Site icon Sanatan Gurukul [ সনাতন গুরুকুল ] GOLN

সৎসাহস নীতিজ্ঞান

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় সৎসাহস নীতিজ্ঞান

সৎসাহস নীতিজ্ঞান

 

 

সৎসাহস নীতিজ্ঞান

সাহস’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ভয় না পেয়ে কোন কাজ করা বা নির্ভীকতা। নিজের বিপদের ঝুঁকি আছে জেনেও কোন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার যে প্রবৃত্তি, তার নাম সাহস। এ সাহস যেমন ভাল বা সৎ কাজে দেখানো যায়, তেমনি মন্দ বা অসৎ কাজেও দেখানো যায়। সৎ বা কল্যাণকর কাজে যে সাহস দেখানো হয় তাকে বলে ‘সৎ সাহস’।

সবল যখন অন্যায়ভাবে দুর্বলের ওপর অত্যাচার করে, তখন সৎ সাহসী দুর্বলের পক্ষে দাঁড়ায়। লড়াই করে। ধর্ম রক্ষার জন্য যুদ্ধ করা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে সৎ সাহস দেখানো ক্ষত্রিয় বীরের কর্তব্য। মহাভারতে এ-রকম সৎ সাহসের অনেক উপাখ্যান আছে। এখন মহাভারত থেকে এ-রকম সৎ সাহসের একটি উপাখ্যান বলছি :

অভিমন্যুর সৎ সাহস

মহাভারতের এক মহাবীর তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন । অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু। অভিমন্যু পিতার কাছ থেকে যুদ্ধবিদ্যা লাভ করেন এবং অল্প বয়সেই নানাবিধ অস্ত্র চালনায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। অর্জুনের পিতার নাম পাণ্ডু । তাই যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব- পাণ্ডুর এই পঞ্চ পুত্রকে বলা হয় পাণ্ডব । পাণ্ডুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নাম ধৃতরাষ্ট্র।

ধৃতরাষ্ট্রের ছিল দুর্যোধন, দুঃশাসন, বিকর্ণ ইত্যাদি একশত পুত্ৰ এবং দুঃশলা নামে একটি কন্যা। কুরু বংশের নামে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের কৌরব বলা হত । এক সময়ে রাজ্যের অধিকারকে কেন্দ্র করে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধে সারা ভারতের প্রায় সকল রাজা জড়িয়ে পড়েন। কেউ কৌরব, কেউ বা পাণ্ডব পক্ষে যোগ দেন।

একদিকে দুর্যোধন, দুঃশাসন প্রভৃতি ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্র, পিতামহ ভীষ্ম, অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য, মহাবীর কর্ণ, কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্যের পুত্র অশ্বত্থমা, দুর্যোধনের মামা শকুনি, জয়দ্রথ প্রভৃতি এবং বিশাল সেনাবাহিনী। অন্য পক্ষে পঞ্চ পাণ্ডব, দ্রুপদ রাজার ছেলে ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি, অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু প্রভৃতি এবং বিরাট সেনাবাহিনী। দ্বারকার রাজা রূপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজে পাণ্ডব পক্ষে অংশ নেন ।

তবে তিনি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেন নি। তিনি ছিলেন অর্জুনের সারথি ও পরামর্শদাতা। অন্যদিকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর একটি বিশাল সেনাবাহিনীকে কৌরব পক্ষে যুদ্ধ করতে দেন। যুদ্ধটা হয়েছিল কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে। তাই এ যুদ্ধের নাম কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ চলেছিল আঠার দিন। এ আঠার দিনের একদিনের যুদ্ধ। কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ চলছে। সেদিন অর্জুন খুব বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করছেন।

বিপক্ষের বিশাল একটি সেনাদল তাঁর সাথে পেরে উঠছে না। তখন দুর্যোধন অস্ত্রগুরু ও অন্যতম সেনাপতি দ্রোণাচার্যের সাথে মন্ত্রণায় বসলেন। ঠিক করলেন, দ্রোণাচার্য চক্রব্যূহ নির্মাণ করে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। ‘ব্যূহ’ মানে যুদ্ধের সময় সৈন্য সাজানোর বিশেষ বিশেষ কৌশল। চক্রব্যূহ হচ্ছে চক্রের আকারে বা গোলাকার করে সৈন্য সাজানো।

চক্রব্যূহে প্রবেশ করার একটি মাত্র পথ থাকে এবং সৈন্যদের আটটি কুণ্ডলাকৃতি সারি দিয়ে পরিবেষ্টিত হয়। আরও অনেক প্রকার ‘ব্যূহ’ রচনা করা যায় । যেমন, ত্রিশূল ব্যূহ, পদ্মব্যূহ, অৰ্দ্ধচন্দ্রব্যূহ ইত্যাদি । চক্রব্যূহ ভেদ করা খুব কঠিন। সকল বীর এ ব্যূহ ভেদ করার কৌশল জানেন না বা জানলেও অনেক সময় পেরে ওঠেন না। ভীম, ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি প্রভৃতি পাণ্ডবপক্ষের বড় বড় বীর কৌরবদের চক্রব্যূহ ভেদ করতে ব্যর্থ হলেন ।

 

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

যুধিষ্ঠির চিন্তায় পড়ে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুন, অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু ও শ্রীকৃষ্ণের পুত্র প্রদ্যুম্ন ছাড়া তাঁদের পক্ষের আর কেউ চক্রব্যূহ ভেদ করতে জানেন না। শ্রীকৃষ্ণ অস্ত্র ধরে যুদ্ধ করবেন না। অর্জুন অন্যত্র যুদ্ধে ব্যস্ত । এ অবস্থায় অভিমন্যুই একমাত্র ভরসা। অভিমন্যুর বয়স তখন ষোল বছরের কিছু কম। আর একটা সমস্যা হল, অভিমন্যু চক্রব্যূহের ভেতরে প্রবেশ করতে জানেন, কিন্তু তা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার কৌশল তখনও আয়ত্ত করতে পারেন নি ।

যুধিষ্ঠির অভিমন্যুকে বললেন, বিপক্ষ দল চক্রব্যূহ সাজিয়ে রয়েছে। একজন কেউ এগিয়ে না গেলে তা লজ্জা আর অপমানের ব্যাপার হবে। মাথা নত করে মেনে নিতে হবে পরাজয়। তুমি যাও অভিমন্যু, চক্রব্যূহ ভেদ কর। আমরা তোমাকে চক্রব্যূহ থেকে বের করে আনব। অভিমন্যু সানন্দে রাজি হলেন। এগিয়ে গেলেন সৎ সাহস নিয়ে। চক্রব্যূহ ভেদ করে ব্যূহের ভেতরে প্রবেশ করলেন অভিমন্যু।

তাঁর বৃষ্টি ধারার মত অবিরল শরবর্ষণে বিপক্ষের অনেক সৈন্য নিহত হল। নিহতদের মধ্যে ছিল মহাবীর শল্যের ছোট ভাই। অভিমন্যুর কাছে পরাজিত হলেন দুর্যোধন, কর্ণ- এমনি আরও অনেক বড় বড় বীর। তখন দ্রোণ, কর্ণ, দুঃশাসন, কৃপাচার্য, শকুনি, অশ্বত্থামা এবং দুর্যোধন- এই সপ্তরথী অর্থাৎ সাতজন মহাযোদ্ধা একযোগে বালক অভিমন্যুকে আক্রমণ করলেন।

এঁরাও পরাজিত হলেন সাত বার। অষ্টম বারে সপ্তরথী অভিমন্যুকে ঘিরে ধরে একসাথে আক্রমণ করলেন। এ মিলিত আক্রমণে অভিমন্যু অস্ত্রহীন এবং রথহীন হয়ে পড়লেন। তখন শুধু রথের চাকা দিয়েই যুদ্ধ করতে লাগলেন বালক অভিমন্যু।
এভাবে অভিমন্যু প্রচণ্ড যুদ্ধ করে চক্রব্যূহের ভেতরে প্রাণ বিসর্জন দিলেন।

অকাল মৃত্যু অভিমন্যুর দেহ ছিনিয়ে নিলেও তিনি পৃথিবীতে চির অমর হয়ে রইলেন। মহাভারতের পাতায় চির উজ্জ্বল হয়ে রইল তাঁর বীরত্ব আর সৎ সাহসের কাহিনী।

সারাংশ

 

 

‘সাহস’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে নির্ভীকতা । আর সৎ সাহস মানে সৎ বা কল্যাণকর কাজে সাহস দেখানোর প্রবৃত্তি । ধর্ম রক্ষার জন্য সৎ সাহস দেখানো কর্তব্য। মহাভারতের মহাবীর অর্জুনের মহাবীর পুত্র অভিমন্যুর সৎ সাহসের একটি উপাখ্যান আছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় একদিনের যুদ্ধে অভিমন্যু কৌরব পক্ষের অনেক শক্তিশালী বীরের বিরুদ্ধে বিশেষ করে সপ্তরথীর মিলিত আক্রমণের মুখে একা সৎ সাহস নিয়ে যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দেন।

আরও দেখুন :

Exit mobile version