বভ্রূবাহন ও প্রেতবাহন – গরুড় পুরাণ -পৃথ্বীরাজ সেন

বভ্রূবাহন ও প্রেতবাহনঃ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় বাহন গরুড়ের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন একটি একটি করে।

তিনি বললেন–শ্রাদ্ধ কালে পুত্র যে অন্ন-জল দান করে তা খেয়ে প্রেতলোকে পিতা তৃপ্তি লাভ করে। নরক থেকেও মুক্তি পায়।

গরুড় জানতে চাইল–যারা পুত্রহীন, তাদের কী গতি হয়? তাছাড়া ছেলের দেওয়া অন্ন-জল পিতা যে গ্রহণ করল, তা কী করে বোঝা যায়? হে প্রভু আপনি আমার এ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমাকে শান্ত করুন।

শ্রী ভগবান বললেন–এ অতি উত্তম প্রশ্ন। সন্তানহীনদের ধনসম্পদের যে অধিকারী হয়, সে-ই অন্ন-জল দান করতে পারে। সে করবে শ্রা-দ্ধ। আর যার ধনসম্পত্তি কিছু নেই, নিঃস্ব, এক্ষেত্রে সেদেশের রাজাই তার পারলৌকিক ক্রিয়া করবে, কারণ রাজা হলেন সকলের পালনকর্তা।

বভ্রূবাহন ও প্রেতবাহন - গরুড় পুরাণ -পৃথ্বীরাজ সেন

এরপর শ্রীকৃষ্ণ একটি সুন্দর উপাখ্যান বললেন।

বভ্রূবাহন ও প্রেতবাহন – গরুড় পুরাণ -পৃথ্বীরাজ সেন

পূরাকালে বল্‌বাহন নামে এক প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন। সেই রাজ্যে সর্বদা শান্তি বিরাজ করত। একদিন রাজা তার লোকলস্কর নিয়ে মৃগয়া করতে বেরোলেন। বনে ঢুকেই একটা হরিণকে দেখে তির নিক্ষেপ করলেন।

তির হরিণের পায়ে লাগল। আহত হয়েও সে প্রাণের তাগিদে ছুটতে শুরু করল। রাজা তার পিছু ধরলেন। ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। কিন্তু খানিক যাওয়ার পর হরিণটাকে আর দেখতে পেলেন না।

এসময় রাজার খুব জলতেষ্টা পেল। সামনেই এক সুন্দর সরোবর। তিনি ঘোড়া থেকে নেমে শীতল জল গণ্ডুষ করে পান করলেন। শরীর ও মন জুড়াল। গাছের তলায় বসলেন জিরিয়ে নেবার আশায়। ফুরফুরে বাতাসে রাজার চোখে ঘুম এল। তিনি ঘাসের উপর শুয়ে পড়লেন।

আধো ঘুম আধো তন্দ্রার মধ্যে রাজা একটা বিশ্রী কটু গন্ধ পেলেন। নাক কুঁচকে চোখ মেলে দিলেন। কী আশ্চর্য দৃশ্য। ভূতরাজা তার বিশাল ভূতবাহিনীকে নিয়ে রাজার দিকেই এগিয়ে আসছে।

রাজা তড়াক করে উঠে বসলেন। ধনুকে তির সংযোজন করলেন। ভূতের দলকে লক্ষ্য করে। তাক করলেন।

ভূত রাজা বলল–দাঁড়ান, ধনুক নামান। তির ছোঁড়ার আগে আমার কথা শুনুন।

রাজা ধনুকসহ হাত নামিয়ে নিলেন।

ভূতরাজা বলল–হে রাজা, আমি হলাম প্রেতবাহন, পিশাচদের রাজা। গতজন্মে আমি ছিলাম এক বণিক। তখন নাম ছিল সুদেব। সে সময় দানধ্যান করেছি অনেক। সৎপথে থেকেছি। ধর্ম মেনে চলেছি। তবুও আমাকে মৃত্যুর পরে ভূত হতে হল।

রাজা অবাক হলেন। জানতে চাইলেন–এর কারণ কী?

বভ্রূবাহন ও প্রেতবাহন - গরুড় পুরাণ -পৃথ্বীরাজ সেন

প্রেতরাজা বলল–আমি ছিলাম নিঃসন্তান। এমনকি কোনো আত্মীয়স্বজন না থাকায় অন্ন-জল পেলাম না। তাই হলাম পিশাচ।

–আর ওরা? রাজা ভূতবাহিনীর দিকে চোখ তুলে জানতে চাইলেন।

ভূতরাজা বলল–ওদের অবস্থাও আমারই মতো। আমাদের বীভৎস চেহারা দেখে সকলে ভয় পায়। কেউ সামনে আসতে চায় না। মনের দুঃখের কথা কাউকে বলতে পারি না। আপনি দেশের পালনকর্তা। আপনাকে সব বললাম। আপনি আমাদের জন্য পিণ্ডদান করুন। বৃষ দান করে শ্রা-দ্ধাদি সম্পন্ন করুন।

