হিন্দু ধর্মের ইতিহাস, সনাতন ধর্মের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত [ Short Introduction of Sanatan Hinduism ] : হিন্দু ধর্মের ইতিহাস বা সনাতন ধর্মের ইতিহাস অনেক বিস্তৃত বিষয়। খুব সংক্ষেপে লেখা মুশকিল। তাই আমরা এখানে একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনাতে সনাতন ধর্মের ইতিহাস বা হিন্দু ধর্মের ইতিহাস কে সংক্ষেপে তুলে ধরতে চেষ্টা করলাম। সাথে কিছু লিংক ও রেফারেন্স যুক্ত করা হলো। আশা করি এতে আপনাদের প্রাথমিক ধারণাটি হবে।
হিন্দুধর্মের উৎপত্তি কখন কীভাবে— এ সম্পর্কে যেসব গবেষণালব্ধ তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায় তা এখনও তর্কাতিত নয়। তবে নিত্য ধর্মের আচার আচরণীয় বিষয় বলে একে সনাতন ধর্ম বলা হয়। হিন্দু ধর্ম আর্য প্রাগার্য সমন্বয়ে একটি ধর্ম। আদিবাসীদের ধর্ম ও যাযাবর আর্যদের সঙ্গে নিয়ে আসা ধর্মের মিলনজাত ধর্ম হল হিন্দু ধর্ম। এদিক থেকে হিন্দু ধর্মকে আদি সনাতন ধর্মও বলা যায়। প্রাচীনকাল থেকে হিন্দু ধর্ম আর্যধর্ম নামে পরিচিত। এর উৎসস্থল ‘স’ কে ‘হ’ উচ্চারণ করতেন। সুতরাং ‘সিন্ধু’ শব্দ থেকেই ‘হিন্দু’ শব্দটির উৎপত্তি হয়।
Table of Contents
[ হিন্দু ধর্মের ইতিহাস, সনাতন ধর্মের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত [ Short Introduction of Sanatan Hinduism ] ]
হিন্দু ধর্মকে বৈদিক ধর্ম বলে। চতুর্বেদ ধর্মের মূল বিষয়। বস্তু ঋষি, মুনি, আচার্য ও ভক্তের বিচিত্র ধর্মীয় ও নৈতিক অভিজ্ঞতা ও উপদেশই হিন্দু ধর্মের ভিত্তি। হিন্দু ধর্মকে দুভাগে ভাগ করা যায়। একটি সামান্য ধর্ম অন্যটি বিশেষ ধৰ্ম। নীতিসম্মত আচার আচরণের কর্তব্যসমূহকে সামান্য ধর্ম বলা যায়। যেমন ধৈর্য, দান, ক্ষমা, সহিষ্ণুতা, ধীবিদ্যা, সততা এবং আক্রোধ প্রভৃতি। এদের মাধ্যমে চিত্তের বিশুদ্ধ আনয়ন করা যায়। অপরদিকে কাল সময় অবস্থা অথবা মানব ভেদে যেসব নীতি অবশ্যই করণীয় সেগুলি হল বিশেষ ধর্ম।
হিন্দুধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ। বেদ শব্দের অর্থ ‘জানা’ (To Know) আর সামষ্টিক জানাকে বলা হয় বেদান্ত। যে সকল মহাপ্রাজ্ঞ ব্যক্তিগণ ‘বেদ’ আবিস্কার করেছেন তাঁরা ‘ঋষি’ নামে পরিচিত। ঋষিগণকে মন্ত্রদ্রষ্টারূপে অভিহিত করে ভবিষ্যদ্দর্শীও বলা হয়। পৃথিবীতে প্রচলিত বৃহৎ ধর্মসমূহের মধ্যে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদ দৃশ্যত সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। হিন্দুধর্মে যে সকল গ্রন্থকে পবিত্র বলে জ্ঞান করা হয় তার মধ্যে বেদ হচ্ছে অন্যতম প্রধান। সংস্কৃত ‘বিদ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন বেদ শব্দের প্রতীকী অর্থ ‘বেদ’ তথা জ্ঞান।
জ্ঞান বলতে ঈশ্বর, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে পারমার্থিক জ্ঞানই বুঝায়। সৃষ্টি যেমন অনাদি ও অনন্য, ঈশ্বর সম্পর্কে জ্ঞানও তেমন অনাদি অনন্ত। ঈশ্বর ও সৃষ্টি সম্পর্কে এই শাশ্বত ও অফুরন্ত জ্ঞান কলেবর পবিত্র বেদগ্রন্থে প্রকাশ পেয়েছে। এক কথায় বলা চলে বিশ্ব চরাচরে বিরাজমান এই অপরিমেয় জ্ঞানরাশির যে সামান্যাংশের সন্ধান হিন্দু তত্ত্বদ্রষ্টাগণ পেয়েছিলেন তারই লিপিবদ্ধকরণ হচ্ছে বেদ। পবিত্র বেদের সন্ধান পাওয়া সকল ঋষিগণের নাম জানা যায়নি। মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, বিশ্বামিত্র, ভরদ্বাজ, বিশ্ববারা ও লোপমুদ্রার ন্যায় চার পুরুষ ও দুই নারী ঋষির প্রসিধি আছে। বেদের চারটি খণ্ড রয়েছে ১. ঋকবেদ ২. যজুর্বেদ, ৩. সামবেদ, ৪. অথর্ববেদ।
![হিন্দু ধর্মের ইতিহাস, সনাতন ধর্মের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত । Short Introduction of Sanatan Hinduism 3 আধুনিক চিত্রয়ণে বেদব্যাস হিন্দু ধর্মের ইতিহাস, সনাতন ধর্মের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত [ Short Introduction of Sanatan Hinduism ]](https://sanatangoln.com/wp-content/uploads/2021/11/বেদব্যাস-Vyasa-234x300.jpg)
বেদ ঐশ্বরীয় না মনুষ্য সংকলিত এর বিভাজনের পূর্বাপর ইতিহাস নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিভিন্ন মতভেদ আছে। ইতিহাসের অভিজ্ঞানেও দেখা যায়, কুমারী মৎসগন্ধ্যার গর্ভে পরাশর মুনীর ঔরশজাত দ্বৈপায়ন (মহাভারত দ্রষ্টব্য) নামক পুত্ৰ (যিনি দেবব্যাস নামে পরিচিত) বেদকে ঋক, যজু, সাম ও অথর্ব এই চার খণ্ডে ভাগ করেন। ব্যাসের চারজন শিষ্য পৈল, বৈশ্বম্পয়ন, জৈমিনি ও সুমন্তকে যথাক্রমে উপরোক্ত ভাগ চতুষ্টয় শিক্ষা দেয়া হয় যাতে তারা স্মৃতিতে ধারণ করতে পারে। ব্যাসদেব কর্তৃক বেদভাগ বণ্টনটি নিম্নরূপ: পৈল প্রাপ্ত হলেন ঋকবেদ, জৈমিনি, প্রাপ্ত হলেন সামবেদ, বৈশ্বম্পয়ন প্রাপ্ত হলেন যজুর্বেদ, আর সুমন প্রাপ্ত হলেন অথর্ববেদ। চতুর্বেদের প্রত্যেকটি পাঠের বিশেষ পদ্ধতি আছে। হিন্দু ধর্মের ইতিহাস, সনাতন ধর্মের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত [ Short Introduction of Sanatan Hinduism ]
