আজকে আমরা জানবো স্বামী বিবেকানন্দ বিষয়ে।
Table of Contents
স্বামী বিবেকানন্দ
স্বামী বিবেকানন্দ ১
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি কলকাতার শিমুলিয়া পল্লীর দত্ত পরিবারে বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বিশ্বনাথ দত্ত, মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী। পিতা কলকাতা হাইকোর্টের এটর্নি ছিলেন। বিশ্বনাথ দত্তের তিন পুত্র – জ্যেষ্ঠ নরেন্দ্র, মধ্যম মহেন্দ্র এবং কনিষ্ঠ ভূপেন্দ্র। বিশ্বনাথ দত্ত মহাশয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র নরেন্দ্রই পরবর্তীকালের স্বামী বিবেকানন্দ। নরেন্দ্র শিশুকাল হতে যৌবনের প্রারম্ভ পর্যন্ত অতিশয় আমোদপ্রিয় ছিলেন।
তিনি নির্দোষ রসিকতা ও গান-বাজনা করতে অত্যন্ত নিপুণ ছিলেন। বাল্যকাল হতেই তাঁর স্মরণশক্তি, বুদ্ধি ও সরল হৃদয়ের পরিচয় পাওয়া যায়। কুটিলতা, কপটতা, স্বার্থপরতা ও হিংসা কাকে বলে, তা তিনি জানতেন না । বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী বা অপরিচিত ব্যক্তিদের যে কোন বিষয়েরই অভাব হোক না কেন, নরেন্দ্র জানতে পারলে তা তৎক্ষণাৎ পূরণ করার চেষ্টা করতেন ।
শৈশব থেকেই নরেন্দ্রনাথ লেখাপড়ার সাথে সাথে ঈশ্বরকে জানবার জন্য কৌতূহলী ছিলেন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর চিন্তা তাঁর মনে ক্রমশ গভীর হতে থাকে। সাধু সন্ন্যাসী দেখলেই তিনি ঈশ্বর সম্বন্ধে নানা প্রকার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন, আর জানতে চাইতেন তাঁরা কেউ ঈশ্বর দর্শন করেছেন কিনা । নরেন্দ্র ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
জেনারেল এসেম্বলি নামক বিদ্যালয় হতে তিনি ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে এফ-এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বি.এ অধ্যয়ন করতে থাকেন এবং ১৮৮৪ সালে তিনি বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ঐ সময়ে তাঁর ধর্ম-পিপাসা অত্যন্ত প্রবল হয়। ধর্ম কাকে বলে এবং কোন ধর্ম সত্য, তা জানার জন্য তাঁর চিত্ত একেবারে অস্থির হয়ে পড়ে। হোস্ট সাহেব একজন খ্রিস্টান মিশনারী।
তিনি জেনারেল এসেম্বলি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। নরেন্দ্র অধিকাংশ সময়ই তাঁর সঙ্গে ধর্ম সম্বন্ধীয় কথোপকথন করতেন; কিন্তু তাতে তাঁর পিপাসা মিটত না। ঠিক এ সময়ে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের সঙ্গলাভ করেন। তিনি ঠাকুর রামকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি কি ঈশ্বর দর্শন করেছেন।” কিছুমাত্র ইতস্তত না করে সহজ কণ্ঠে, প্রত্যয়ের সুরে ঠ…. – নিশ্চয়ই দেখেছি, তোকে যেমন দেখছি, তার চেয়েও স্পষ্ট দেখেছি।
তুই চাইলে তোকেও দেখাতে পারি।” শ্রীরামকৃষ্ণের কথা শুনে নরেন্দ্রনাথ অবাক, তবে প্রথমে বিশ্বাস করলেন না। নানা রকম প্রশ্ন করে ঠাকুরকে তিনি পরীক্ষা করতে লাগলেন। এর কিছুক্ষণ পর এক সন্ধ্যায় নরেন্দ্রনাথের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আসন থেকে উঠে নিজের দক্ষিণ চরণ তাঁর স্কন্ধে স্থাপন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্রের ভাবান্তর ঘটল।
সমস্ত বিশ্ব প্রকৃতি বিস্ময়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, “ওগো, তুমি আমার একি করলে? আমার যে মা-বাবা আছেন।” তখন ঠাকুর নরেন্দ্রনাথের বুকে হাত রাখলেন নরেন্দ্র শ্রীরামকৃষ্ণের চরণ আশ্রয় করলেন। সমাধির গভীরে ডুব দেয়ার জন্য নরেন্দ্রনাথ এবার ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।
বারবার অনুরুদ্ধ হয়ে ধীর প্রশান্ত সুরে রামকৃষ্ণ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, ঠিক করে বল দেখি, তুই কি চাস?” উত্তরে নরেন্দ্রনাথ বললেন, “আমার ইচ্ছা হয়, প্রাচীনকালের বিখ্যাত সাধক শুকদেবের মত একবারে পাঁচ-ছয় দিন সমাধিতে ডুবে থাকি।” শিষ্যের এ প্রার্থনায় গুরু যেন খুশি হলেন না। তিরস্কারের সুরে তিনি নরেন্দ্রকে বললেন, “ছি! ছি! তুই এত বড় আধার, তোর মুখে এই কথা? আমি ভেবেছিলাম বট গাছের মত হবি।
তোর ছায়ায় হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় পাবে, তা না হয়ে তুই কিনা নিজের মুক্তি চাস!” নরেন্দ্রনাথ অসীম শ্রদ্ধায় শক্তিধর গুরুর চরণে প্রণাম করে চিরদিনের জন্য আত্মসমর্পণ করলেন। গুরুর নির্দেশ হল, “নরেন লোকশিক্ষা দিবে।” ঠাকুরের এ কথাতে নরেন্দ্রনাথের জীবনের মোড় ঘুরে গেল। সমাধির কথা ছেড়ে তিনি মানবের সেবাধর্মে ব্রতী হলেন সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি বিবেকানন্দ নামে ভূষিত হলেন।
সারাংশ
স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ছোটবেলা | থেকেই ধর্মের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের কাছ থেকে তাঁর ধর্ম-জিজ্ঞাসার উত্তর পান এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
স্বামী বিবেকানন্দ ২
শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানের কিছুদিন পরে স্বামী বিবেকানন্দ পরিব্রাজক বেশে তীর্থ ভ্রমণে বের হন। একটানা চার বছরে কাশী, অযোধ্যা, বৃন্দাবন, বৈদ্যনাথ, প্রয়াগধাম, রাজপুতনা প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ শেষে কন্যা কুমারীর প্রস্তর বেদীতে যোগাসনে বসে বিবেকানন্দ ভাবছেন : দেশের প্রায় সর্বত্রই অশিক্ষা আর অভাবের তাড়নায় মানুষ চরম অশান্তিতে আছে। দেশবাসীর দারিদ্র্য ও অজ্ঞানতা তাঁকে আকুল করে তুলল ।
মনে পড়ে গেলে ঠাকুরের বাণী— “যত্র জীব তত্র শিব” । সুতরাং মানুষের দুঃখ- দুর্দশা মোচনই হবে তাঁর সাধনা, তাঁর ব্রত। কিন্তু এ কাজের জন্য চাই প্রচুর অর্থ। স্বামীজি সিদ্ধান্ত নিলেন, পাশ্চাত্যে গিয়ে বুদ্ধি বলে অর্থোপার্জন করে সে অর্থ মাতৃভূমির উন্নতিকল্পে ব্যয় করবেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরে মহামেলায় একটি ধর্ম মহাসভার আয়োজন করা হয়েছিল।
ধর্মসভার সভাপতি ছিলেন ‘রেভারেন্ড ডাক্তার ব্যারে সাহেব’। তিনি ১৮৯৩ সালের ৩১ মে বিবেকানন্দ পাশ্চাত্য অভিমুখে রওয়ানা হলেন। যথাসময়ে তিনি আমেরিকার শিকাগো শহরে প্রবেশ করলেন। তাঁর পরিধানে গৈরিক বসন, গায়ে গৈরিক আলখাল্লা ও গৈরিক উত্তরীয় এবং শিরে গৈরিক শিরস্ত্রাণ দর্শন করে শহরবাসিগণ অবাক হয়ে গেলেন। তিনি কে এবং তাঁর কার্য কি তা জানার জন্য অনেকেই তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন।
স্বামীজি নিজ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য সকলের নিকটেই যথাযথ বর্ণনা করতে লাগলেন। তাদের মধ্যে চার জন মান্যগণ্য ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য দেখে এবং তাঁর গুণে ও মধুর বচনে আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে তাদের বাড়িতে অবস্থানের জন্য অনুরোধ করেন। ব্যারে সাহেব প্রথমে নানা কারণে স্বামীজিকে নিমন্ত্রণ করতে অস্বীকার করেন।
পরে আমেরিকার সুপ্রসিদ্ধ দুই-চারজন পণ্ডিতের বিশেষ অনুরোধে তিনি তাঁকে নিমন্ত্রণ করেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর ধর্ম জগতের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। আমেরিকার শিকাগো শহরে আর্ট ইনস্টিটিউট ভবনে বিশ্ব ধর্ম মহাসম্মেলন আরম্ভ হয়েছে। সভাপতির আহবানে বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালেন একজন ভারতীয় তরুণ সন্ন্যাসী। উজ্জ্বল বীরত্বব্যঞ্জক তাঁর আকৃতি।
সমুন্নত তাঁর দেহ, সুন্দর তাঁর মুখমণ্ডল, সুদীপ্ত তাঁর চোখ। বক্তার প্রতি সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে। এমন সময় তরুণ সন্ন্যাসী ইষ্টনাম স্মরণ করে সমবেত নর-নারীকে সম্বোধন করলেন আমেরিকাবাসী “ভাই ও বোনেরা” বলে । মুহূর্তের মধ্যে এক অদ্ভুদ কাণ্ড ঘটে গেল। প্রচলিত রীতির পরিবর্তে এমন প্রীতিপূর্ণ সম্ভাষণে জনগণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। আনন্দ করতালিতে ফেটে পড়ল সভাকক্ষ।
শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে সন্ন্যাসী বলতে লাগলেন— ‘সর্বধর্মের জননী স্বরূপ সনাতন ধর্মের প্রতিনিধিরূপে সকল শ্রেণীর সকল মতের কোটি কোটি হিন্দুর পক্ষ থেকে আপনারা আমার আন্তরিক ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।’ তাঁর বক্তৃতা-শক্তি, শাস্ত্রজ্ঞান, অকাট্য যুক্তি এবং তর্কের প্রণালী দেখে জ্ঞানী ও সাধু সমাজ অবাক হয়ে গেলেন। সভায় ধন্য ধন্য পড়ে গেল।
সমস্ত আমেরিকায় এই বক্তৃতা নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হল। সে আলোড়ন ও প্রশংসাধ্বনি আটলান্টিক মহাসমুদ্র পার হয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল । সকলে এক বাক্যে স্বীকার করলেন স্বামীজি সত্যি-সত্যিই মহাজ্ঞানী পুরুষ। বিশ্ব ধর্ম মহাসম্মেলনে যোগদান করে তিনি হয়ে উঠলেন বিশ্ব বরেণ্য আচার্য। চার বছর ধরে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন স্থানে বেদান্তের বাণী প্রচার করে বহু মনীষীর আশীর্বাদ লাভ করে তিনি দেশে ফিরে এলেন।
দেশবাসী স্বামীজিকে প্রাণঢালা অভিনন্দনে বরণ করে নিলেন। এবার তিনি দেশ গড়ার কাজে মন দিলেন। উপলব্ধি করলেন, দুর্বল দেশবাসীর অন্তরে শক্তি ও সাহস সঞ্চার করতে হবে। তাই তিনি যুব সমাজকে লক্ষ্য করে বললেন, “ওঠো, জাগো, শ্রেয়কে লাভ কর। মনে রাখবে দুর্বলতাই পাপ । দুর্বলতা দূর করে শক্তি সঞ্চয় কর। তোমরা অমৃতের সন্তান। তোমাদের মধ্যে রয়েছে অনন্ত ঐশ্বরিক শক্তি। সব জীবের মধ্যেই ঈশ্বর অবস্থান করেন।
ব্যক্তিগত মুক্তি বড় কথা নয়। সমষ্টিগত মুক্তিই আমাদের সকলের জীবনের ব্রত। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, দুনিয়ার দুঃখ-যন্ত্রণা দূর করার জন্য, এমন কি, একটি মানুষের সামান্য যন্ত্রণা দূর করার জন্যও যদি আমাকে হাজার বার জন্মগ্রহণ করতে হয়, তাও আনন্দে করব।” স্বামী বিবেকানন্দ যেমন ছিলেন জ্ঞানী, পণ্ডিত, তেমনি ভগবদ্ভক্ত এবং মানবপ্রেমিক।
তাঁর চোখে পণ্ডিত-মূর্খ, সাদা-কালোর কোন পার্থক্য ছিল না। তিনি ছিলেন নিখিল মানব জাতির পরম বান্ধব । তাঁর রচিত কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, রাজযোগ প্রভৃতি গ্রন্থ অমূল্য সম্পদ। এই ব্রহ্মজ্ঞানী, মানব প্রেমিক স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই বেলুড় মঠে ধ্যানস্থ হয়ে মহাসমাধিতে ইহলোক ত্যাগ করেন ।
সারাংশ
স্বামী বিবেকানন্দ সন্ন্যাস গ্রহণের পর পরিব্রাজক বেশে সারা ভারত ভ্রমণ করেন। সেই অভিজ্ঞতায় এবং গুরু রামকৃষ্ণ দেবের ‘যত্র জীব তত্র শিব’ এই শিক্ষায় জীবের সেবা করাকেই তিনি ব্রহ বলে গ্রহণ করেন। জীবের সেবাই ঈশ্বরের সেবা— এ উপলব্ধিই ছিল বিবেকানন্দের জীবনাদর্শের ‘মূল ভিত্তি’।
আরও দেখুন :