমিতে কর্ম রয়েছে, আমার সাথে তোমাদের থাকবার আর প্রয়োজন নেই।”
সারাংশ
শ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী বারাসতের কচুয়া গ্রামে ১১৩৭ সনে জন্মগ্রহণ করেন। লোকনাথ ও বেনীমাধব দুই বন্ধু একই সময়ে উপনয়ন সংস্কারের পর গুরু ভগবান গাঙ্গুলীর সঙ্গে গৃহত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন কঠোর ব্রহ্মবর্ষ পালন ও সাধনা করে কাশীধামে যান। সেখানে ভগবান গাঙ্গুলী লোকনাথ ও বেনীমাধবকে যোগীবর হিতলালের হাতে অর্পণ করে দিয়ে দেহত্যাগ করেন।
যোগী হিতলালের তত্ত্বাবধানে লোকনাথ ও বেনীমাধব হিমালয়ে দীর্ঘদিন সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন। তাঁরা তিব্বত, ভারত, মক্কা-মদিনা, চীন প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করে পুনরায় হিমালয়ে ফিরে আসেন। তখন লোকনাথ ও বেনীমাধবকে হিতলাল নিম্নভূমিতে যাওয়ার নির্দেশ দেন ।
আরও দেখুন :