মানুষের জীবনে নামের গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু পরিচয়ের জন্য নয়, নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আধ্যাত্মিক শক্তি, ভক্তির গভীরতা ও আত্মশুদ্ধির উপায়। হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ভগবানের নাম উচ্চারণের মধ্য দিয়েই পাপ ধ্বংস হয়, মন পবিত্র হয় এবং মানুষ মুক্তির পথ খুঁজে পায়। নামস্মরণের মাহাত্ম্য এতই গভীর যে, এক দস্যু রত্নাকরও নামজপের প্রভাবে মহর্ষি বাল্মীকি রূপে অমর হয়ে আছেন।
আজকের আলোচনায় আমরা দেখব— কীভাবে নামজপ মানুষের অন্তরকে পরিবর্তন করে, পাপ থেকে মুক্ত করে এবং তাকে সত্য, সুন্দর ও শুভের পথে পরিচালিত করে। নাম মাহাত্ম্যের এই অলৌকিক শক্তিই মানুষের জীবনে আশ্রয়, অনুপ্রেরণা ও আলোকবর্তিকা।
নাম মাহাত্ম্য
অনেক কাল আগের কথা। চ্যবন মুনির পুত্র রত্নাকর মুনিপুত্র হয়েও ছিল দুর্ধর্ষ দস্যু। সে লোহার গদা নিয়ে বনের মধ্যে লুকিয়ে থাকত। কোন পথিক তার নাগালের মধ্যে এলেই তাকে হত্যা করে তার সর্বস্ব লুণ্ঠন করত। এই ছিল তার জীবিকা। এভাবে সে অনেক দিন ধরে বহু পথিককে হত্যা করে চলেছিল। একদিন সন্ন্যাসীর বেশ ধরে ব্রহ্মা আর নারদ সেই বনপথে আবির্ভূত হলেন।
বিকেল বেলা । রত্নাকর ধরেই নিয়েছিল সেদিন সে আর কোন পথিকের দেখা পাবে না। সন্ন্যাসী দুজনকে দেখে সে আশান্বিত হয়ে উঠল। গদা হাতে সে ধেয়ে এল। ব্রহ্মার মায়ার প্রভাবে রত্নাকর দস্যু গদা তুলতেই পারল না। তুলবে কি করে? তার ডান হাতই যে অবশ হয়ে গেছে। শত চেষ্টা করেও সে হাত নাড়তে পারল না । ব্রহ্মা তখন হেসে বললেন,
– হে দস্যু, তুমি তো আমাদের হত্যা করতে এসেছ। তুমি কি জান না নরহত্যা মহাপাপ? তুমি দিনের পর দিন এই মহাপাপ করে চলেছ। কেউ কি তোমার এ পাপের ভাগী হবে?
রত্নাকর বলল,
– পাপ-পুণ্য আমি জানি নে। আমি পথিকদের হত্যা করে যা পাই, তা দিয়ে বাবা, মা আর স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করি । নরহত্যা যদি পাপ হয়, তা হলে যারা আমার উপার্জনে বেঁচে রয়েছে, তারাও আমার পাপের ভাগী অবশ্যই হবে। রত্নাকরের এ কথা শুনে ব্রহ্মা
হাসিমুখে বললেন,
– না হে দস্যু, অন্য কেউ তোমার পাপের ভাগী হবে না। যদি আমার কথা তোমার বিশ্বাস না হয়, তাহলে বাড়ি গিয়ে তোমার বাবা- মা আর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস কর। তারপর এসে আমাদের বল । আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।
রত্নাকর বলল,
– হ্যাঁ, আমি তোমাদের রেখে বাড়ি যাই, আর তোমরা পালাও!
– না, না, পালাব কেন? তুমি আমাদের ঐ গাছের সাথে বেঁধে রেখে যাও । কথাটা রত্নাকরের মনে ধরল। সে ব্রহ্মা আর নারদকে একটা গাছের সাথে বেঁধে রেখে বাড়ি গেল । বাড়ি গিয়ে রত্নাকর প্রথমে গেল বাবার কাছে।
বাবাকে সে জিজ্ঞেস করল,

– বাবা আমি দস্যু। মানুষ মেরে যা পাই, তা দিয়ে সংসার চালাই। এতে নাকি আমার পাপ হয়? যদি পাপই হয়, তাহলে আপনি কি আমার পাপের ভাগী হবেন?
– বাবা রত্নাকর, আমি বুড়ো হয়েছি। এখন আর খাটতে পারি নে। আমি অসহায়। তুমি আমার পুত্র। সবল যুবক। এখন তুমি আমাকে প্রতিপালন করবে, এই তো সমাজের নিয়ম। তুমি এ জন্যে পাপ করবে, সমাজ তো তা বলে দেয় নি। তুমি কোন পথে উপার্জন করছ, তা তোমার ব্যাপার । আমি তোমার পাপের ভাগ নিতে যাব কেন ?
পিতার কথা শুনে রত্নাকর চিন্তিত হল। চিন্তা করতে করতে সে গেল তার মায়ের কাছে। মাকেও সে একই প্রশ্ন করল। মা বললেন,
– বাছা, আমি তোমার মা। মায়ের ঋণ কোন সন্তানই শোধ করতে পারে না। মাকে ভরণ-পোষণ করা সমর্থ ছেলের কর্তব্য। তোমার কর্তব্য তুমি করছ। তোমার পাপের ভাগ আমি তো নিতে পারি নে বাছা!
শেষে রত্নাকর গেল তার স্ত্রীর কাছে। তার স্ত্রী বলল,
– দেখ। আমি তোমার স্ত্রী—সহধর্মিনী। স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ করা স্বামীর ধর্ম। আমাকে ভরণ-পোষণ – করতে গিয়ে তুমি যদি পাপ কর, সে পাপ আমার ওপর বর্তাবে না। তবে তোমার পুণ্যের ভাগ আমি পাব। পিতা-মাতা ও স্ত্রীর কথা শুনে রত্নাকর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। সন্ন্যাসীরা তো ঠিকই বলেছে। যাদের ভরণ-পোষণের জন্য সে পাপ করছে, কেউ তার পাপের ভাগী হবে না? এখন সে কেমন করে এ মহাপাপ থেকে উদ্ধার পাবে? অনুশোচনায় দগ্ধ হতে লাগল সে।
চ্যবন মুনির পুত্র রত্নাকর মুনিপুত্র হয়েও বনপথে দস্যুবৃত্তি করে জীবিকা অর্জন করত। একদিন | সন্ন্যাসীবেশে ব্রহ্মা ও নারদ তার কাছে এলেন। ব্রহ্মার কাছ থেকে রত্নাকর জানতে পারল যে, তার পিতা, মাতা, স্ত্রী প্রভৃতি পোষ্যদের কেউ তার পাপের ভাগী হবে না। তখন নিজের মহাপাপের ভয়াবহ পরিণতির কথা ভেবে তার অনুশোচনা হল ।
মহাপাপের ভয়াবহ পরিণতির দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে রত্নাকর ছুটে গেল বনে, যেখানে সে সন্ন্যাসীদের গাছের সাথে বেঁধে রেখে বাড়ি এসেছিল। কাঁদতে কাঁদতে সে সন্ন্যাসীদের বাঁধন খুলে দিল। তারপর সন্ন্যাসীরূপধারী ব্রহ্মাকে বলল
– আমার পিতা, মাতা ও স্ত্রীর মধ্যে কেউ আমার পাপের ভাগ নেবে না। আমি মহাপাপী, আমি মহাপাপী! আমি কিভাবে এই পাপ থেকে মুক্তি পাব, দয়া করে আমাকে বলে দিন। ব্রহ্মার পায়ে পড়ে সে বিলাপ করতে লাগল।
রত্নাকরের কান্না দেখে ব্রহ্মার মন সিক্ত হল করুণায়। তিনি বুঝলেন, রত্নাকরের মনে কৃত পাপের জন্য অনুশোচনা এসেছে। অনুশোচনা পাপ থেকে মুক্তির প্রথম সোপান ।
ব্রহ্মা রত্নাকরকে আশ্বস্ত করলেন। তিনি তাকে বললেন,
– ওঠ, রত্নাকর। তোমার পাপ দূর করার ব্যবস্থা আমি করছি। যাও, পুকুর থেকে স্নান করে এস।
রত্নাকর পুকুরে গেল স্নান করতে। কিন্তু, একি! তার সামনে থেকে পুকুরের জল শুকিয়ে যাচ্ছে। জলের অভাবে তার স্নান হল না। স্নান না করেই সে ব্রহ্মার কাছে ফিরে এল। ব্রহ্মা তখন তাঁর কমণ্ডলু থেকে রত্নাকরের মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিলেন। গঙ্গাজলে সিক্ত হয়ে ব্রহ্মার নির্দেশে উপবেশন করল রত্নাকর। ব্রহ্মা তাকে ‘রাম’ নামে দীক্ষা দিলেন। তারপর রত্নাকরকে তিনি বললেন,
– তুমি রামনাম জপ কর। তা হলে দেখবে নাম জপ করতে করতে তোমার পাপ দূর হয়ে গেছে।
রত্নাকর উচ্চারণ করতে চাইল, ‘রাম’। কিন্তু রামনাম উচ্চারণ করতে পারল না। ব্রহ্মা তখন বললেন,
– মহাপাপে তোমার জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে গেছে, রত্নাকর। তুমি এক কাজ কর। তুমি ‘মরা মরা’ বলতে থাক। দুবার ‘মরা’ বললে একবার ‘রাম’নাম উচ্চারিত হবে। এভাবে তোমার মুখে ‘রাম’নাম এসে যাবে। আমরা আবার তোমার কাছে আসব । এ-কথা বলে অন্তর্হিত হলেন ব্রহ্মা ও নারদ। মর্ত্য থেকে তাঁরা চলে গেলেন দেবলোকে । রত্নাকর ব্রহ্মার প্রদর্শিত যোগাসনে বসে এক মনে

‘মরা মরা’ জপ করে যাচ্ছে। এ-ভাবে উচ্চারিত হয়ে যাচ্ছে রামনাম ।
“সামনের উইয়ের ঢিবি থেকে অবিরাম ‘রাম’নাম ধ্বনিত হচ্ছে”
বহুদিন পর ব্রহ্মা এলেন সেই বনপথে। চলতে চলতে তিনি শুনতে পেলেন, কে যেন একটানা ‘রাম’নাম জপ করে চলেছে। কিন্তু তিনি ধারে-কাছে কাউকে দেখতে পেলেন না। কৌতূহল বেড়ে গেল তাঁর। কিছুক্ষণ ভালভাবে খেয়াল করার পর তিনি ধরতে পারলেন, সামনের উইয়ের ঢিবি থেকে অবিরাম রামনাম ধ্বনিত হচ্ছে। ব্যাপার কি দেখার জন্য ব্রহ্মা বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রকে স্মরণ করলেন।
ইন্দ্রদেব এসে ব্রহ্মার নির্দেশে অবিরাম বৃষ্টিধারায় উইয়ের ঢিবির মাটি ভিজিয়ে দিলেন । বৃষ্টির ধারায় মাটি ধুয়ে গেল আর তখন সেখানে দেখা গেল একটি মানুষের কঙ্কাল। সেই কঙ্কাল থেকেই ধ্বনিত হচ্ছে অবিরাম ‘রাম’নাম। ব্রহ্মার প্রভাবে কঙ্কালের গায়ে রক্তমাংস যুক্ত হল। ব্রহ্মা দেখলেন, এই সেই রত্নাকর।
ব্রহ্মা রত্নাকরকে বললেন,
– বৎস রত্নাকর, রামনামের গুণে তোমার সমস্ত পাপ দূর হয়ে গেছে। তুমি এখন নিষ্পাপ পবিত্র মুনিতে পরিণত হয়েছ। তুমি যখন রাম নামে বিভোর ছিলে তখন তোমার শরীর ঘিরে সৃষ্ট হয়েছিল বল্মীকের স্তূপ । উই পোকার ঢিবিকেই বলা হয় বল্মীক।
ব্রহ্মা রত্নাকরকে আরও বললেন, বল্মীকের স্তূপে ঢাকা পড়ে গিয়েছিলে তুমি। এজন্যে আজ থেকে তোমার নাম হল বাল্মীকি । এই বাল্মীকিই পরে শ্রীরামচন্দ্রের মাহাত্ম্য নিয়ে সংস্কৃত ভাষায় ‘রামায়ণ’ রচনা করেছিলেন।
একবার নাম নিলে যত পাপ হরে।
মানুষের সাধ্য নাই তত পাপ করে৷’
ইষ্ট দেবতার নামের এমনই গুণ, এমনই মাহাত্ম্য! নামের গুণেই দস্যু রত্নাকর হল মহর্ষি বাল্মীকি।
সারাংশ
রত্নাকর ব্রহ্মার পায়ে পড়ে পরিত্রাণের উপায় জানতে চাইল। ব্রহ্মা তাকে ‘রাম’নাম উচ্চারণ করতে বললেন। কিন্তু সে ‘রাম’নাম উচ্চারণ করতে পারল না। কারণ পাপে তার জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে গেছে। তখন ব্রহ্মা তাকে ‘মরা মরা’ বলতে বললেন । দুবার ‘মরা’ বললে একবার ‘রাম’ হয়ে যায় । এভাবে রামনাম করতে করতে বল্মীকের স্তূপে ঢাকা পড়ে গেল রত্নাকর।
নামমাহাত্ম্যে তার সমস্ত পাপ দূর হয়ে গেল। ব্রহ্মা তাকে নিষ্পাপ মুনি বলে অভিহিত করলেন এবং তার নাম দিলেন বাল্মীকি। এই বাল্মীকিই সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ রচনা করেছিলেন। নামমাহাত্ম্যে পাপ দূর হয়ে যায়, মানুষ হয় নিষ্পাপ ও পবিত্র।