হিন্দু ধর্মের বিকাশ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় হিন্দু ধর্মের বিকাশ

হিন্দু ধর্মের বিকাশ

 

হিন্দু ধর্মের বিকাশ

 

হিন্দু ধর্মের বিকাশ

আর্য ও প্রাগার্য (প্রাক্+আর্য) নানা মত ও পথের সংমিশ্রণে হিন্দু ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে। উদ্ভবের পর হিন্দু ধর্ম এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেনি। বরং নানা মত ও পথের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে করতে ক্রমবিকশিত হয়েছে। ঈশ্বর হিন্দু ধর্মের মূল। হিন্দু ধর্মের মূলগ্রন্থ বেদে ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে। এই বেদ হিন্দু ধর্মের প্রধান ভিত্তি। বেদ মানে জ্ঞান পবিত্র জ্ঞান।

গভীর ধ্যানে সেই পবিত্র জ্ঞান আর্য ঋষিরা লাভ করেছিলেন। বেদে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে এবং জগৎ ও জীবনের উৎস ব্র হ্ম বা ঈশ্বর সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। বেদকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা: ঋগবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ব বেদ। ঋগবেদে রয়েছে দেবতাদের স্তুতি ও প্রার্থনা। যজুর্বেদে রয়েছে যজ্ঞের ব্যবহারের উপযোগী মন্ত্র। সামবেদে রয়েছে গানের সংগ্রহ।

‘সাম’ মানে গান। আর চিকিৎসা শাস্ত্রসহ অন্যান্য বিদ্যার সংগ্রহ হচ্ছে অথর্ব বেদ । বৈদিক যুগে উপাসনার পদ্ধতি ছিল যজ্ঞ বা হোম ভিত্তিক। তখনও মূর্তি বা বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে উপাসনার রীতি ব্যবহৃত হয়নি। ঋষিরা দেবতাদের শক্তি স্মরণ করে মন্ত্রের মাধ্যমে তাঁদের স্তুতি ও উপাসনা করতেন এবং অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে বাঞ্ছিত দেবতাকে আহ্বান জানাতেন। ঋষিরা বৈদিক দেবতাদের তিনটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেছেন । যথা :

(১) স্বর্গের দেবতা,

(২) অন্তরীক্ষলোকের দেবতা

(৩) মর্ত্যের দেবতা।

স্বর্গের দেবতারা মতে বা পৃথিবীতে আসেন না, তাঁদের ক্ষমতাই শুধু বোঝা যায়। এমন দেবতারা হলেন- সূর্য, বরুণ ইত্যাদি। অন্তরীক্ষলোকের দেবতারা মর্ত্যে আসেন কিন্তু অবস্থান করেন না। ইন্দ্র ও বায়ু অন্তরীক্ষলোকের দেবতা। আর মর্ত্যের দেবতাকে দেখা যায়। তিনি মর্ত্যে বা পৃথিবীতে অবস্থানও করেন। অগ্নি মর্ত্যের দেবতা।

অগ্নিকে পৃথিবীতে পাওয়া যায় বলে তাঁর মাধ্যমে অন্য দেবতাদের আহ্বান করা হয়। অগ্নি প্রজ্বলিত করে তাতে বিভিন্ন দ্রব্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। এই পদ্ধতিতে উপাসনা করাকে যজ্ঞ বা হোম করা বলে। বৈদিক যুগে এই যজ্ঞভিত্তিক উপাসনা পদ্ধতি প্রচলিত ছিল ।

বৈদিক যুগে বেদ ছাড়াও আরও কিছু ধর্মগ্রন্থ প্রচলিত হয়। যেমন- ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, ইত্যাদি । উপনিষদ পরবর্তীকালে দেবতা ও ধর্মীয় উপাসনা পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটে। মহাপুরুষেরা উপলব্ধি করেন, মহামায়া বা প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরের শক্তির প্রকাশ ঘটে। ঈশ্বর যখন তাঁর কোন শক্তিকে রূপদান করেন, তখন তাঁকে দেবতা বলে।

দেবতারা ঈশ্বরের শক্তির সাকার রূপ। যেমন, যে রূপে ঈশ্বর সৃষ্টি করেন, তাঁর নাম ব্রহ্মা। তিনি যেরূপে পালন করেন, তাকে বলে বিষ্ণু। তাঁর বিদ্যাদানের শক্তিকে বলে সরস্বতী। ধন-সম্পদের শক্তিকে লক্ষ্মী বলা হয়। উপাস্য দেবতা অনুসারে হিন্দু ধর্মের মধ্যে বিভিন্ন মত ও সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, যাঁরা শক্তির উপাসনা করেন তাঁরা শাক্ত, যাঁরা বিষ্ণুর উপাসনা করেন তাঁরা বৈষ্ণব এবং যাঁরা শিবের উপাসনা করেন, তাঁরা শৈব ইত্যাদি।

তবে বিভিন্ন উপাসক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটলেও এ সকল দার্শনিক মত ও বিশ্বাসের মধ্যে গভীর ঐক্য বিদ্যমান। এই ঐক্যের সূত্রটি হল এই যে, সকল দেবতা সেই এক এবং অভিন্ন পরম ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের শক্তি। এই ব্রহ্ম বা ঈশ্বরই হিন্দুধর্মের মূল। এভাবে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের শক্তি হিসেবে দেবতাদের প্রকাশ এবং দেব-দেবীদের নানা বিবর্তনের মধ্যে হিন্দু ধর্মের বিকাশের পরিচয় পাওয়া যায়।

 

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

হিন্দুধর্মের এই বিকাশের পরিচয় পৌরাণিক ধর্মগ্রন্থসমূহে বিধৃত। উপাসনা পদ্ধতিরও বিকাশ ঘটেছে। বৈদিক যুগে ছিল যজ্ঞভিত্তিক এবং দেবতাদের রূপ কল্পনা করে যজ্ঞের মধ্যে দিয়ে তাঁদের আহ্বান করা হত। পৌরাণিক যুগে দেবতাদের মূর্তি বা বিগ্ৰহ নির্মাণ করে এবং মন্দির স্থাপন করে সেই মন্দিরে দেবতাদের প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

তারপর পুষ্প, পত্র, নৈবেদ্য, ধূপ, দীপ প্রভৃতিসহ উপাসনা করা হয়। এ ধরণের উপাসনা পদ্ধতিকে বলা হয় পূজা। দেবতাদের মন্দির ও মহাপুরুষদের অবস্থানের স্থান অতি পবিত্র। এরূপ পবিত্র স্থানকে তীর্থ বলা হয়। তীর্থে গেলে দেহ মন পবিত্র হয়। যজ্ঞ, পূজা, ঈশ্বর ও দেবতাদের গুণকীর্তন, তীর্থভ্রমণ প্রভৃতির মধ্যে হিন্দু ধর্মের ক্রমবিকাশের পরিচয় রয়েছে।

আগেই বলেছি হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ বেদ। এছাড়া ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা, শ্রীচণ্ডী প্রভৃতি হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ। এ সকল ধর্মগ্রন্থে হিন্দুধর্মের উদ্ভব ও বিকাশের পরিচয় রয়েছে।

সৃষ্টিতত্ত্ব

হিন্দুধর্মের নানা গ্রন্থে সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে। ঈশ্বর যা করেন তাকে বলে লীলা। ঈশ্বরের লীলায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টির শুরুতে প্রাণী বা বস্তু- কিছুই ছিল না। ‘অপ এব সসর্জাদৌ’- প্রথমেই জলের সৃষ্টি হল । বিশ্বব্রহ্মাণ্ডব্যাপী প্রসারিত হল এক মহাসমুদ্র। সেই সমুদ্রে ঈশ্বর বিষ্ণুরূপে শায়িত হলেন। তাঁর নাভিপদ্মে বসলেন সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মা।

বিষ্ণু তখন ছিলেন মহানিদ্রায়। এই সময় বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুই দৈত্যের সৃষ্টি হল। সৃষ্টির পরই দৈত্যরা ব্রহ্মাকে হত্যা করতে ধেয়ে গেল। ব্রহ্মা তখন মহামায়া ও বিষ্ণুর স্তব করতে লাগলেন। মহামায়া প্ৰসন্ন হলেন। বিষ্ণু মায়ানিদ্রা থেকে জাগ্রত হলেন। দৈত্য মধু ও কৈটভ তাঁর হাতে নিহত হল। মধু ও কৈটভের মেদ থেকে মেদিনী অর্থাৎ পৃথিবীর সৃষ্টি হল।

ঈশ্বর আকাশ, বাতাস, স্বর্গ, পাতাল প্রভৃতিও সৃষ্টি করলেন। বিশ্ব তখনও অন্ধকার। ঈশ্বর অন্ধকার দূর করার জন্য সূর্য ও তারকাসমূহ সৃষ্টি করলেন। সৃষ্টি করলেন বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহ। কশ্যপ মুনির দুই পত্নী ছিল। দিতি ও অদিতি। দিতি থেকে দৈত্য এবং অদিতি থেকে আদিত্য বা দেবতাদের জন্ম হল। তারপর ব্রহ্মা নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করলেন।

পুরুষের নাম স্বায়ম্ভুব মনু এবং নারীটির নাম হল শতরূপা। স্বায়ম্ভুব মনু ও শতরূপার দুই পুত্র ও তিন কন্যার জন্ম হয়। পুত্র দুটির নাম প্রিয়ব্রত ও জ্ঞানপাদ। আর কন্যা তিনটির নাম ছিল আকুতি, দেবাহুতি ও প্রসূতি। তারপর পৃথিবীতে এল আরও মানুষ। মনুর সন্তান বলে মানুষকে মানব বলা হয়।

 

হিন্দু ধর্মের বিকাশ

 

সারাংশ

আর্য ও প্রাগার্য নানা মত ও পথের সংমিশ্রণে সনাতন ধর্ম বা হিন্দু ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে। পথ ও মতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে ক্ষেত্রবিশেষে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। স্রষ্টার কথা বলতে গিয়ে সাধকেরা সৃষ্টিতত্ত্বও বর্ণনা করেছেন।

আরও দেখুন :

Leave a Comment