ঠিক এ সময় রাজার লোকজন রাজাকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে এসে হাজির হল। ভূতবাহিনীকে আর দেখা গেল না।

রাজা নিজে রাজ্যে ফিরে এসে নিয়মমতো বৃষোৎসর্গ শ্রা-দ্ধ করলেন ওইসব ভূত-পিশাচদের উদ্দেশ্যে।

শ্রীহরি এবার বললেন–রাজা হলেন প্রজার পাপতাপের কারণ। তিনি প্রজাকে পাপ থেকে উদ্ধার করতে পারেন।

গরুড়ের দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর শ্রীহরি বললেন–তোমাকে এমন এক কাহিনী শোনাব, নিষ্ঠাভরে পারলৌকিক ক্রিয়া করলে, নবরূপে পিতৃগণ পৃথিবীতে সেইস্থানে ফিরে আসে, বুঝতে পারবে।

পিতৃসত্য পালনের জন্য রামচন্দ্র ভাই লক্ষ্মণ ও স্ত্রী সীতাদেবীকে নিয়ে বনবাসে গিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে ভাই ভরতের কাছ থেকে জানতে পারলেন অযোধ্যার রাজা ও তাঁদের পিতা দশরথ। মারা গেছেন।

বভ্রূবাহন ও প্রেতবাহন - গরুড় পুরাণ -পৃথ্বীরাজ সেন

তিনি বউ এবং ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বনেতে অশৌচ পালন করলেন। তারপর পিতার উদ্দেশ্যে অন্ন-জল দান করলেন। শ্রাদ্ধশান্তি মিটে গেলে অতিথিরা খেতে বসলেন, সেখানে বহু মুনি ঋষি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। কিন্তু বনবাসী রামচন্দ্রের আয়োজন ছিল অত্যন্ত অল্প।

সবাইকে সাদরে আসন গ্রহণ করতে বললেন–রাম। তারপর সীতাকে ডাকলেন পরিবেশন করার জন্য। সীতা অন্নের পাত্র নিয়ে সেখানে এসে দাঁড়ালেন। কয়েকজনের পাতে অন্ন দিয়ে তিনি চলে গেলেন।

সীতাকে ফিরতে না দেখে রামচন্দ্র উদগ্রীব হয়ে তাকে ডাকতে লাগলেন–সীতা, সীতা কোথায় গেলে? অতিথিরা যে বসে আছেন?

কিন্তু কোনো সাড়া পেলেন না। তিনি নিজে ভেতরে এলেন। দেখলেন, সীতা উবু হয়ে বসে অঝোরে কাঁদছেন।

রামচন্দ্র অবাক হয়ে জানতে চাইলেন–সীতা, তুমি কাঁদছ কেন? কী হয়েছে?

সীতাদেবী চোখ মুছে বললেন–আমি এই বাকল পরে ওই অতিথিদের সামনে যেতে পারব না। তাছাড়া তোমার আয়োজন এত সামান্য, এই সামান্য আয়োজনে সব মুনিঋষিদের তৃপ্ত করা সম্ভব নয়।

রামচন্দ্র বললেন–অতিথিরা সবাই তোমার আমার পরিচিত। ওই মুনিঋষিদের সামনে তুমি কয়েকদিন ধরেই বাকল পরে কাটিয়েছ। অথচ আজ কী এমন হল, যে তুমি ওদের সামনে যেতে চাইছ না।

বভ্রূবাহন ও প্রেতবাহন - গরুড় পুরাণ -পৃথ্বীরাজ সেন

সীতাদেবী বললেন–আজকের ব্যাপারটা একেবারে আলাদা। অতিথিদের শেষের দিকে বসেছেন তোমার পিতা, তার পাশে তাঁর পিতা, অবশ্য এঁরা আমার অচেনা। কিন্তু তোমার পিতাকে আমি চিনতে ভুল করিনি।

তাকে আমি সোনার থালায় খেতে দিয়েছি। রূপোর গ্লাসে জল, ভালো কাপড় জামা ও অলংকার সজ্জিত হয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়েছি। তাই আজ বাকল পরে ওনাদের সামনে দাঁড়াতে লজ্জা করছে।

এই বলে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লেন সীতাদেবী। অগত্যা ভাই লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে রামচন্দ্র অতিথিদের ব্যঞ্জনাদি পরিবেশন করলেন। সকলে খেয়ে তৃপ্ত হলেন। আশীর্বাদ করে বিদায় নিলেন, তারা।

শ্রীকৃষ্ণ বললেন–বিনতানন্দন সীতাদেবী যা দেখেছেন, তা একবর্ণও মিথ্যা নয়। মৃত্যুর পর অন্নজল পাওয়ার জন্য সকল পিতৃপুরুষ উদগ্রীব হয়ে থাকেন। বিধি মেনে শ্রদ্ধা সহকারে যে এই কাজ করে সে তাদের দেখা পায়।

 

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment