প্রভু জগদ্বন্ধু

বাংলার ধর্মীয়-সামাজিক ইতিহাসে প্রভু জগদ্বন্ধু একটি অনন্য নাম। তিনি শুধু একজন সাধকই ছিলেন না, বরং ছিলেন মানবপ্রেমিক, সংস্কার-ভাঙনের অগ্রদূত এবং অস্পৃশ্য ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর আশ্রয়দাতা। তাঁর জীবনীতে যেমন ঈশ্বরভক্তির গভীরতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে মানুষের অধিকার ও মর্যাদার জন্য অদম্য আহ্বান।

প্রভু জগদ্বন্ধু

 

প্রভু জগদ্বন্ধু

ফরিদপুরে প্রত্যাবর্তন ও আধ্যাত্মিক যাত্রা

বৃন্দাবন থেকে ফিরে এসে প্রভু জগদ্বন্ধু ১৮৯০ সালে ফরিদপুর জেলার ব্রাহ্মণকান্দায় আসন গ্রহণ করেন। তখন ফরিদপুর শহরতলীতে বাগদী সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করতেন, যাদের নীলকর সাহেবরা সাঁওতাল পরগণা থেকে নিয়ে এসেছিল শ্রমের জন্য। এরা হিন্দু সমাজে উপেক্ষিত, অবহেলিত ও অস্পৃশ্য হিসেবে বিবেচিত হতো।

সেই সময় খ্রিস্টান মিশনারিরা তাঁদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু হিন্দু সমাজে এ সংবাদ কোনো আলোড়ন তুলতে পারেনি। মানবপ্রেমিক জগদ্বন্ধুর হৃদয় তা দেখে ব্যথিত হয়। তিনি সরাসরি বাগদীদের সর্দার রজনী মোড়লকে ডেকে পাঠান। প্রভুর স্নেহময় আহ্বানে রজনী ব্রাহ্মণকান্দায় এসে পৌঁছান। জগদ্বন্ধু তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘোষণা করলেন— “কে বলে তোমরা নীচ? তোমরা মানুষ, শ্রীহরির দাস। মানুষের মধ্যে উচ্চ-নীচ নেই।”

এই বাণী রজনীর অন্তর পাল্টে দেয়। তিনি নতুন জীবনের স্বাদ পান এবং সমগ্র বাগদীপাড়া প্রভুর ভক্ত হয়ে ওঠে। তাঁরা খোল-করতাল নিয়ে নামকীর্তনে নিমগ্ন হন।

 

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

সামাজিক সংস্কার ও মানবপ্রেম

প্রভু জগদ্বন্ধুর প্রভাব শুধু বাগদীপাড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। কলকাতার রামবাগানের ডোম সমাজকেও তিনি হীনমন্যতা থেকে মুক্ত করেন। তাঁর প্রেরণায় তাঁরা মাথা উঁচু করে সমাজে চলতে শেখেন।

তিনি দেখিয়েছিলেন যে হরিনাম কীর্তন কেবল ধর্মীয় ভক্তি নয়, বরং তা সামাজিক সমতা ও ভ্রাতৃত্বের এক মহান আদর্শ। উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের মানুষকে একত্র করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “মৈত্রীপূর্ণ সহাবস্থান” এর নীতি।

 

শ্রীঅঙ্গন ও গম্ভীরা লীলা

ফরিদপুরে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীঅঙ্গন, যা আজও ভক্তদের জন্য আধ্যাত্মিক তীর্থস্থল। এখানে শুরু হয় তাঁর গম্ভীরা লীলা

১৩০৯ আষাঢ় থেকে ১৩২৫ ফাল্গুন পর্যন্ত টানা ১৬ বছর ৮ মাস তিনি জানালাবিহীন ছোট্ট একটি ঘরে দরজা বন্ধ করে ধ্যানস্থ ছিলেন। মানুষের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি, শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। অবশেষে ১৩২৮ সালের ১লা আশ্বিন তিনি নিত্যলীলায় প্রবেশ করেন। তাঁর প্রস্থান ভক্তসমাজকে অশ্রুসিক্ত করে তোলে।

সাহিত্যকীর্তি

প্রভু জগদ্বন্ধু শুধু ভক্তিমূলক জীবনযাপনই করেননি, তিনি আধ্যাত্মিক গ্রন্থও রচনা করে গেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

  • শ্রীশ্রীহরিকথা

  • চন্দ্রপাত

  • ত্রিকালগ্রন্থ

এই রচনাগুলি আজও ভক্তদের মধ্যে দিকনির্দেশনা ও আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা জোগায়।

প্রভুর উপদেশসমূহ

প্রভু জগদ্বন্ধুর বাণী মানুষের জন্য আজও সমান প্রাসঙ্গিক—

১। প্রার্থনা নিবেদন করতে হবে – শ্রীকৃষ্ণ সব জানলেও ভক্তকে নিজের মুখে প্রার্থনা করতে হবে।
২। নিরন্তর হরিনাম জপ করতে হবে – কৃষ্ণই গতি, কৃষ্ণই পতি; এটাই সর্বোচ্চ ধর্ম।
৩। পিতা-মাতার প্রতি সম্মান – তাঁদের মনে আঘাত দিয়ে কেউ শান্তি পেতে পারে না।
৪। পরচর্চা ত্যাগ করতে হবে – এটি বিষের মতো; ঘরে ঘরে “পরচর্চা নিষেধ” লিখে রাখা উচিত।
৫। হরিনামই মহামন্ত্র – এটি গোপন নয়, বরং প্রকাশ্যে প্রচার করতে হবে।

প্রভু জগদ্বন্ধু ছিলেন একাধারে সাধক, সমাজসংস্কারক এবং মানবপ্রেমিক। তিনি নিম্নবর্ণ ও অস্পৃশ্য মানুষের মধ্যে আত্মমর্যাদা জাগ্রত করেছিলেন। তাঁর জীবন দেখিয়েছে— ধর্ম কেবল ব্যক্তিগত ভক্তি নয়, বরং সামাজিক ন্যায় ও মানবতার জন্য এক শক্তিশালী মাধ্যম।

আজকের দিনে, যখন সমাজ বিভাজন ও বৈষম্যে জর্জরিত, প্রভু জগদ্বন্ধুর বাণী আমাদের শেখায়— মানুষের আসল পরিচয় তার মানবত্বে, জাতি বা বর্ণে নয়।

Leave a Comment