ক. ঋগ্বেদ :
সূর্য, অগ্নি, ঊষা, বায়ু, বরুন প্রভৃতি প্রাকৃতিক পদার্থের উদ্দেশ্যে রচিত প্রার্থনাবাণী সমূহের গদ্য ছন্দে রচিত অংশ এতে স্থান পেয়েছে। গদ্য ছন্দযুক্ত বাক্যকে ঋক বলে। ঋগ্বেদ সর্বাপেক্ষা প্রাচীন।
খ. সামবেদ :
সাম অর্থ গান। যে সব মন্ত্র সুরসহযোগে পঠিত হয় তা এতে স্থান পেয়েছে। এতে যজ্ঞাদি ও বিধিনিষেধ বর্ণিত।
গ. যজুর্ব্বেদ :
যজন অর্থ পূজার্চ্চনা, যাগ-যজ্ঞ প্রভৃতি। এতে যজন যাজনাদি সংক্রান্ত মন্ত্রগুলি সন্নিবেশিত। মন্ত্রগুলো ‘কান্ড়ী’ ছন্দে রচিত। যজু অর্থ ‘কান্ড়ী’ সমষ্টি। এগুলো সন্ধির নিয়মে পাঠ করা যায়, কিন্তু ঋগ্বেদে তা নিষিদ্ধ।
ঘ. অথর্ববেদ :
‘অথর্ববেদ’ই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, এটি সন্ধি’র নিয়মে রচিত। এর ছন্দ ঋক ও যজুর্বেদের মত নয়। বরং ‘ভর’ নামক বিশেষ ছন্দে রচিত। অন্য সব বেদের তুলনায় অথর্ববেদে তাদের অনুরাগ, অল্প এর অধিকাংশ অংশকে বিলুপ্ত বলে মনে করা হয়েছে।
বেদকে আবার চার অংশে ভাগ করা হয়েছে। যথা : সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। সংহিতা ও ব্রাহ্মণ হল কর্মকাণ্ড, যাগযজ্ঞ, দেবতাদের স্তুতি ও প্রার্থনা, আর ‘আরণ্যক’ ও ‘উপনিষদ’ ভাগে রয়েছে জ্ঞানকাণ্ড সম্পৰ্কীয় মন্ত্ৰসমূহ। এই উপনিষদ’ই হল বেদের অন্ত বা সার ভাগ যে কারণে একে বেদান্তও বলা হয়। বেদের আনুষঙ্গিক ছয় প্রকার শাখা আছে যাদের বেদাঙ্গ বলে। ব্রাহ্মণের সংখ্যা ঋগ্বেদ ও যজুর্বেদে ২টি করে, সামবেদে ৮টি ও অর্থববেদের মাত্র ১টি। ‘স্মৃতি’ নামে বেদ হতে উৎপন্ন একটি বিধিনিষেধ পুস্তকও বিদ্যমান।
উল্লেখ্য যে, বেদকে হিন্দুরা ঐশী গ্রন্থরূপে জানে এবং এর রচনাকে কারো প্রতি আরোপ করে না। ব্যাসকে তারা ‘বেদ’-এর সংকলক ও বিভাজক বলে, রচয়িতা নয়। ‘বেদ’ ব্যতীত তাদের অন্য সকল ধর্মগ্রন্থ কোন-না-কোন রচয়িতা’র প্রতি আরোপ করা হয়। অবশ্য ‘শ্রীমদ্ভাগবদ্ গীতা’কে প্রতিটি হিন্দুই সাক্ষাৎ ভগবানের মুখ নিঃসৃত বাণী বলে বিশ্বাস করে। সর্বসাধারণের নিকট বেদের শিক্ষা প্রচার ও এর মর্মকথা উদ্ঘাটনে যেসব গ্রন্থ বিদ্যমান তন্মধ্যে বেদান্ত সূত্র ও এই ভগবৎ গীতাই সুপ্রসিদ্ধ। হিন্দু ধর্মের ইতিহাস, সনাতন ধর্মের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত [ Short Introduction of Sanatan Hinduism ]
ভারতের প্রাচীন ধর্মীয় পুস্তক হিসেবে সনাতন ধর্মের অনুসারী আর্যরা যে পুস্তক ব্যবহার করত, তা ঋকবেদ। এতে ১০২৮টি স্তোত্র বিধৃত ছিল। যা সম্ভবত ১৫০০ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে রচিত ও গ্রন্থিত। পরে যে তিনটি বেদ রচিত হয়, তা মূলত ঋকবেদেরই ধারক ও বাহক। যেমন, সামবেদ ঋকবেদের কয়েকটি স্তোত্র সংকলিত আছে, যা ঐতিহাসিকদের কাছে মূল্যহীন। যজুর্বেদ (ঋকবেদের দুই শতাব্দী পরে সংকলিত) ঋকবেদের বলিয়ান বিষয়ক বিস্তৃত ব্যাখ্যা ও প্রক্রিয়া। আর অথর্ববেদ হল পুরোহিতদের ব্যবহারিক বিধানমালা।
ঋকবেদে বেশ কয়েকজন দেবীর বর্ণনা আছে। যেমন, পৃথ্বী, অদিতি, ঊষা, রাত্রি ও অরণ্যানী (বনদেবী)। পরবর্তীসময়ে আর্যজাতির আর একটি শাখা যখন ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে, তখন ইন্দো ইউরোপীয় ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে গ্রিক জিউস ও রোমান জুপিটারের ধারায় পুরুষ প্রকৃতিকে ধরে মাতৃদেবীর স্থলে, পিতৃদেব স্থান পায় এবং স্বর্গদেবতা দাউসের আবির্ভাব হয় যা পরবর্তীকালে ইন্দ্রের রূপ ধারণ করে। তারপর বায়ু, সূর্য, বিষ্ণু, অগ্নি, অশ্বিনী ইত্যাদির কথা এবং আনুষঙ্গিক আরও সব।
ডা. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের মতে, ‘হিন্দুধর্মের মূলভিত্তি বেদ। ঋগবেদ অর্থাৎ ঋকসংহিতা জগতের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ, যা তিলকের মতে ৪৫০০ খ্রি. পূর্বে রচিত। এখানে একটি মহাদেবের অর্থাৎ মহাদেবতা উপাসনার কথা আছে। ঋকবেদের পুরুষসুক্তের দ্বিতীয় মন্ত্রে রয়েছে : ‘পুরুষ এবেদং সর্বম যদ্ ভূতম যশ্চভ্রম্যম’ অর্থাৎ বর্তমানে যা আছে, অতীতে যা ছিল এবং ভবিষ্যতে যা হবে, সে সমস্তই পুরুষ। দীর্ঘতমা ঋষির মন্ত্রে ‘একং সদ্বিপ্রা বহুদা বদন্তি’—এই দেবতা একই, বিপ্রগণ বহু বলেন।’ হিন্দু ধর্মের ইতিহাস, সনাতন ধর্মের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত [ Short Introduction of Sanatan Hinduism ]
পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেন, ‘অনেক হিন্দু মনে করেন বেদ একটি প্রেরিত পুস্তক। ‘বিদ’ শব্দ থেকে ‘বেদ’ – উৎপত্তি। এটি সেকালের চলমান জ্ঞানের সংকলন মাত্র। সেকালে কোন পৌত্তলিকতা ছিল না, দেবতাদের জন্যও কোন মন্দির ছিল না। আস্তে আস্তে ঈশ্বর সম্বন্ধে মানুষের মনে ধারণা জন্ম নেয়। প্রথমে অলিম্পিয়ানদের মত ঈশ্বরের অবস্থান ছিল, পরে একেশ্বরবাদ, তারপর …-এর ধারণা বা মনিবাদের জন্ম। এসব ঘটনা ঘটতে প্রায় একশো বছর লেগে যায়। তারপর বেদের শেষে অবস্থা। অর্থাৎ বেদযুক্ত অস্ত থেকে বেদান্ত দর্শনের উৎপত্তি। আদিম বেদের কালে আর্যদের জীবন সম্পর্কে বেশি সচেতনতা ছিল, আত্মার প্রতি তত দৃষ্টি দেয়ার সময় ছিল না। পরে ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে মৃত্যুর পর জীবন সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মে, অর্থাৎ পুনর্জন্মবাদের উৎপত্তি হয়।’ (Discovery of India, page 59 )।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থসমূহের মধ্যে উপনিষদ বেদের সমান্তরাল না হলেও সন্নীকটবর্তী। উপনিষদ শব্দের অর্থ হল অতি নিকটে থেকে যে বিদ্যা গ্রহণ করতে হয়, একে ‘গুহ্যজ্ঞান’ও বলা হয়ে থাকে। ঈশ্বর কোথায় এবং কীভাবে বিরাজমান, মানুষ ও জগতের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক নিয়ে উপনিষদের মুখ্য আলোচনা। যে জ্ঞানের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সন্ধান পাওয়া যায় তাকেই উপনিষদ বলে। উপনিষদ হচ্ছে বেদের সারাংশ এবং বেদের সেই অংশ যেখানে শুধুমাত্র পারমার্থিক জ্ঞান নিয়েই উপদেশাবলী দেয়া হয়েছে।
উপনিষদে দেবতাদের কোন স্থান নেই, একমাত্র ব্রহ্মই বা ঈশ্বরই এর প্রধান আলোচ্য বিষয়। উপনিষদে বলা হয়েছে যে জগতের মূলে আছেন এক ব্রহ্ম। তিনি সত্য, চৈতন্যময় ও জ্ঞেয়; আর অন্য সমস্ত অসত্য, জড় ও অজ্ঞেয়। জীব এবং ব্রহ্ম এক, এই দুইয়ের কোন পার্থক্য নেই। ব্রহ্মের সাক্ষাৎ পেলেই জীবের মুক্তি হয়। ব্রহ্মপ্রাপ্তিই হচ্ছে জীবের একমাত্র কামনা। উপনিষদের মোট সংখ্যা এগারো। যেমন- ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুণ্ড্যক, মাণ্ডক্য, ঐতরেয়, তৈত্তিরীয়, ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক ও শ্বেতাশ্বর। হিন্দু ধর্মের ইতিহাস, সনাতন ধর্মের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত [ Short Introduction of Sanatan Hinduism ]
বৈদিক যুগের ধর্মদর্শনসমূহ খুবই কঠিন ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার কারণে সাধারণ ধর্মানুসারীগণ হিন্দুধর্মের প্রকৃত আশ্বাদ গ্রহণে ব্যর্থ হয়। বৈদিক যুগে অর্থাৎ যে সময়কালে বেদ প্রকাশিত হয়েছিল তখন পুজা অৰ্চনায় কোন মূর্তি বা দেবদেবীর প্রতিকৃতি ছিল না। হিন্দু ধর্মাচারসমূহকে অনুসারীগণের মধ্যে সহজবোধ্য করার লক্ষ্যে গল্প কথায় ধর্মকে সাধারণের কাছে পরিচিতকরণের কাহিনী রূপককেই পুরাণ বলা হয়। পুরাণ গ্রন্থে সাহিত্যের মধ্যে ধর্ম প্রকাশ পেয়েছে।
পুরাণ গ্রন্থসমূহের মূল সংখ্যা আঠারো। এগুলি যথাক্রমে ব্রহ্ম পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, শিব পুরাণ, লিঙ্গ পুরাণ, গরুড় পুরাণ, নারদীয় পুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবদ পুরাণ, অগ্নি পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, মার্কেণ্ডেয় পুরাণ, বামন পুরাণ, বরাহ পুরাণ, মৎস পুরাণ, কুর্ম পুরাণ ও ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ। এ গ্রন্থগুলোর রচনাকাল খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে সপ্তম খ্রিষ্টাব্দ সময়ের মধ্যে পৌরাণিক যুগে অর্থাৎ যে সময়ে পুরাণ রচিত হতে শুরু হয় তখন সনাতন ধর্মের মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হতে দেখা যায়।
বৈদিক ধর্ম ও দর্শনকে লোকায়ত চেতনার অনুসঙ্গী করার প্রচেষ্টায় পুরাণের উদ্ভব ঘটে। বৈদিক আর্যদের প্রধান ধর্মানুষ্ঠান ছিল দুশ্চর যজ্ঞকেন্দ্রিক। কিন্তু পুরাণ প্রণয়নকালে সেই ধর্মানুষ্ঠানকে পূজা-পার্বণ ও ব্রতকেন্দ্রিক করা হয়। পুরাণেই দেবদেবীদের মানবায়ন ও জীবের আকৃতি দেওয়া হয়। পুরাণেই হিন্দুধর্মের এখনকার বর্তমান প্রচলিত পৌত্তলিকতার বীজ রোপিত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, বেদ ও উপনিষদ বহির্ভূত বহু সংখ্যক দেবদেবীর কল্পনা, মূর্তি বা প্রতিমা নির্মাণ, বর্তমান পদ্ধতিতে তাদের পূজার্চনার পদ্ধতির উদ্ভাবন প্রভৃতি পুরাণেরই অবদান। অনুসন্ধানে দেখা যাবে যে, পুরাণের শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই হিন্দু সমাজের বর্তমান কাঠামোটি গড়ে উঠেছে। আবুল হোসেন ভট্টাচার্য মনে করেন, ‘মূর্তিপূজার সূচনা এখন থেকে পাঁচ হাজার বছরের ঊর্দ্ধে নয়’ (মূর্তিপুজার গোড়ার কথা)। আল বেরুনী তাঁর ভারত-তত্ত্ব গ্রন্থে হিসেবে করে দেখিয়েছেন যে মুলতানের রক্তবর্ণের চর্মাকৃত এবং রক্তবর্ণের চক্ষু-তারকা বিশিষ্ট আদিত্য (সূর্য) দেবের কাষ্ঠমূর্তিটি ‘কৃত্য’ যুগের শেষে নির্মিত হয়ে থাকলে এখন থেকে তার সময়ের ব্যবধান দাঁড়ায় ২,১৬,৪৩২ বছর। হিন্দু ধর্মের ইতিহাস, সনাতন ধর্মের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত [ Short Introduction of Sanatan Hinduism ]
