আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় মাদকাসক্তি নীতিজ্ঞান
Table of Contents
মাদকাসক্তি নীতিজ্ঞান
‘মাদক’ বলতে বোঝায় নেশার বস্তু। আমরা যে সকল জিনিস জীবন রক্ষার জন্য খাই তাকে বলে খাদ্য। যে সকল জিনিস পান করি, তাকে বলে পানীয়। খাদ্য ও পানীয়, না হলে আমরা বাঁচতে পারি না। এমন কিছু জিনিস বা দ্রব্য আছে যা মাদক। যেমন : আফিম, গাঁজা, তামাক, মদ, হেরোইন, মরফিন, প্যাথেড্রিন, কোডিন, ফেনসিডিল ইত্যাদি।
এগুলো কিছু কিছু ঔষধ তৈরির উপাদান হিসেবে কাজে লাগে। এগুলো জীবন রক্ষার জন্য সরাসরি কাজে লাগে না। সরাসরি খেলে বা পান করলে বা শরীরে গ্রহণ করলে এক ধরনের নেশা হয়, ঝিমুনি আসে। এগুলোকে বলা হয় মাদকদ্রব্য। মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্তি বা লিপ্সাকে মাদকাসক্তি বলা হয়। জীবনের ক্ষতি করে।
মাদকদ্রব্য সরাসরি শরীরের জন্যে বা জীবন রক্ষার জন্যে কোন কাজে তো লাগেই না বরং এগুলো মাদকাসক্তি একটি বদভ্যাস। মাদকাসক্তি বলতে মাদক দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীলতা বা মাদকদ্রব্য দ্বারা নেশা সৃষ্টি হওয়া বোঝায় । মাদকাসক্তি দৈহিক, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি সাধন করে।
দৈহিক ক্ষতি
মাদকাসক্ত হলে:
- খাদ্য গ্রহণে অরুচি হয়। অনিদ্রা হয়, হজমশক্তি কমে যায়।
- অপুষ্টি এবং অপুষ্টিজনিত রোগ হয়।
- স্থায়ী কফ, কাঁশি, হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যানসার এবং শ্বাসনালীর নানা রকম রোগ হয়।
- ওজন কমে যায়, শরীর ক্ষীণ হয়।
- এছাড়া খাদ্যনালীতে ক্যান্সার হতে পারে।
- জন্ডিস বা লিভার সিরোসিস নামক রোগ হতে পারে।
- রক্তচাপ বৃদ্ধি বা হ্রাস পেতে পারে ।
- কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
- মাদকদ্রব্যের প্রতিক্রিয়ায় প্রাণ পর্যন্ত বিনষ্ট হতে পারে।
মানসিক ক্ষতি
মাদকাসক্ত হলে:
- নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বিবেক বুদ্ধি লোপ পায়। তখন মাদকাসক্ত ব্যক্তি যে কোন রকমের অন্যায়কাজ বা ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হতে পারে।
- মাদকাসক্ত ব্যক্তি চৈতন্য পর্যন্ত হারাতে পারে।
- জ্ঞান ফিরে আসলেও মাদকাসক্ত ব্যক্তির ওপর তার প্রভাব থাকে।
- মাদকাসক্তের মস্তিষ্ক বিকৃত হতে পারে।
- মাদকাসক্ত ব্যক্তির স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে।
- মাদকাসক্ত এক পর্যায়ে জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়তে পারে।
- মাদকাসক্তির ফলে মিথ্যা কথা বলাসহ অসৎ ও অসামাজিক আচরণের প্রবণতা বাড়ে ।
আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি
মাদকাসক্ত হলে:
- মাদকাসক্ত ব্যক্তি মাদকদ্রব্য কিনতে অনেক অর্থ ব্যয় হয়। এ সকল মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ বলে কিনতে অনেক টাকা লাগে ।
- মাদকাসক্ত ব্যক্তি মাদকাসক্ত অবস্থায় সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। সামাজিক পরিবেশ ক্ষতি করে।
- মাদকাসক্ত ব্যক্তি মাদকদ্রব্য কেনার জন্য অভিভাবক বা বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে টাকা চেয়ে যখন পায় না, তখন দুর্ব্যবহার করে। এতে পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
- মাদকাসক্ত ব্যক্তি মাদকাসক্ত অবস্থায় কিংবা অন্য সময়েও মানসিক অস্থিরতা ও উদ্বেগের কারণে সহজেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন ঝগড়া-মারামারি করে। এমনকি সে খুন পর্যন্ত করে বসে। এতে করে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
- মাদকাসক্ত ব্যক্তি মা-বাবা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের উদ্বেগ ও অশান্তির কারণ হয় । এভাবে মাদকাসক্ত শুধু নিজের নয়, অন্যদের মানসিক ক্ষতি এবং তা সমাজের ওপর প্রভাব ফেলে।
ধর্মগ্রন্থসমূহে মাদকাসক্তি সম্পর্কে বক্তব্য ও দৃষ্টান্ত
মনুসংহিতার একাদশ অধ্যায়ে সুরাপানকে পঞ্চ মহাপাতকের অন্যতম বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ সকল পাপ যারা করে, তাদের সাথে এক বছর মেলামেশা করলেও একই রকম পাপ হয়। আরও বলা হয়েছে সুরা পান করলে দাঁত কালো হয়ে যায়। সুরা পান প্রভৃতি পাপ করলে নিন্দনীয় লক্ষণযুক্ত হয়ে বা পশুকুলে জন্মগ্রহণ করতে হয়। এ বিষয়ে পদ্মপুরাণেও একই রকম কথা বলা হয়েছে।
মহাভারতেও সুরাপানের নিন্দা করা হয়েছে। মৌষল পর্বে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত সুরা পানই যদুবংশের ধ্বংসের কারণ। সুরা পান করে মত্ত অবস্থায় ছিল বলে জগাই-মাধাই প্রভু নিত্যানন্দকে প্রহার করেছিল। তাও আবার মদ রাখার কলসির কানা দিয়ে।
মাদকদ্রব্য সেবনের দ্বারা ইন্দ্রিয় উত্তেজিত হয়।
ইন্দ্রিয় উত্তেজিত হলে সংযম থাকে না। সংযম না থাকলে ধর্মহানি ঘটে। সুতরাং মাদকাসক্তি সব দিক থেকে ধর্ম ও নীতিবিরুদ্ধ কাজ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।
মাদকাসক্তির প্রতিকার
মাদকাসক্তি প্রতিকারের অযোগ্য নয়। মাদকাসক্তির নিন্দনীয়, তা বলে মাদকাসক্তকে ঘৃণা করা ঠিক নয় । আমরা পাপকে ঘৃণা করব, পাপীকে নয়। তাই আমরা সহানুভূতির সাথে মাদকাসক্তদের দেখব এবং তাদের নিরাময়ের ব্যবস্থা করব।
মাদকাসক্তির প্রতিকারের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে :
- মাদকাসক্তকে পরিত্যাগ না করে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখা ।
- মাদকদ্রব্য তৈরি, বিক্রয় ও গ্রহণ নিষিদ্ধ করতে হবে।
- মাদক-বিরোধী আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে।
- মাদকসক্তদের জন্য সরকারি ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে নিরাময় কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।
- বেতার, টেলিভিশন, সংবাদপত্র প্রভৃতি গণমাধ্যমে মাদকাসক্তি বিরোধী আলোচনা ও নাটক, জীবন্তিকা প্রভৃতি প্রচার করতে হবে।
- মাদকদ্রব্যের কুফল সম্পর্কে মাতা-পিতা, অভিভাবক ও শিক্ষকগণ কিশোর-কিশোরী ও তরুণ- তরুণীদের বুঝিয়ে বলবেন। মাদকাসক্ত হওয়ার আগেই তাদের বিরত রাখার চেষ্টা করবেন।
- খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করলে তাতে সময় কাটবে। মাদকাসক্তি থেকে তাহলে দূরে থাকার উপায় সৃষ্টি হবে।
- মাদকাসক্তিকে ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিকতা দিয়েও প্রতিরোধ করা যায়।
মাদকাসক্তি একটি সামাজিক ব্যাধি। এর দূরীকরণ জাতীয়ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্যে সরকার ও জনগণকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতন থাকতে হবে।
সারাংশ
ধূমপান, মদ্যপান, হেরোইন সেবন, শরীরে কোন মাদকদ্রব্য গ্রহণের নেশা বা আসক্তিকে মাদকাসক্তি বলে। মাদকাসক্তি ধর্ম ও নীতিবিরুদ্ধ। শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক | ক্ষতি করে। ধর্মগ্রন্থেও মাদকাসক্তির নিন্দা করা হয়েছে। মাদকাসক্তির প্রতিকারের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন ।
আরও দেখুন :