পুরাণ সমূহের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে বিশ্বকোষের অভিমত : Purans disorderd geneologis of kings compounded with legends, put in present from fourth century A. D. and latter (W. L. Lenger)। ডব্লিউ এল লেঙ্গারের মতে, যিশুখ্রিষ্টের ৪০০ বছর পরে অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে পুরাণ রচিত হয়েছে। ডক্টর বেদপ্রকাশ উপাধ্যায়ের মতে, পুরাণ রচনার সময়কাল প্রায় ২,৫০২ খ্রি.পূ. ২৫৬৩ খ্রি. পূর্বের মধ্যকাল (“বেদ ও পুরাণের ভিত্তিতে ধর্মীয় ঐক্যের জ্যোতি’)। অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় ৩৫০০, ৪০০০ বছর পূর্বে পুরাণ রচিত হয়েছে। যাই হোক ‘বেদব্যাস মুনি কর্তৃক পুরাণ সমূহ প্রণীত হয়েছে’- এই দাবি সত্য হলে পুরাণ সমূহের বয়স পাঁচ হাজার বছরেরও কম সাব্যাস্ত করাই সমীচীন। তবে ভারতীয় ধর্ম দর্শনে পুরাণের চেয়ে উপনিষদের প্রভাবই বেশি। যার অনেক অনুকৃতিই আজ রাষ্ট্রীয় আদর্শেরই অঙ্গিভূত হয়েছে।
ভারতের প্রাশাসনিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আদর্শ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বহু উপনিষদীয় বাক্য। ভারতের রাষ্ট্রচিহ্ন অশোক চক্রের নিচেই সন্নিবেশিত য়েছে উপনিষদীয় বাণী ‘বহুজনহীতায়, বহুজনসুখায়’। ভারতীয় বীমা করপোরেশনে গৃহীত হয়েছে ‘যোগ ক্ষেমং বহাম্যহম্’। নৌবাহিনীর আদর্শ স্থির হয়েছে ‘সং নো বরুণঃ’। লোকসভার অধ্যক্ষের আদর্শ স্থির হয়েছে ‘ধর্মচক্রাপ্রবর্তনায়’ লোকসভার দ্বারে লিখিত হয়েছে ‘ন সা সভ্য যত্র ন সন্তি বৃদ্ধা, ন তে বৃদ্ধাঃ যেন বদন্তি ধর্মম্।’ পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায়ও এই শ্লোকটি পুরো উৎকীর্ণ হয়েছে। ডাক তার বিভাগের আদর্শ স্থির হয়েছে ‘অহর্নিশ সেবামহে।’ দার্জিলিং-এ হিমালয়ে আরোহণের কেন্দ্রের আদর্শ সংস্থানেও স্থিরীকৃত হয়েছে উপনিষদীয় বাক্য। হিন্দু ধর্মের ইতিহাস, সনাতন ধর্মের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত [ Short Introduction of Sanatan Hinduism ]
শুধু ভারতবর্ষ নয় থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলের লোকজীবনের নৈতিক আদর্শ উপনিষদ, গীতা, মহাভারত ও রামায়ণ প্রভাবিত। যেমন: হিতোপদেশ-এর বাক্যটি…
অয়ং নিজঃ পরো বেতি গণনা লঘুচেতসাম্। উদারচরিতানান্তু বসুধৈব কুটুম্বকম্।
অর্থাৎ লঘুচিত্তের মানুষেরাই আপন-পর গণ্য করে, কিন্তু উদারচিত্তের মানুষ বিশ্বের সকলকেই আপন করে নেয়। এই উপমহাদেশের সর্বধর্মচর্চা ও গবেষণার প্রাচীন প্রতিষ্ঠান চেন্নাইয়ের থিওসফিক্যাল সোসাইটিরও আদর্শ গ্রহণ করা হয়েছে উপনিষদীয় ‘সত্যান্নাস্তি পরোধর্মঃ—সত্যের চেয়ে বড়ো কোন ধর্ম নেই– এই বাক্য।
হিন্দুধর্মে সহায়ক স্তরের ধর্মগ্রন্থসমূহকে বলা হয় ‘স্মৃতিশাস্ত্র’। সংস্কৃত ‘স্মৃতি’ শব্দের অর্থ হচ্ছে স্মরণ বা ইংরেজিতে Memory। এতে হিন্দুদের জীবন প্রণালী নির্বাহের দিক-নির্দেশনা আছে। ঋষি, মনু, যাজ্ঞবল্ক্য ঋষিগণ স্মৃতি থেকে হিন্দু জীবন কীভাবে কাটাতে হবে সে সম্পর্কে বর্ণনাই হচ্ছে স্মৃতিশাস্ত্র।।
খ্রিষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতকের বড় সাহিত্য হল বেদ। পরিপূর্ণ দশ হাজারের বেশি শ্লোকের সমাহার। সমাজ জীবনের সম্পূর্ণ চিত্রও মেলে বেদে। মানুষে মানুষে প্রকারভেদ আজও তেমন কোন তারতম্য ঘটেনি। মানব প্রকৃতির চিত্রও এক। ‘সাংমনস্য’ শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে রচিত সূত্র পারিবারিক, অর্থাৎ তখনও সব পরিবারে নিরন্তর সুখ, শান্তি ছিল না। যা আজও তেমনই আছে। বৈদিক চরিত্রগুলিও ছিল বিশ্বাসযোগ্য। বেদে বহু তথ্য আমরা পাই উদ্ভিজ, প্রাণিজ, খনিজ কর্মবিভাগ, জাতিভেদ, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, অবিশ্বাস সবই পাই বেদে।
প্রকৃতি, সমাজ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন সাধনার সন্ধানও মেলে। দুঃখ দারিদ্রও স্মরণ করতে হলে ঋষি বামদেবের কথা বলা যায়। তিনি বলছেন, ‘অভাবে কুকুরের নাড়িভুঁড়ি রান্না করে খেয়েছি।’ চণ্ডালের পরিত্যক্ত ওই নাড়িভুঁড়ি খেতে হয়েছে ঋষিকে। অর্থাৎ বেদে ক্ষুধা, * অনাহারের কথা বহু বহুবার উচ্চারিত- যা আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বৈদিক সমাজব্যবস্থার বিশেষ বিশেষ অংশে বর্তমানের সঙ্গে সাযুজ্য আছে।
বেদের পঁচাত্তরভাগ সৃক্তই (শ্লোকসমষ্টি) প্রার্থনা নির্ভর। বাকি পঁচিশ ভাগের মধ্যে বেশ কিছু অংশ উন্নত চিন্তার পরিচায়ক। সে অর্থে, সর্বদিক থেকেই বেদ প্রাচীনকালের অনবদ্য প্রতিরূপ। বেদেই প্রথম ভারতীয় ভাষায় সাহিত্য চিন্তাধারার বিকাশ। এক কথায় বেদ এক অপরিহার্য উত্তরাধিকার।
অধিকাংশ হিন্দুর গার্হস্থ্য জীবনে অনুসৃত এক মহাকাব্যিক আখ্যান রামায়ণ। রচয়িতা কে ও রচনা-কাল কখন? ডক্টর সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতে: রচনাকালের দিক থেকে দেখলে রামায়ণ খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় দশকের মধ্যে রচিত; মহাভারত রচনা সম্ভবত শুরু হয়। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম বা চতুর্থ শতক থেকে এবং শেষ হয় খ্রিষ্টীয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে। অর্থাৎ বুদ্ধের পরের আট বা ন-শ বছরের মধ্যে এ দুটি মহাকাব্য রচিত হয়; এদের মধ্যে মহাভারত আগে শুরু হয়ে পরে শেষ হয়, রামায়ণ পরে শুরু হয়ে আগে শেষ হয়; আগে পূর্ণকলেবর মহাকাব্যের রূপ পায় বলেই সম্ভবত এর নাম আদিকাব্য।
মনে রাখতে হবে, রামায়ণ শেষ হবার কাছাকাছি সময়ে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে : কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বাৎস্যায়নের কামসূত্র, শ্রীমদ্ভগবদগীতা এবং মনুসংহিতা এই ক্রান্তিকালের রচনা এবং এর কিছু পরেই শুরু হয়ে যায় পুরাণগুলির রচনা। রামায়ণ ও মহাভারতে পরবর্তী সংযোজিত অংশগুলি অভিপৌরাণিক অর্থাৎ পুরাণে প্রতিফলিত যে সামাজিক মূল্যবোধ ও শাস্ত্রীয় অনুশাসনের সমাবেশে ভারতীয় ধর্মচিন্তা, তার বিবর্তিতরূপে ক্রমে ‘হিন্দুধর্ম’ বলে অভিহিত হল, এই অভিপৌরাণিক অংশেই আমরা সেগুলির সাক্ষাৎ পাই।

ম্যাক্সমুলারের মতে, খ্রিষ্টের জন্মের ১০০০ বৎসরেরও পূর্বে রচিত ঋগ্বেদই সমগ্র সভ্য জগতের আদি গ্রন্থ। ‘On thing is certain; there is nothing more ancient and primitive, not only in India, but in whole Aryan world that the hymns of the Rig-Veda”? (Maxmuller, The Origin and Growth of Religion)। হিন্দু ধর্মমতে ঈশ্বর ত্রিতাত্ত্বিক। ঈশ্বর সৃষ্টির প্রয়োজনে নিজকে বিভক্ত করে বিষ্ণু, ব্রহ্মা ও শিব হলেন। ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু পালনকর্তা আর শিব হলেন ধ্বংসকর্তা। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সকল কিছুর নিয়ন্তা। তিনি শুদ্ধ, অনন্ত, সর্বজ্ঞ, করুণাময়, জ্যোতির্ময়, আনন্দময় ও পরমপবিত্র। তাঁরই নির্দেশে চন্দ্র সূর্য পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণীকুলের পোষণ করে থাকে, আগুন উত্তাপ দেয়, জল তৃষ্ণা নিবারণ করে এবং বাতাস প্রবাহিত হয়।
পৃথিবীতে আমরা প্রকৃতির যে বিস্ময়কর রূপ প্রত্যক্ষ করি, তা ঈশ্বরেরই প্রতিরূপ। প্রাণী জগতের বৈচিত্র্য ঈশ্বরেরই বৈচিত্র্য। তিনি জীবের মধ্যে আত্মারূপে অবস্থান করেন। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করে ঈশ্বর তার মধ্যে শক্তিরূপে প্রবেশ করেছেন। তাঁর শক্তির প্রকাশ ঘটে মহামারা বা প্রকৃতির মধ্যে। তিনি নিজের আলোতে নিজে প্রকাশিত হন এবং অপরকে প্রকাশ করেন। ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজিত। তিনি অন্তর্যামী। তাঁকে পাবার জন্য দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। মানুষের অন্তরের অন্তস্থলে তিনি অধিষ্ঠিত। দেবদেবীগণ হচ্ছেন ঈশ্বরের একক ঐশ্বরিক সত্তার বিভিন্ন রূপক। গীতায় স্বয়ং ভগবান বলেছেন : ‘যে যথামাং প্রপদ্যন্তে তাং স্তথৈব ভজাম্য।’ (৪/১১) অর্থাৎ যে আমাকে যেভাবে ভজনা করে, আমি তাকে সেভাবেই ভজনা করে থাকি।
এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের আকাঙ্ক্ষা ও বাসনা পূর্ণতা লাভ করেছে। এজন্য সৃষ্টিকে রক্ষা বা পূর্ণতা প্রদানের জন্য তাঁকে দেহ ধারণ করে সাকার রূপ পরিগ্রহ করে পৃথিবীতে অবতরণ করতে হয়। এইরূপ ছয়টি স্তরে ঈশ্বরের অবতরণ বা অবতার রূপ আছে। কৃষ্ণ, বামন, নরসিংহ, রাম ঈশ্বরের অবতার রূপ। ঈশ্বরের দুটি লীলা— একটি সৃষ্টি লীলা, অপরটি অবতাররূপে মধুর খেলা। সৃষ্টির ধ্যানে ঈশ্বর যখন মগ্ন থাকেন, তখন তিনি নিরাবয়ব। সৃষ্টি আরম্ভ হলেই তিনি সাকার হন ও দেহ ধারণ করেন। তখনই দেহধর্ম পালনের জন্য জন্ম ও মৃত্যু অবধারিত হয়।
এভাবেই শ্রীকৃষ্ণ অধর্ম ও দুর্জনের বিনাশের জন্য দ্বাপর যুগে ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে বসুদেব ও দেবকীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর বলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ বিশ্বাস করেন। ঈশ্বর ও ভগবান সমার্থক হওয়ায় কৃষ্ণকে ভগবান ডাকা হয়। হিন্দুধর্মের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে কৃষ্ণের উল্লেখ আছে। কৃষ্ণ চরিত্রটি খুবই বৈচিত্র্যময়। ঈশ্বর হয়েও মানুষের প্রয়োজেন তিনি দেহ ধারণ করেছিলেন। মানুষের মাঝে আদর্শ পুরুষের প্রতিভূরূপে তাঁর জীবন বিধৃত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের ১০৮টি নাম। মানুষের জন্য তিনি যে ধর্ম দিয়েছেন তা রক্ষার জন্য মানুষের দেহ ধারণ
করে তিনি পৃথিবীতে বারবার আসেন। মূলত যোগ, কর্ম, জ্ঞান এবং ভক্তি— এ চারটিই হিন্দু ধর্মের পথ। কর্ম হিসেবে সকাম এবং নিষ্কাম এ দুভাগে বিভক্ত। সকাম ভোগের পথ, আর নিষ্কাম ত্যাগের পথ। ভোগ হল প্রবৃত্তি মার্গ আর ত্যাগ হল নিবৃত্তি মার্গ। ঋগ্বেদে একাধিক দেব-দেবীর উল্লেখ পাওয়া গেলেও অতি প্রাচীনকাল থেকে হিন্দুধর্মে একেশ্বরবাদের প্রভাব লক্ষণীয়। তবে বৈদিক যুগের পর পৌরাণিক যুগের এ ধর্মে বহু দেব-দেবীর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। পুরাণে ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু পালন কর্তা শিব সংহারকর্তা। পরম সত্তাকে হিন্দু ধর্মে এক পরম পুরুষরূপে কল্পনা করা হয়েছে।
![হিন্দু ধর্মের ইতিহাস, সনাতন ধর্মের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত । Short Introduction of Sanatan Hinduism 7 Lord Ganesha images, Sri Ganesh, Ganesh, Ganesha, Ganpati, Gajavaktra [ West says The Elephant God of India ] 2](https://sanatangoln.com/wp-content/uploads/2021/10/Download-photo-of-India-Elephat-God-Ganesh-Sri-Ganesh-Ganesha.-Ganpati-Gajavaktra-2-212x300.jpg)
ঈশ্বর হলেন পুরুষোত্তম। ঈশ্বর সর্বজ্ঞ। ঈশ্বর ভগবান। ঈশ্বর অন্তবর্তী হলেও অতিবর্তী। তিনি পরম সুন্দর। তিনিই সৃষ্টিকর্তা, তিনিই রক্ষক, তিনিই ত্রাণকর্তা। হিন্দুধর্মে একেশ্বরবাদ, অদ্বৈতবাদ, সর্বেশ্বরবাদ, অবতারবাদ ইত্যাদি কল্পনা করা হয়েছে। বিশিষ্ট ধর্মতত্ত্ববিদ, M. Vendata Ratnam বলেন : “হিন্দু ধর্ম বহু ধর্মের সমন্বয়, যেমন: শৈবধর্ম, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, বহুদেববাদ, একেশ্বরবাদ, পৌত্তলিকতাবাদ প্রভৃতি।’ বেদের অনুবাদক ম্যাক্স মূলার (Max Muller) একটি উক্তির মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের দেবতাতত্ত্ব ও বহু ঈশ্বরবাদ সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছিলেন: “আসলে বেদের যে দেবতা তত্ত্ব তাকে বহু ঈশ্বরবাদ (Polytheism) বলে আখ্যায়িত না করে, এক পরম সত্তার বহু দেবতার মিল (Henothism) বলাই শ্রেয়’।
হিন্দু ধর্ম আত্মাবাদকে স্বীকার করে। এতদ্সঙ্গে সত্তার পুজাকেও স্বীকৃতি দেয়। বর্ণাশ্রমকে হিন্দু ধর্ম খুবই প্রাধান্য দেয়। সমাজের মানুষদের তাদের কর্ম বা পেশা হিসেবে (Division of Labour) দেখানো হয়েছে। যথা : ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। এই চারটি বর্ণকে এক কথায় বললে বলা যায় সংস্কৃতির ধারক ও সংরক্ষক হল ব্রাহ্মণ, রাজ্য শাসন ও শত্রু নিধনের কাজ হল ক্ষত্রিয়ের, সমাজের অর্থনীতি সুরক্ষা ও উন্নতি সাধন বৈশ্যর কাজ; আর এই তিন শ্রেণির লোককে সেবা করা শূদ্রের কাজ। প্রাচীন হিন্দু সমাজের এই কর্মবিভাজন থেকেই সমাজ ও শ্রেণি বৈষম্যের উৎপত্তি ঘটে। আধুনিক বিশ্বে প্রত্যেক ক্ষেত্রে যে কর্মবিভাজন দেখা যায় তা এ থেকেই সৃষ্ট। হিন্দু ধর্মের পরম ও চরম প্রাপ্তি ব্রহ্ম এবং মোক্ষ লাভ।
বৌদ্ধ মত বা দর্শনে মূর্তি পূজার কোন অবকাশ নেই। তবে কথিত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারিরা বুদ্ধ মূর্তি পূজা করে থাকেন। এখানে মনে রাখা দরকার বৌদ্ধ ধর্ম কথিত বৌদ্ধ অনুসারীদের সৃষ্টি কিন্তু বৌদ্ধ মত বা বৌদ্ধ দর্শন বুদ্ধেরই। ফলে বৌদ্ধ ধর্ম আর বৌদ্ধ দর্শন এক কথা নয়।
যেমনটা আমরা দেখতে পাই সনাতন ধর্মে বা হিন্দু ধর্মে। হিন্দু ধর্মানুসারীরা নানা দেব-দেবীর মূর্তি নির্মাণ করে সেই মূর্তিতে অৰ্চনা দেয়। যেন ভাবটা এমন যে, এই পূজা-আর্চনার কারণেই দেবতা তুষ্ট হয়ে আশীর্বাদ করবে পূজারিকে। যদিও ‘বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করা বা তাঁদের সেবা করা ভগবদ্গীতাতে অনুমোদন করা হয়নি।’ গীতার সপ্তম অধ্যায়ের বিংশতি শ্লোকে বলা হয়েছে
কামৈস্তেস্তৈহতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ।
তংতং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।। (ভগবদ্গীতা : ৭/২০) অর্থাৎ— যাদের মন জড় কামনা বাসনার দ্বারা বিকৃত, তারা অন্য দেব দেবীর শরণাগত হয় এবং তাদের স্বীয় স্বভাব অনুসারে নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করে।

এখানে পরিষ্কারভাবেই বলা হয়েছে যে, যারা কামনা বাসনার দ্বারা পরিচালিত হয়, তারা পরমেশ্বর ভগবান শ্রী কৃষ্ণের সেবা না করে বিভিন্ন দেব দেবীর পূজা করে। এই শ্লোকের তাৎপর্য হল— ‘যারা সর্বোতভাবে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পেরেছে, তারাই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করে তাঁর প্রতি ভক্তিযুক্ত হয়।
যতক্ষণ পর্যন্ত জীব জড় জগতের কলুষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে না পারছে ততোক্ষণ সে স্বভাবতই অভক্ত থাকে। কিন্তু তবুও বিষয়বাসনার দ্বারা কলুষিত থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ ভগবানের প্রতি উন্মুখ হয়, তখন সে তাঁর বহিরাঙ্গ প্রকৃতি মায়ার প্রতি আকৃষ্ট হয় না; যথার্থ লক্ষ্যের প্রতি উত্তরোত্তর অগ্রসর হতে হতে সে শীঘ্রই প্রাকৃত কাম-বিকার থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত হয়। শ্রীমদ্ভাগবতে তাই বলা হয়েছে
অকামঃ সর্বকামো বা মোক্ষকাম উদারধীঃ
তীব্রেণ-ভক্তিযোগেন যজেত পুরুষং পরম।। (ভগবদ্গীতা : ২/৩/১০)
অর্থাৎ— যেসব স্বল্পবুদ্ধি মানুষের পারমার্থিক জ্ঞান অপহৃত হয়েছে, তারাই বিষয়-বাসনার তাৎক্ষণিক পূর্তির জন্য দেবতাদের শরণাপন্ন হয়।
সাধারণত এই স্তরের মানুষেরা ভগবানের শরণাগত হয় না, কারণ রজ ও তমোগুণের দ্বারা কলুষিত থাকার ফলে তারা বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনার প্রতি অধিক আকৃষ্ট থাকে এবং দেবোপাসনার বিধি-বিধান পালন করেই তারা সন্তুষ্ট থাকে। বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসকেরা তাদের তুচ্ছ অভিলাষের দ্বারা এতই মোহাচ্ছন্ন থাকে যে, তারা পরম লক্ষ্য সম্পর্কে অনভিজ্ঞ থাকে। ভগবানের ভক্ত কিন্তু কখনই এই পরম লক্ষ্য থেকে ভ্রষ্ট হন না।
শ্রীমদ্ভাগবতে তাই বলা হয়েছে
সর্বধর্মান পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।’ ।। (ভগবদ্গীতা : ১৮/৬৬) অর্থাৎ— ‘সবকিছু পরিত্যাগ করে আমার শরণাগত হও।’
শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে বলা হয়েছে—
‘একলা ঈশ্বর কৃষ্ণ, আর সব ভৃত্য’ (আদি ৫/১২৪)। তাই শুদ্ধ ভক্ত কখনো তাঁর বিষয়-বাসনা চরিতার্থ করবার জন্য অন্যান্য দেব-দেবীর কাছে যান না।
গীতায় ধর্মসংস্কারচিন্তা:
খ্রিষ্টীয় অষ্টম-নবম শতকে এদেশের উচ্চবর্গের সমাজপতিরা উপলব্ধি করেছিলেন যে খ্রিষ্টধর্মের বাইবেল বা ইসলাম ধর্মের কোরান-এর মত হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কোন একটি মৌলিক শাস্ত্রগ্রন্থ নেই। রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের মাধ্যমে, আর আরব আক্রমণের ফলে, বাইবেল ও কোরান-এর গুরুত্ব সম্বন্ধে তাঁরা অবহিত হয়েছিলেন, আর হিন্দু ধর্মের সুরক্ষার জন্য এরকম একটি মৌলিক ধর্মগ্রন্থের অবশ্য প্রয়োজনীয় উপলব্ধি করেছিলেন, যার মধ্যে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মূল সামাজিক ও আধিবিদ্যক বক্তব্য ও অনুশাসনগুলি ঈশ্বরের বিধান হিসেবে সংক্ষেপে এক সঙ্গে পাওয়া যাবে।
শংকরাচার্য (৭৮৮-৮২০ খ্রি.) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গীতাশাস্ত্রই সেই ধর্মগ্রন্থ। বৌদ্ধ ধর্ম প্রতিরোধেও ভগবদ্গীতা এক বিশেষ ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। গবেষকরা মনে করেন ভগবদ্গীতা শুধুমাত্র বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্য করেই রচিত হয়নি। স্লেচ্ছঅনার্য, ভূমিপুত্র অনার্য, এবং লোকায়তসহ সমস্ত বিধর্মী এবং নাস্তিকদের লক্ষ্য করেই রচিত হয়েছিল। তাছাড়া আর্যসমাজের অন্তর্গত শূদ্রদের বশে রাখাও ছিল গীতা রচনার অন্যতম উদ্দেশ্য। এজন্য গীতায় শ্রীভগবানের মুখে অসুর প্রকৃতির সমস্ত মানুষের, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যধর্ম গ্রহণ করতে যে অগণিত অনার্য ও শূদ্র অসম্মত ছিল তাদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ পরিণতির এবং নরকভোগের সতর্কবাণী বারবার উচ্চারিত হয়েছে।
আবার অন্যদিকে আত্মার অবিনশ্বরতা ও জন্মান্তর, যাগযজ্ঞের এবং নিত্যকর্মের অবশ্য প্রয়োজনীয়তা, চাতুবণের দৈব উৎপত্তি, শূদ্র ও নারীর আর্থসামাজিক হীনস্থান, ঈশ্বরে ভক্তি ও আত্মসমার্পণ এবং নিষ্কাম কর্মের তত্ত্ব প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্যধর্মের কতকগুলি মৌলিক তত্ত্ব উপাদানের জোরালো ঐশ্বরীয় সমর্থনও ভগবদ্গীতায় ব্যক্ত হয়েছে। পৃথিবীর দুষ্কৃতীদের বিনাশ এবং সাধুদের পরিত্রাণ করবার উদ্দেশ্যে শ্রীভগবান অবতাররূপে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের এই বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাসের কারণেই ভগবদ্গীতা হিন্দুদের ঘরে ঘরে সমাদৃত। গীতার জ্ঞানযোগ সংক্রান্ত চতুর্থ অধ্যায় শ্রীভগবানের মুখেই উচ্চারিত হয়েছে সেই বিখ্যাত উক্তি :
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।। (গীতা ৪/৭-৮)
যখন যখন ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যূত্থান হয়, হে ভারত, তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করি। সাধুদের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতীদের বিনাশ, এবং ধর্ম সংস্থাপন করবার উদ্দেশ্যে আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
আঠার দিনব্যাপী সংঘটিত কৃরুক্ষেত্র (বর্তমান হরিয়ানা) যুদ্ধের প্রাঙ্গণে শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর সখা অর্জুনের মধ্যে যে সংলাপ হয়েছিল- সেই সংলাপের সমন্বিত রূপই শ্রীমদ্ভবদ্গীতা। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর এক গবেষণার প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছেন, আদিতে হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম ধর্মে কোন পার্থক্য ছিল না। এই দুই ধর্মের চিন্তা-চেতনাও এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তা’আলার দিকে প্রসারিত ছিল। এই দুই ধর্মই নিরাকার একেশ্বরবাদী এক স্রষ্টায় সমর্পিত। পরবর্তীকালে ইশ্বরোপসায় যে-আকৃতি আরোপ করেছে তা স্বাতন্ত্র্য স্বার্থের সংযোজন মাত্র। বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইহুদি ইত্যাদি ধর্মেও তাই।
দৃষ্টান্তস্বরূপ হিন্দু ধর্মের শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় উল্লিখিত বিখ্যাত শ্লোক ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত’- এর প্রক্ষিপ্ত অংশের উদ্দেশ্য এবং পরবর্তীকালে এর প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তির পূর্বাপর তথ্যের ইতিবৃত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, শ্লোকটি মূলে একরূপ ছিল, পরবর্তী যুগে শাস্ত্রকারদের হাতে বিকৃত হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, দশম শতকের বিখ্যাত পণ্ডিত অভিনব গুপ্ত তাঁর সম্পাদিত শ্রীমদ্ভগবদ গীতা সংকলনে হিন্দু ধর্মে অবতারবাদের সমর্থনে শ্লোকটির বিকৃতি ঘটায়। পূর্বে শ্লোকটি ছিল :
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতে ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মংশং সৃজম্যহম্।।
পরবর্তীকালে এই শ্লোকটি পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় :
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।
এর ফলে শ্লোকটির অর্থ যেখানে ছিল- যখনি ধর্মে গ্লানি উপস্থিত হয় ধর্ম সংস্থাপনার্থে শ্রীভগবান স্বীয় আত্মার অংশে (সৃষ্ট) অবতার প্রেরণ করেন। পরিবর্তিত অর্থে সেখানে হয়েছে যখনি ধর্মের গ্লানি উপস্থিত হয় ধর্ম সংস্থাপনার্থে শ্রীভগবান স্বয়ং অবতাররূপে অবতীর্ণ হন। ফলে স্রষ্টা সৃষ্টিকর্তার স্থান থেকে নেমে এসে সৃষ্টবস্তুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। যা সকল ধর্ম মতের বিরোধী। প্রথম শ্লোকে (মূল শ্লোকে) তদাঅংশং’ থেকে ‘তদাত্মানং’-এ রূপান্তরের ফলে নিরাকার একেশ্বরের অনুভূতি পৌত্তলিকতায় রঞ্জিত হয়ে যায়। এভাবে মূল ‘তৌহিদবাদী’ হিন্দু ধর্মমতও পৌত্তলিক ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে। মূলে তা ছিল না। (মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ‘ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের মিলন ভূমি’, উদ্বোধন, অগ্রহায়ণ, ১৩৪০/১৯৩৭ বঙ্গাব্দ)।
সহায়ক গ্রন্থাবলি
ঋগ্বেদ সংহিতা (দ্বিতীয় খণ্ড) অনুবাদক; রমেশচন্দ্র দত্ত; কলকাতা, প্র.প্র. ১৯৭৬ স্বামী রঙ্গনাথানন্দ, উপনিষদের সন্দেশ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পঞ্চম পুনর্মুদ্রণ, ২০০৫
বিমলকৃষ্ণ মতিলাল, নীতি যুক্তি ও ধর্ম (কাহিনী সাহিত্যে রাম ও কৃষ্ণ); আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লিমিটেড, কলকাতা, বৈশাখ, ১৩৯৫
ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, মানবধর্ম; প্রভু জগদ্ববন্ধু মহাপ্রকাশ মঠ, ঢাকা ১৯৯৩ ক্ষিতিমোহন সেন, হিন্দুধর্ম; প্রথম আনন্দ সংস্করণ, কলকাতা, ২০১৯ পরমেশ চৌধুরী, বেদের ভবিষ্যদ্বাণী এবং ইসলাম ধর্ম; সাগ্নিক বুকস, কলিকাতা, ২০১৫ মহানামব্রত ব্রহ্মাচারী, মানবধর্ম; শ্রীমহানামব্রত কালচারাল এণ্ড ওয়েলফেরার ট্রাস্ট, শ্রীশ্রীমহানাম অঙ্গন, রঘুনাথপুর (বাগুইহাটী) কলিকাতা, অ. সং ১৪০৮ বঙ্গাব্দ আবদেল মাননান, ফকির লালন শাহের সৃষ্টিতত্ত্বের গান; ধ্যানবিন্দু, ঢাকা, প্র.প্র. ২০১৭
আরও পড়ুন: